দীর্ঘ জীবনে বহু কাছের মানুষের মৃত্যু দেখেও কর্মে অবিচল থাকা কবিগুরু বলেছিলেন “মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান”


রবিবার,০৯/০৫/২০২১
6938

অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে এক অত্যন্ত সঙ্কটজনক পরিস্থিতি,ভয়াবহ মারণ রোগে আক্রান্ত সমস্ত মানবজাতি। চারিদিকে শুধু হাহাকার, আর্তনাদ ও ক্রন্দন। এই দূরবস্থায় মনের একাগ্রচিত্ততা, পবিত্রতা, অপার্থিব শান্তির খোঁজ, ও অন্যতম আশ্রয়স্থল হল বিশ্বকবির সৃষ্টি সম্ভার। প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে অসুস্থ দেহে ও মনে তৃষ্ণার বারি ,মনোবল,ভয়কে জয় করার তীব্র আকাঙ্খা,আনে তোমার অভয় বাণী:

“বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়…
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা,
ত্বরিতে পারি শকতি যেন রয়”

ঘরের জানলা খুললেই ঘন ঘন রাস্তা দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের শব্দধ্বনি হৃদয়ে কাঁপুনি ধরায়, সারাদিন টেলিভিশনে শুধু দেখি মৃত্যুমিছিল, অগনিত মৃতদেহ স্তুপাকার রাশি, সারাক্ষন মোবাইল ফোনে পরিচিত কাছের জনের মৃত্যু সংবাদ, পরিবার পরিজনদের অসহায় আর্তচিৎকারের মধ্যে একমাত্র বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয় ‘বিশ্বকবি’ তোমার গান,
                                    “জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো
                                    সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীত সুধারসে এসো”
 
রবীঠাকুরের গান যেন প্রত্যেক মানুষের একান্ত মনের গোপন কথা, গান যেন ভাবসঙ্গীত- আর এই সঙ্গীতের মাধ্যমে নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ ‘চিরন্তন সত্যের’ যা অত্যন্ত বিরল। রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষের মনের কথা, মনের গভীরতম আবেগের কথা বলে, তাই ‘জীবনমুখী আধুনিকতম’ গান হল কবিগুরুর গান।
           
একে একে বন্ধু, পরিজন, গুরু মহাশয়রা যখন মহামারি যন্ত্রণায়,তীব্র শারীরিক কষ্টে, অসহায় অবস্থায় চোখের সামনে, চিরকালের মতো বিচ্ছেদের আহ্বান জানিয়ে যান, তখনই ‘হে বিশ্বকবি’-প্রতি পলে, অন্তরাত্মায় ‘চিত্ত-শান্তির বাণী’ শুনিয়ে যাও তোমার গানে,…
                                   
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”
 
রবীঠাকুর নিজের সর্বস্ব উজাড় করে, মানবকল্যান সাধনে নিবেদিত ছিলেন বলেই হয়ত মৃত্যু বেদনা, স্বজন হারানো বিষাদ থেকেই বলতে পারেন,

“মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ,
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ।”

জীবনকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কিভাবে প্রকৃতি ও প্রেমের কাছে নিবেদন করতে হয় ,–তাতো তোমার কাছ থেকেই শেখা কবিগুরু, প্রতি পলে মনে হয়,

“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
           
আবার জীবন প্রভাতে দাঁড়িয়ে ‘মৃত্যু’ কে ‘অমৃতের স্বরূপ’ ধরেই বলতে পারি…
                                   
“মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান
মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট
রক্ত অধরপুট, তাপবিমোচন, করুণকোর তব
মৃত্যু অমৃত করে দান।”
 
আসলে ‘মৃত্যু’ এমনই এক বাস্তব নিষ্ঠুর সত্য যে তাকে অস্বীকার কোন ভাবেই করা যায় না। নশ্বর এই দেহ সর্বদাই মৃত্যুকে এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইলেও ‘মৃত্যু’ কে আমন্ত্রণ ও আলিঙ্গন করতেই হয়। এই চরম সংকট মহামারি কালে কবিগুরু তুমি তোমার ‘ছিন্নপত্র’ তে জানালে,

“জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে ‘মৃত্যু’র মধ্য দিয়ে তার পরিচয় পেতে হবে।”
           
তবুও বিস্ময় জাগে, প্রেরণা পাই, আনন্দে বিহ্বল হই, সত্যকে স্বীকার করি,- অকৃত্তিম অনুপ্ররণায়, ‘বিশ্বকবি’ – তোমার প্রবল অনুভূতিপূর্ণ ভালোবাসাকে। বিদায় নিতে হবে জেনেও

“এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি,
এ ভালোবাসাই সত্য এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যু রে করিবে অস্বীকার।”
          
 তোমার কাছেই পাওয়া গুরুদেব জীবনদর্শণের মতো মৃত্যুদর্শণও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ‘মৃত্যু’ তার নিত্য আনন্দ ও দুঃখের মাধ্যমে চরমসত্যকে জীবনের আঙিনায় আহ্বান জানায়, তাই তো বিশ্বকবি তোমার বাণী অবগাহনে চিত্তে শান্তির বারি ধ্বনিত হয়,…
           
“ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞান ভাবে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।”

হে কবি, তোমার অনন্ত প্রেমশক্তি, সুরসম্ভার, শান্তির বারি দিয়ে তুমিই জানালে ‘জীবনের অপর নাম হোলো মৃত্যু’– জীবনের অনন্ত যাত্রাপথে ‘মৃত্যু’ এক পরমাত্মীয়। বিশ্বের সকল সৌন্দর্য্যই এই পার্থিব জগতের সঞ্চিত সকল সুধারসে সৃষ্টি,- তাই জীবনপ্রবাহ মৃত্যুহীন,…তাইতো তোমার লেখনীতে সুধারস ঢালো প্রাণে কবি:
                                    “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই,
                                    কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।”

জীবনের মধ্য থেকেই দুঃখ ও মৃত্যু কে সহজভাবে বরণ করে নিতে বারবার ধ্বনিত হয় তব কণ্ঠে হে বিশ্বকবি,
“শোন বিশ্বজন, শোন অমৃতের পুত্র যত দেবগণ দিব্যধামবাসী।
আমি জেনেছি তাঁহারে, মহান্ত পুরুষ যিনি
আঁধারের পারে জ্যোতির্ময়
তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।”

এই বিশ্ব এখন মহামারীর করাল গ্রাসে আক্রান্ত, প্রতিনিয়ত যখন সমগ্র মানবজাতি নিরন্তর প্রয়াস, নিরবচ্ছিন্ন লড়াই করছে বাঁচার তাগিদে, তখন তোমার প্রেমসুধা বাণী লড়াই করার প্রেরণা জাগায়,শান্তি, ভরসা জাগায় মনে, তাই…
                                    “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
                                    এ সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথহারা।”

 কেবলই   মুগ্ধতা আনে বিশ্বকবির গানে। কী আকুতি, কী গভীর প্রেম, – জীবনের নানা ক্ষণে,…নানা অনুভূতিতে সকল সঙ্গীতগুলি যেন অমূল্য সম্পদ, যেন আমাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, প্রাণের স্বত্তা – কবিগুরু যেন প্রতি পলে সুর মেলাতে চেয়েছেন এই বিপুলা পৃথিবীর প্রকৃতি লীলাখেলায়…

“সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে
সুরের হাওয়া চলে গগন  বেয়ে
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে
বহিয়া যায় সুরের সুরধ্বনি।”

পরমাত্মা পরমেশ্বরকে ডাকেন কবি,কী আকুল তাঁর আর্তি,… সৃষ্টির স্রষ্টাকে বুঝি এভাবেই আহ্বান করতে হয়,
“আমার এ দেহ খানি তুলে ধরো,
তোমার ঐ দেবালয়ের প্রদীপ করো।
নিশিদিন আলোক শিখা জ্বলুক গানে।।”

বড় বিষ্ময় জাগে হে বিশ্বকবি, আমাদের চেয়েও তুমি কাছের মানুষকে, অতি আপনজনদের মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও কর্তব্যে অবিচল ছিলে তুমি। কম দুঃখ তো তুমি পাওনি জীবনে!! একে একে ‘নিবিছে দেওটি’- তোমার প্রথম মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ হল জননী সারদা দেবীর প্রয়াণে,– এর পর চলে গেলেন, জীবনের কবিত্বশক্তির অনুপ্রেরণা দাত্রী কাদম্বরী দেবী, পিতা দেবেন্দ্রনাথ, প্রিয়তমা পত্নী ‘ছুটি’  মৃণালিনী দেবী, প্রাণাধিক পুত্র ‘শমী’, কন্যা ‘রেণুকা’,… মৃত্যুর সুতীব্র আঘাত সমগ্র সত্ত্বায় গভীর অনুরণন তুললেও একটি চিঠির পাতায় কী অপূর্ব উপলব্দি রেখে গেলে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে,

“যে রাত্রে শমী’ গিয়েছিল, সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম ‘বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক’…….পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে, তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি…সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে।”

প্রিয় সন্তান ‘শমী’–র অকাল প্রয়াণেও কোন কাজে ছেদ পড়েনি তোমার!! অবিচল কর্তব্যে গান রচনা চলেছে, শিলাইদহের কাজ করে গেছো ,আবার ‘গোরা’ উপন্যাসের ধারাবাহিক কিস্তি লিখে গেছো,– সকল দুঃখ, যন্ত্রনা, ব্যথা, নীরবে বুকে সহ্য করে। তোমার পিতৃহৃদয় মর্মান্তিক আঘাতেও হার স্বীকার করেনি জীবনের দাবীর কাছে, তাই বিশ্ববাসীকে বঞ্চিত না করে একের পর এক সঙ্গীত, কাব্য, উপন্যাস সমস্ত অকৃপণ হস্তে দিয়ে গেছো যত্ন করে। শোক তোমাকে বার বার আঘাত করে, কিন্তু পরাভূত করতে পারে না,… অচঞ্চল থাকো বারবার। তাইতো তোমার কাছ থেকেই আমাদের শেখা…

“ব্যাঘাত আসুক নব নব, 
আঘাত খেয়ে অটল রব,
বক্ষে আমার দুঃখে তব, বাজবে জয়ডঙ্ক।
দেব সকল শক্তি, লব. অভয় তব শঙ্খ।”

কিংবা

“আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো,
আরো কঠিন সুরে জীবন তারে ঝংকারো।”

তাই আজ যখন একের পর এক স্বজন হারানো বেদনার আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয়, বুকভরা হাহাকার ধ্বনি মন কে বিচলিত করে তখনি তোমার কথা প্রতি মুহূর্তে স্মরণে জাগে কবি,…মনে হয় কী দুঃসহ যন্ত্রণা বিদ্ধ হয়েও সৃষ্টি-সুখে কাব্য সঙ্গীত সুধা দিয়ে গেছ, – যেন বলতে চেয়েছ,
                                   
“তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি,
সকল খেলায়,
সকল খেলায় করব খেলা এই আমি।”

সত্যি ‘হে কবি’ আজ একশ ষাট বছর (১৮৬১-২০২১) পরেও প্রতি প্রভাতে, ‘সকল রসের ধারায়’ তুমি আমাদের অবলম্বন, তুমিই আলোর দিশারী, তোমার দেখানো পথে আমরাও বলি…যতদিন আছি,আমাদের কাজের ধারা চলতে থাকবে, মনে সাহস রেখে, অবসাদে না ভুগে, ঘটনার প্রবাহকে যেন সহজে স্বীকার করেই বলি:

“মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।”


লেখিকা: অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট