মকর সংক্রান্তির ইতিহাস ও বর্তমানগঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থান তীর্থভূমি গঙ্গাসাগর


সোমবার,১১/০১/২০২১
970

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী : বাঙালির মকর সংক্রান্তি উত্‍সবের ইতিহাস ও বর্তমানগঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থান তীর্থভূমি গঙ্গাসাগর। গঙ্গাসাগরের খ্যাতি কেন? তীর্থভূমি বলে, না কি মেলাভূমি বলে। কিন্তু গঙ্গাসাগরের বেলাভূমিটি কম আকর্ষণীয় নয়।ছোটবড় ৫১টি দ্বীপ নিয়ে ৫৮০ বর্গ কিমি জুড়ে সাগরদ্বীপ। গঙ্গার মর্ত্যে আসা ও সগর রাজার পুত্রদের জীবনদানের লোকগাথাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই তীর্থভূমি। কপিল মুনির আশ্রমটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা কপিল মুনির মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে ভক্ত সমাগম হয়। মকর সংক্রান্তির পুণ্য তিথিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় জমে এই সঙ্গমে। মেলার সময়টুকু বাদ দিলে গঙ্গাসাগর নিরালা, নির্জন।মন্দিরের সামনে থেকে নির্জন বালিয়াড়িটি সোজা গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। এখানে সমুদ্র ঢেউ ভাঙে না। তির তির করে এগিয়ে এসে পা ভিজিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাও সমুদ্রের ভিতরে। পায়ের পাতা ভেজানো জল থেকে হাঁটু জলে। বড় কেউ সঙ্গে থাকলে স্নান করো। ফিরে এসো সমুদ্রতটে। অবাধে খেলে বেড়ায় লাল কাঁকড়া। তোমার আগমন টের পেলে সেঁধিয়ে যায় গর্তে। দূরে, দিগন্তরেখায়, একটা, দু’টো, তিনটে..অনেক অনেক নৌকা, নাকি ট্রলার।

মাছ ধরতে গেছে গভীর সমুদ্রে।ভ্যানরিকশায় চেপে বেরিয়ে পড়ো দ্বীপ দর্শনে। মঠ-মন্দির-আশ্রমের এই সাগরসঙ্গমে। ঘুরে এসো মনসাদ্বীপে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে আর লাইটহাউসে। বিকেলে আর একবার চলে যাও সাগর কিনারায়। তবে ভিন্ন পথে। যে পথ সেচবাংলো থেকে সমুদ্রে গেছে সেই পথে। এই পথে ঝাউয়ের জঙ্গল পাবে। এখনও অক্ষত।সন্ধ্যায় ঘরে বসে বড়োদের কাছে শুনে নাও ভগীরথের গঙ্গাকে মর্ত্যে আনার কাহিনি। নিকটতম বড় শহর কলকাতা। রেলস্টেশন কাকদ্বীপ ও নামখানা। কলকাতা থেকে বাসে ঘণ্টা তিনেকের যাত্রায় পৌঁছনো যায় হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে। ট্রেনে কাকদ্বীপ বা নামখানা পৌঁছেও বাসে বা রিকশায় হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর লঞ্চ ঘাটে পৌঁছনো যায়। সেখান থেকে ফেরি ভেসেলে গঙ্গা পেরিয়ে কচুবেড়িয়া। কচুবেড়িয়া থেকে বাসে বা ট্রেকারে ৩০ কিমি দূরে সাগর। মেলার সময় যাতায়াতের আরও বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। গঙ্গাসাগরে থাকার জন্য নানান ধরমশালা ও পান্থনিবাস আছে। এ ছাড়া পি ডব্লু ডি, সেচ দফতরের ও পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলো ও পঞ্চায়েতের যাত্রীনিবাস আছে। মকর সংক্রান্তি র ইতিকথা ও ইতিহাসপৌষ বা মকর সংক্রান্তিতে সূর্য ধনু রাশি থেকে মকরে সঞ্চারিত হয়, তাই এর নাম ‘মকর সংক্রান্তি’। একে ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’-ও বলে, কারণ এই দিন থেকে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে। এই সংক্রান্তির ব্রহ্মমুহূর্তে যমুনা নদীতে মকর-স্নান করলে আয়ুবৃদ্ধি হবে — এই বিশ্বাসে মাতা যশোমতী বালক কৃষ্ণকে স্নান করাতে নিয়ে যান।

পরে এদিনেই যমুনায় স্নান সেরে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধিকার সঙ্গে ‘মকর-পাতায়’, এ হল আত্মার সঙ্গে আত্মার দৃঢ় বন্ধন স্থাপন।বাংলার অনেক স্থানে একসময় কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে কনকনে ঠান্ডার ভোরে একমাস ব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করতো। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা-তামসিকতার রিপুগুলিকে জয় করার এ ছিল এক সংগ্রামী মনোবৃত্তি। ছড়া গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম ছিল: “এক ডুবিতে আই-ঢাই।/দুই ডুবিতে তারা পাই।।/তিন ডুবিতে মকরের স্নান।/চার ডুবিতে সূর্যের স্নান।/পাঁচ ডুবিতে গঙ্গাস্নান।।”২. উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে বাস্তুপূজার প্রচলন আছে। শঙ্খপাল, বঙ্কপাল, ক্ষেত্রপাল, নাগপালের ধ্যান করে বাস্তুর ধ্যান ও মানসোপচারে পূজা করা হয় এইদিন। বাস্তুর প্রণাম মন্ত্র হল, “ওঁ বাস্তুরাজ নমস্তুভ্যং পরমস্থানদায়ক। সর্বভূতজিতস্ত্বঞ্চ বাস্তুরাজ নমোহস্তু তে।” এরপর পাদ্যাদি দিয়ে গ্রাম্যদেবতার পূজা করা হয় এবং পায়স-বলি দান করা হয়।’আমার মা’র বাপের বাড়ি’ গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন, পৌষ সংক্রান্তি “মহাধুমধামের সংক্রান্তি। বসতভিটার মঙ্গলের জন্য বাস্তুপূজা হয় এ দিন। তুলসীমন্ডপে ‘ঝিকা’ গাছের ডাল কেটে তার তলায় পুজো হয়। পুরুতমশাই নিজে ‘চরু’ রান্না করে দিয়ে যান। আজ এই চরু-ই পূজার প্রধান অঙ্গ।” চরু রান্না হয় পাটশলমির আগুনে, নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে।৩. পৌষ সংক্রান্তি দিনে গ্রাম-বাংলার অনেক স্থানে উঠোনে মড়াই-এর পাশে ‘উঠোন লক্ষ্মী’র পুজো হয়।

তিনিই কোথাও ‘পৌষলক্ষ্মী’। এদিন বাড়ির উঠোন গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে, শুচি-স্নিগ্ধ করে তোলা হয়। ধানকাটা পর্বে যে ‘পৌষ তোলা’র চার-পাঁচ গুচ্ছ ধানগাছ সাদরে গৃহস্থ বাড়িতে আনা হয়েছিল, তাই গাদা থেকে নামিয়ে মাথায় বহন করে নামানো হয় উঠোনে। গোটা উঠোন জুড়েই আলপনার নান্দনিকতা। আঁকা হয় লক্ষ্মীর নানান গয়না; চাষের সমস্ত উপকরণ–গরু, লাঙল, জোয়াল, মই; আর লক্ষ্মীর পা–পৌষ গাদা থেকে পুজোস্থল পর্যন্ত, পুজোস্থল থেকে গৃহের সিংহাসন পর্যন্ত। এই চরণ চিহ্নে পা ফেলেই যেন লক্ষ্মী ঘরে আসবেন। বাংলার কোনো কোনো স্থানে একে বার (বাহির) লক্ষ্মীপুজোও বলে। পুজো শেষ হলেই ঠাকুর তোলা যায় না। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা বা শেয়ালের (দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে শেয়াল লক্ষ্মীর বাহন বলে কথিত) ডাক শুনে উঠোন থেকে লক্ষ্মীকে ঘরে তোলা হয়। গভীর রাতে লক্ষ্মী তুলে উঠোন নিকিয়ে ঘুমতো যান গৃহকর্ত্রী। ৪. পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি লোকাচার হল ‘আওনি-বাউনি’ বা ‘আউরি-বাউরি’। এটি আগের দিন পালিত হয়। তবে দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে এর নাম ‘চাঁউনি-বাউনি’ বা ‘চাউড়ি-বাউরি’ যা পৌষপার্বণের দু’দিন আগে ‘মচ্ছিমূলো’ খেয়ে পালিত হয়। ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে এর বর্ণনা এইরকম, “….আউরি-বাউরি দিয়া সব বাঁধিতে হইবে, মুঠ লক্ষ্মীর ধানের খড়ের দড়িতে সমস্ত সামগ্রীতে বন্ধন দিতে হইবে, — আজিকার ধন থাক, কালিকার ধন আসুক, পুরানে নূতনে সঞ্চয় বাড়ুক। লক্ষ্মীর প্রসাদে পুরাতন অন্নে নূতন বস্ত্রে জীবন কাটিয়া যাক নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায়। অচলা হইয়া থাক্ মা, অচলা হইয়া থাক্।” সোনার পৌষ যে চলে যায়, তাকে বাঁধতে হবে!

তাই শিসসহ ধানগাছ পুজো করে ঘরের খুঁটি, গোলা, গোয়াল ঘর, সিন্দুক ঢেঁকিশালে তা বাঁধা হয়। আর শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করা হয়। তারই অঙ্গ হিসাবে বাংলার মেয়েরা ছড়া কেটে পৌষ বন্দনা করেন, “পৌষ পৌষ — সোনার পৌষ/এস পৌষ যেয়ো না/জন্ম জন্ম ছেড়োনা।/না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষ–/না যেয়ো ছাড়িয়ে,/পৌষ পৌষ — সোনার পৌষ।” ৫. পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে রাঢ় তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় ‘টুসু জাগরণ’ হয়। টুসু উত্‍সবের শুরু অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে। পৌষ সংক্রান্তির ভোরে সূর্যোদয়ের আগে টুসু বিসর্জন দেওয়া হয়। কারণ সূর্যের সঙ্গে টুসুর ভাসুর-বুয়াসি বা ভাদ্র-বউ সম্পর্ক। যেহেতু চৌডল ব্যবহার করলে সূর্যদেব দর্শিত হন না, তাই সুদৃশ্য চৌডলে টুসু ভাসান যায়।তুষ-তুষলীর ব্রতিনীরা এই দিন মাস-কালীন ব্রতের শেষে জমিয়ে রাখা তুষ-গোবরের গুলি মাটির হাঁড়িতে রেখে আগুন ধরায়। তারপর তা ভাসিয়ে দেয় নদী বা পুকুরের জলে। একাধিক ব্রতিনীর ভাসানো অগ্নিশিখা বহনকারী হাঁড়ি বায়ুচালিত হয়ে ঘাট-ঘাটলার কিনারে কিনারে চরে বেড়ায়।৬. বাংলার কোনো কোনো স্থানে এদিন ‘ধর্মের পিঠে’ উত্‍যাপিত হয়।

এই লোকানুষ্ঠানটি ধর্ম বা সূর্য পূজার অঙ্গ। বাড়ির উঠোন সকালে গোবর জলে নিকিয়ে নতুন কলকে নিয়ে পিটুলির ৫টি গোলাকার ছাপ দেওয়া হয়। ছাপ পড়ে গোয়ালে, গবাদিপশুর দেহে, গোলায়, ঢেঁকিশালে এবং ঘরের মধ্যে। গৃহস্থের সামগ্রিক কল্যাণ কামনাই এই লোকানুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য।৭. দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় এদিন বত্‍সরান্তের কৃষিকাজ সমাপনান্তে খামার খুঁটিকে কেন্দ্র করে উত্‍সবের আয়োজন হয়। একে ‘মেহি পূজা’ বলে, কারণ ‘মেহি’-র অর্থ খুঁটি। এই খুঁটি ঝাড়াই-মাড়াই সহ নানান কাজের সাক্ষী, গরু বাঁধার স্থান। তাই মেহি পূজা বা খামার পূজা হল এক কৃতজ্ঞতার অনুষ্ঠান, ধন্যবাদাত্মক চিন্তন। খুঁটিকে কেন্দ্র করে আঁকা হয় নানান কৃষি উপকরণের আলপনা, পরিষ্কার করে সাজানো হয় সেইসব উপকরণ। কৃষক-পুরুষ শেয়ালের ডাক শুনে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে নতুন ধানে ভরা মান মরাইতে তুলে সে বত্‍সরের মত কৃষিকার্যের সমাপ্তি হয়। ৮. পৌষ সংক্রান্তিতে গ্রহণ করা হয় দধি সংক্রান্তির ব্রত। এ দিন সেই ব্রতের সূচনা, প্রতি সংক্রান্তিতে তার আচরণ এবং পরের বছর এই দিনেই ব্রতের প্রতিষ্ঠা বা সমাপ্তি। এই দিন দধি দ্বারা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে স্নান করিয়ে দধি ও ভোজ্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়। শোনা হয় ব্রতকথা।ফল-সংক্রান্তি ব্রতের অঙ্গ হিসাবে এই সংক্রান্তিতে হরিতকী দান করলে হংসযুক্ত রথে আরোহণ করে বৈকুন্ঠে গমন করা যায় বলে হিন্দুদের বিশ্বাস।৯. পৌষপার্বণ পিঠেপুলির অনুষ্ঠান।

এজন্য চাল কোটা হয় ‘বাউড়ি’-র আগের দিন। চাল গুঁড়ো, ভেজা চাল সর্বদা উঠোন-ঘর করতে হলে তা পাত্রে ঢেকে, তুলসি পাতা আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে নিয়ে যেতে হয়, নইলে তা ভূতে পায়।ঠাকুরমা’র ঝুলির ‘কাঁকণমালা, কাঞ্চনমালা’ গল্পে রয়েছে ‘পিট-কুড়ুলির ব্রত’-র কথা, রাজ্যে পিঠা বিলানোর অনুষ্ঠান। রাণীকে চালের গুড়োয় আঙ্গিনায় আলপনা দিয়ে পিড়ি সাজিয়ে দিতে হয়, দাসীরা পিঠের যোগার-যাগাড় করে। রাণী রূপী দাসী তৈরি করেন আস্কে পিঠা, চাস্কে পিঠা আর ঘাস্কে পিঠা; দাসী বানান চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশী, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা। দাসী চালের গুঁড়োয় খানিকটা জল মিশিয়ে এতটুকু নেকড়া ভিজিয়ে পদ্ম আঁকলেন, পদ্ম-লতার পাশে সোণার সাত কলস আঁকলেন; কলসের উপর চূড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া, ময়ূর, পুতুল, মা লক্ষ্মীর সোনা পায়ের দাগ।সংক্রান্তির পূর্বদিন অনেক স্থানে ভাজা পিঠে হয়; তা সেদিন ও পরদিন সকালে খাওয়া হয়। সংক্রান্তির দিন তৈরি হয় নানান পিঠে, সেগুলি সেদিন ও পরদিন খাওয়া হয়। পৌষ পার্বণের পরদিনও পিঠে তৈরি হয় যা তার পর দিন পর্যন্ত খাওয়া হয়। এইভাবে গ্রাম বাংলায় পরপর চারদিন পিঠে উত্‍সব ও ভোজন।পৌষ সংক্রান্তিকে ‘তিল সংক্রান্তি’-ও বলে। এদিন তিল দিয়ে নাড়ু, মিষ্টি তৈরি করে পূজায় নিবেদিত হয়। লোকবিশ্বাস, এই দিন তিল না খেলে নাকি দিন বাড়ে না অর্থাত্‍ সূর্যের মকর যাত্রা সংঘটিত হয় না। ১০. মেদিনীপুরে এইদিন লৌকিকদেবী বড়াম; মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলীতে সিনিদেবী এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বারা ঠাকুরের যুগ্মমূর্তি, নারায়ণী ও দক্ষিণ রায়ের বাত্‍সরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।মেদিনীপুর, পিংলা, ময়না, সবং অঞ্চলের মাহিষ্য কৃষক সম্প্রদায় এদিন বিকেলে ‘বণিপুজো’র আয়োজন করে। গৃহের পুরুষ বা নারীরাই এর উদ্যোক্তা এবং পূজক।

এর তিনটি পর্যায় — মই খুঁটি প্রতিষ্ঠা, খেত মাড়ান এবং ‘সাঁথ ধরা’। এটি মেহি পূজার মতই এক লোকাচার। খেত মাড়ান পর্বে চাষের জমিতে রক্ষিত একগুচ্ছ ধান গাছের (‘ঝুঁটি’) গোড়ায় ‘লবাত্‍’ (নতুন ধানের চাল বেটে প্রস্তুত মিষ্টান্ন) ও ফলমূল নৈবেদ্য রেখে সরষে ও সাদা কল্কে ফুল (‘শুক্ল যাদু’-র প্রতীক) দিয়ে পুজো করতে হয়। এরপর সেই ঝুঁটি ছিঁড়ে তা মইখুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়। আগামী বছর ভালো ধান হবার এ এক লৌকিক প্রার্থনা। ‘সাঁথ ধরা’ হল বন্য প্রাণির ডাক শুনে সেই পূজিত ‘ঝুটি’ সযত্নে ধানের গোলায় তুলে রাখার অনুষ্ঠান। লোকবিশ্বাস, শেয়ালের সাঁথ ধরা সবচাইতে সৌভাগ্যের বিষয়।রাঢ় অঞ্চলের অনেক স্থানে পৌষ সংক্রান্তির পরদিন তপশিলী সম্প্রদায়ের মানুষ কর্তৃক ‘আক্ষেন’ বা ‘আখ্যান দিন’ পালিত হয়। একে ‘এখ্যান যাত্রা’-ও বলে। এদিন লোকদেবতা ও অপদেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। পূজার শেষে আয়োজিত হয় নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান।অনেক স্থানে এইদিন গ্রামের বালকেরা ‘কুলাইর মাগন’ বা ‘কুলের মাগন’ বা ‘পৌষ মাগন’ পালন করে। তারা আমন ধান উঠে যাবার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে চাল, ডাল, সবজি মাগন করে আনে তা এইদিন নিজেরাই মাঠে রান্না করে কুলাই ঠাকুরকে নিবেদন করে এবং একত্রে ভোজন করে। ১১. একটি প্রচল কথা হল, “অন্নচিন্তা চমত্‍কারা”। কৃষকের গোলায় যখন ক্ষুধান্নের মজুত পরিপুষ্টি লাভ করে তখনই আসে শান্তি ও সমৃদ্ধির উত্‍সব। ফসলোত্তর এই সংক্রান্তি সেই শান্তির বার্তাই নিয়ে আসে সমগ্র ভারতীয় উপ-মহাদেশে। পশ্চিম ভারতে এটি ‘মকর সংক্রান্তি’, দক্ষিণের রাজ্যে ‘পোঙ্গাল’, উত্তর ভারতে ‘লোহরি’, অসমে ‘ভোগালি বিহু’; সুনির্দিষ্টভাবে কর্ণাটকে ‘ইল্লুবিল্লা’ এবং ‘মকর সংক্রমণা’, উত্তর প্রদেশে ‘খিচড়ি’, গুজরাটে ‘উত্তরায়ণ’, হরিয়াণা, হিমাচল প্রদেশে ‘মাঘী’, মহারাষ্ট্রে ‘তিলগুল’, বিহার-ঝাড়খন্ডে ‘সকরাত’। সর্বত্রই ফসল তোলা, ঝাড়াই, মাড়াই-এর অবসরে নদী বা সাগরে পুণ্যস্নান; ঐতিহ্যবাহী খাদ্যসামগ্রী রচনা ও বিতরণ; নববস্ত্র পরিধান আর সূর্যদেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উত্‍সব।প্রয়াগ, হরিদ্বার, গড় মুক্তেশ্বর, গঙ্গাসাগর প্রভৃতি স্থানে এই উপলক্ষে জমকালো মেলা বসে। প্রয়াগে কুম্ভ মেলার সূচনা আর শবরীমালায় তীর্থযাত্রার সমাপ্তি।

লোকবিশ্বাস, এদিন পরলোকগমন করলে তাকে আর ইহজীবনে ফিরে আসতে হয় না, সরাসরি বৈকুণ্ঠ লাভ হয়।নানান রাজ্যে ‘তিল-গুড়’ বা ‘তিল-লাড্ডু’ এদিনের শীতলতায় এক শক্তিদায়ী উষ্ণ খাবার। দক্ষিণের রাজ্যে তৈরি হয় ‘পোঙ্গাল’। তামিল বা তেলেগু ভাষায় শব্দটির অর্থ হল ‘হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধ করা’। নতুন চাল, ভাজা মুগ, বাদামি আখের গুড়, ইক্ষু-শক্কর, দুধ ও নারকেল দুধের সঙ্গে কিশমিশ, কাজু, এলাচে প্রস্তুত এক সুস্বাদু মিষ্টান্ন।গুজরাটে এদিন পালিত হয় ঘুড়ি উত্‍সব। এর প্রতীকি তাত্‍পর্য অসীম। আপন আকুতি দেবতার কাছে নিবেদনের নান্দনিকতায় রং-বেরঙের ঘুড়ির রূপ ধারন করে তারা আকাশে ওড়ে। তেলেগু গৃহস্থেরা এদিন গৃহের পুরাতন সামগ্রী বিক্রি করে বা আগুন ধরিয়ে ‘বন-ফায়ার’ করে। পাঞ্জাবীদের মধ্যেও এই প্রথা প্রচলিত আছে। অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানায় গবাদিপশুকে এদিন নানান সামগ্রী ভোজন করানো হয়। গুজরাটে তাদের গায়ে আঁকা হয় নানান রং। এই দিনে জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে স্মরণ-মনন করে মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দেন গুজরাটি পন্ডিতেরা। অধ্যাত্মিক মনন ও অভ্যাসে এই দিনটি তাই মান্যতা পেয়ে এক সর্ব ভারতীয় উত্‍সবের মর্যাদা লাভ করেছে; পাপ, অপরিচ্ছন্নতা ও অপবিত্রতা দূরীকরণই যার মূল সুর।তথ্যপঞ্জি:১. স্বামী নির্মলানন্দ (১৪১০) বারো মাসে তেরো পার্বণ (৬ষ্ঠ সংস্করণ), ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, কলকাতা।২. চিন্তাহরণ চক্রবর্তী (২০১৪) হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান ( তৃতীয় মুদ্রণ), প্যাপিরাস, কলকাতা।৩. বরুণ কুমার চক্রবর্তী (১৯৯৫) বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ (সম্পাদনা), অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স, কলকাতা।৪. সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৩৮৪) বাংলা উপন্যাসে লৌকিক উপাদান, ক্যালকাটা পাবলিকেশনস্, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৫৮-১১৭।৫. সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য (১৩৯৩) পুরোহিত-দর্পণ (অষ্টত্রিংশ সংস্করণ), সত্যনারায়ণ লাইব্রেরি, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৪০১-৪২০।৬. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় ও কল্যাণ চক্রবর্তী (২০০৯) কৃষক পরিবার, দক্ষিণের বারান্দা ১(২):১৪-১৬।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট