অনিন্দিতা মাইতি নন্দী : বর্তমানে আমরা এমন এক ভয়ংকর সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি,যেখানে কোটি কোটি মানুষ কর্মসংস্থানহীন,নিরন্ন,অসহায়। ছেলের স্কুলের মাইনে দিতে অসহায় বাবা তার কিডনি বিক্রি করে, – তিন মাসের ছোট্ট বাচ্চাকে, পেটের জ্বালায় মাতা পিতা বিক্রি করে। সকলেই মানসিক এক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে দম বন্ধ করা পরিস্থিতির স্বীকার। এমত অবস্থায় ছাত্র–ছাত্রী, শিক্ষক, ডক্টর, ব্যবসায়ী, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সকলেই এক ভয়ংকর মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন কিন্তু আত্মহত্যা যে কখনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। স্থিতধী হয়ে সমস্যার মোকাবিলা করাই আমাদের একমাত্র পথ,— এই চিন্তা থেকে এ লেখার সৃষ্টি।
জীবন চলমান। নিজস্ব ছন্দে সে প্রতিনিয়ত ধেয়ে চলে। জীবনের প্রতি পদেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রায় প্রত্যেককে। সেই সমস্যার সঠিক সমাধান করতে হয় আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে। জীবনে আঘাত আসে, দুঃখ, অপমান, বঞ্চনা, অনাদর, অবহেলা, অপবাদ— সব এক এক করে আসে, অন্ধকার কুয়াশাময় করালগ্রাস ভয় ঘিরে ধরে সমগ্র চেতনায়, তার থেকে মুক্তির পথ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাকড়সার জালের মতো সমগ্র চেতনা জগৎকে আচ্ছন্ন করে আত্মহত্যার চিন্তা। আসলে ‘আত্মহত্যা’ তো এক প্রকার ‘পলায়নী মনবৃত্তি’। সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার রাস্তা।
‘গীতা’ তে বলা আছে
‘সুখ, দুঃখ, জয়, পরাজয়, লাভ, লোকসান সমান জ্ঞান করে,- যুদ্ধ কর।’
“সুখ দুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ”
আত্মা অবিনশ্বর, যিনি নিত্যস্বরূপ আত্মাকে জানেন, তিনি কাকেই বা মারবেন, কার দ্বারাই বা হত হবেন।
“বেদাবিনাশনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম।
কথং স পুরুষ: পার্থ কং
ঘাতয়তি হস্তি কম।”
হিন্দু ধর্মে আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলা হয়। প্রত্যেকের ইচ্ছা ও কর্ম দিয়ে তার জীবনের নিজস্ব ভবিষ্যত গঠিত হয়, তাই দুঃখ, কষ্ট,আঘাত যাই–ই আসুক না কেন আত্মহত্যা কখনো সমাধান পথ নয়। আসলে কোনও কোনও সময়ে মানসিক অস্থিরতা এমন এক সংকট জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তার ফলে একটি জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হয়,তার মধ্যে অন্যতম আত্মহত্যার প্রবনতা সম্পন্ন মানুষ।
সাধারণত আত্মহত্যার প্রবণতা প্রধানত তিনটি কারণে দেখা যায়–
প্রথমত: যন্ত্রনা দায়ক কঠিন মনোরোগ (বিষন্নতা– Depressive Illness)।
দ্বিতীয়ত: অসহনীয়যন্ত্রনাদায়কদুরারোগ্যশারীরিকব্যাধি।
তৃতীয়ত: দুরূহ সামাজিক পরিস্থিতির ফলে আত্মমর্যাদাহানি ও অসম্মানজনক পরিস্থিতির প্রবল সম্ভাবনা।
সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলেও যখন কোনো চিকিৎসক(ডক্টর) বা বৈজ্ঞানিক আত্মহত্যা করেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে—- কী এমন অদৃশ্য রহস্য রয়ে যায়? যে রহস্যের একেবারেই শেষ পরিণতি অসম্ভব প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বদেরও আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে? আসলে এগুলো কী শুধুই আত্মহত্যা নাকি সুকৌশলে হত্যা করার আর এক ছদ্মনাম আত্মাহুতি বা আত্মহত্যা? সৃজনশীলতার যতগুলি পেশা আছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম জটিল অবস্থান হল বিজ্ঞানীদের।বিজ্ঞানীদের শৃঙ্খলিত হবার ইতিহাস সেই স্মরণাতীত কাল থেকেই। বিজ্ঞানীদের দিয়ে জোর করে বিজ্ঞান বিরোধী কথা বলানোর প্রবল প্রচেষ্টা শুরু হল।বিজ্ঞানীদের পরাধীনতার শৃঙ্খল ঘোচানো মুশকিল। মানব সমাজের কল্যাণ ও অকল্যান সবরকম কাজ করতে বাধ্য হন তাঁরা।
‘ফ্রিত্জ হাবার’ (জার্মান বিজ্ঞানী) কৃষিকাজের উন্নতির জন্য রসায়নিক উদ্ভাবন করে ‘নোবেল পুরস্কার’ ভূষিত হন ,আবার বিধ্বংসী রসায়নিক আবিস্কারের জনক হয়ে বিশ্ববাসীর ঘৃণা অর্জন করেন। বিজ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এরা যতটা লড়াকু, কিন্তু শারীরিক,মানসিক সন্ত্রাসের কবলে এর ততটাই অসহায়। কী অপরিসীম মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীদের যেতে হয় তা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোঝার বাইরে। বিশেষ করে সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা কোন ক্ষণজন্মা বিজ্ঞান সাধক প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত, অপমানিত, অপবাদ, আত্মসম্মান হানিকর পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হন। যদি তিনি প্রতিবাদী বা নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তবে? নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড বা হত্যা কিংবা আত্মহত্যা অবধারিত ভাগ্য লিখন।
ইতিহাস ঘাটলে মোটামুটিভাবে দুটি পর্যায়কাল পাওয়া যায়,– প্রাক শিল্প বিপ্লবকাল এবং পরিসর শিল্প বিপ্লবত্তোর পর্ব। প্রাক শিল্প বিপ্লব কালে বিজ্ঞানীদের সরাসরি বিরোধ ছিল ধর্মের সাথে। আবার সূর্য কেন্দ্রিক পৃথিবী নাকি পৃথিবী কেন্দ্রিক সূর্য এই দুই মতবাদের বিবাদে জড়িয়ে প্রাণ হারান বহু বিজ্ঞানী,– আলেকজান্দ্রীয়ার হাইপাসিয়া (হত্যা) রজার বেকন, মাইকেল সারভেটার(জীবন্ত দগ্ধ), জিওর্দানো ব্রুনো(হত্যা– জীবন্ত পড়ানো), লুসিলীও ভ্যানিনি (জীব কাটা ও শ্বাসরোধ করে হত্যা), গ্যালিলিও গ্যালিলি, লরেন্ট ডি ল্যভয়সিয়র (মুণ্ডচ্ছেদ–রসায়ন বিজ্ঞানী।
আবার পরিসর শিল্প বিপ্লবত্তোর পর্বে বিজ্ঞানীদের অবস্থা আরও মারাত্বক। এখানে ওনাদের সম্পুর্ন নির্ভর করতে হয় প্রতিষ্ঠানের উপর। প্রাতিষ্ঠানিক নির্ভরতার ফল স্বরূপ গবেষণা করতে হয় প্রতিষ্ঠান নির্দেশিত বিষয়ভিত্তিক। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়,– বিজ্ঞানীকে শৃঙ্খলিত হতে হবেই। যে জ্যাকিলন-B (সায়ানাইড বিষ) দিয়ে হিটলার লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন তার আবিস্কারক ‘হাবার’ এর নিকটজনেরা সেই হতভাগ্য নিহতদের মধ্যে ছিলেন।ইহুদি বিজ্ঞানীদের বানাতে হবে ভয়ানক মারণস্ত্র তাঁদেরই মাতৃভূমিকে আক্রমণ করার জন্য।
আবার ভারতবর্ষেও বহু বৈজ্ঞানিকের হত্যা বা আত্মহত্যা বা রহস্যজনক মৃত্যু সংখ্যাও কম নয়। ১৯৬৬ সালে পরমাণু বিজ্ঞানের জনক ‘হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা’র মৃত্যু হ্য় এক বিমান দুর্ঘটনায়।তাঁর দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে, নানান ধরনের মতবাদ রয়েছে। আবার পরমাণু বিজ্ঞানী লোকনাথন মহালিঙ্গনের দেহ মৃত্যুর পাঁচদিন পর নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। ‘মহাদেবন পদ্মনাভন আইয়ার’ এর মৃতদেহ তাঁর বাড়িতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী ‘উমা রাও’ ঘুমের অসুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ‘ব্যালিস্টিক জোস’ ও ‘আবিশ শিবম’ দুজনেরই মৃতদেহ উদ্ধার হয় রেল লাইন থেকে।
কিন্তু সবথেকে মারাত্মক একটি আত্মহত্যা ঘটে যায় আমাদের প্রিয় কলকাতা শহরে, ১৯শে জুন, ১৯৮১, আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতবর্ষের প্রথম ‘টেস্টটিউব বেবী’র জনক নিজের বাড়িতে (সাউদার্ন এভিনিউ) সিলিং থেকে ঝুলন্ত অবস্থায সুইসাইড নোটে রেখে গেলেন বার্তা, “I Can’t wait everyday for a heart attack to kill me.” বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক যিনি ভারতে প্রথম এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় ‘টেস্টটিউব বেবী’র জনক সমগ্র বাঙালি–জাতি, সকল ভারতবাসী তথা বিশ্বের সম্পদ ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় কে কেন করতে হল আত্মহত্যা? কেন তার মত প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিক কে আত্মহনণের পথ বেছে নিয়ে লিখে যেতে হয় “হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলাম না”।
আচ্ছা আত্মহত্যা করার সাথে কি জরুরী কালীন হরমোন আড্রিনালিন ক্ষরনের কোন সম্পর্ক আছে? নিশ্চই আছে,—— তবে যে বিজ্ঞানী নিজেই হরমোনের উপর বিভিন্ন কাজ করেছেন তাঁর নিশ্চয় ‘জরুরী কালীন হরমোন’ আড্রিনালিন ক্ষরনের সমস্ত বিষয়ই জানা ছিল। আসলে আমি আমার অক্ষম লেখনীর সাহায্যে এমন এক প্রথিতযশা চিকিৎসক তথা বৈজ্ঞানিক এর চরিত্র অঙ্কণ ও বিশ্লেষণ করতে যাচ্ছি যা আমার ধৃষ্টটা তবু নিজের অক্ষমতার জন্য লজ্জিত হয়েও তাঁকে স্মরণ করছি নিজস্ব চেতনার আলোকে, সমগ্র বাঙালি জাতি তথা ভারতবাসীর হয়ে নতমস্তকে।
বিজ্ঞানী সত্যের পূজারী, তাঁদের বিচরণ ক্ষেত্র বাস্তব জগৎ।সৌন্দর্য্যের পূজারী কবির বিচরণ ক্ষেত্র ভাবলোক। কবিরা যে রূপে মুগ্ধ হন, বিজ্ঞানীরা সেই রূপকে বিশ্লেষণ করে জানতে চান রূপের আড়ালে থাকা রহস্যকে। বৈজ্ঞানিকরা কল্পলোকে বাস করেন না। তাঁদের দায়িত্ব পৃথিবীর কল্যাণ সাধন, মানুষের প্রয়োজনে তাঁদের জ্ঞানকে নিয়োগ করে, সফল প্রয়োগের মাধ্যমে জীবন যাত্রার উন্নতমান, রোগ নিরাময়তা, সমাজ কল্যাণ মূলক কাজে গবেষণা।বিশ্বের পরমসত্য অনুসন্ধান করাই বৈজ্ঞানিকের ধর্ম।
আমাদের ভারতে কিংবা সারা বাংলাতেও বহু দম্পতি সন্তান হীনতায় ভুগতেন, ভোগেনও– চিকিৎসা করেও সন্তানের মুখ দেখা সম্ভবপর হয় না, ফলস্বরূপ নারী জাতিকে ‘বন্ধ্যা’ অভিযোগে সারা জীবন কাঁদতে হয়,– তা শারীরিক ত্রুটি স্ত্রী বা পুরুষ যারই থাকুক, ভুগতে হয় নারীকেই । হইত সেই ‘কান্না’র শব্দ কোথাও গভীর ভাবে হৃদয় তন্ত্রে আঘাত করেছিল মহান ডক্টরকে। তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজ, সাড়া জাগানো ‘IVF’ বা ‘ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেশান’ তাই আশীর্বাদ হয়ে নেমে এসেছিল ‘আগরওয়াল’ পরিবারে, জন্ম নিল ‘কানুপ্রিয়া আগরওয়াল’ বা দুর্গা। ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবী, মাত্র ৬৭দিন আগে পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম টেস্টটিউব বেবী ‘লুইস ব্রাউন’ জন্ম নেন। ‘রবার্ট এডওয়ার্ড’ এর গবেষনার ফসল ‘লুইস ব্রাউন’। তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেও নিজের দেশ ভারতে অপমান, অপবাদ, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, আত্মসম্মান হানির পুরস্কার পান ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সত্যি কি এটা প্রাপ্য ছিল তাঁর? সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এক যুগান্তকারী সৃষ্টিশীল মানুষটির কী এমন অপরাধ ছিল যে তাঁকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হল? সত্যি কি আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন রাস্তাই তাঁর সামনে খোলা ছিল না?
ফিরে দেখা যাক ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ফেলে আসা পথ। বিহারের হাজারিবাগের (ব্রিটিশ ভারত), ১৬ই জানুয়ারী ১৯৩১, মুখোপাধ্যায় পরিবারে যে মঙ্গলশঙ্খধ্বনিতে জন্ম নিলেন এক অসম্ভব প্রতিভাধর যুগান্তকারী সৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন মানবশিশু, হয়ত সেদিনই ভারতের ভাগ্যাকালে মঙ্গলশঙ্খধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে উঠছিল সকল ‘বন্ধ্যা’ নারীর সৌভাগ্যের প্রতীক রূপে। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করার পর কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে গাইনোকোলোজি বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন এবং হেমাঙ্গিনী স্কলারশিপ নিয়ে এম বি বি এস পাশ করেন। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ফিজিওলোজি (শারীরবিদ্যা) বিষয়ে বি এস সি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ ব্যানার্জীর অধীনে প্রজনন শারীরবিদ্যা (Reproductive physiology) নিয়ে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬০ সালে নমিতা দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।এর পর তিনি ইংল্যান্ড পাড়ি দেন এবং সেখানে Clinical Endocrinology Research Institute থেকে অধ্যাপক জন এ. লোরেনের সাথে হরমোন সংক্রান্ত গবেষণা করে এবং লিউটিনাইজিং হরমোনের পরিমাপ নির্ণয়ের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে, দ্বিতীয়বার এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন।
ইঁদুর এবং মনুষ্যতের প্রাণীর উপর হরমোনের প্রভাব বিস্তারক Practical based গবেষণা তাঁকে আরও তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন করে তোলে। এডিনবরা Royal Infirmary তেও তিনি কাজ করেছিলেন। বিদেশে গবেষণা এবং বহু লোভনীয় চাকুরীর প্রস্তাব উপেক্ষা করে কলকাতাতে ফিরে এসে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে শিক্ষকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। গবেষনার প্রতি অদম্য টানের জন্য মূলত গবেষনাতেই বুঁদ হয়ে থাকতেন – যুগান্তকারী একটি বিষয় ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেশন নিয়ে। hcg বা হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন –এর উত্স, কার্যকারিতা এবং প্রভাব ইত্যাদি নিয়েও কাজ করতে থাকেন। hcg –এর উত্স সন্ধানে নতুন দিগন্ত খুলে যায়, নারীদের ক্ষেত্রে প্রজননজনিত সমস্যায় টেস্টস্টেরন হরমোনের প্রয়োগ বিষয়ে অনবদ্য গবেষণা মৌলিকতার ছাপ রেখে যায়। International Conference of Physiological Sciences –এ প্যারিস শহরে ১৯৭৭ সালে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় নারীদের প্রজননগত সমস্যার ক্ষেত্রে যে অসম্ভব মানসিক চাপ ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তার গুরুত্ব নিয়ে নিজের অমূল্য মতামত ব্যক্ত করেন, যা তখনকার সময়ে প্রায় অজ্ঞাত ছিল।
ভারতে নারীদের পরিত্রাতারূপে যাঁদের দেখা যায় সুদূরকাল থেকে —প্রথমজন রাজা রামমোহন রায় –সতীদাহপ্রথা বন্ধ করলেন, দ্বিতীয়জন বিদ্যাসাগর মহাশয় – বিধবাবিবাহ চালু করে এবং বহুবিবাহ প্রথা বন্ধ করে, তৃতীয়জন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী – মেয়েদের শিক্ষাপ্রদান বিস্তারে যাঁর অতুলনীয় অবদান। আর চতুর্থজন হলেন ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। নারীদের সম্মানপ্রাপ্তি এবং দম্পতিদের ঘর ভাঙার হাত থেকে রক্ষার প্রচেষ্টার এমন এক যুগান্তকারী অবদান রাখলেন যা বিস্ময়জনক।এঁদের প্রত্যেকেই সমাজের অসহনীয় অপমান, লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন কিন্তু ডক্টর সুভাষের মতো অপদস্থ,নিগৃহীত, মানসিক নির্যাতনের শিকার হতেহয়নি।
এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা আপন খেয়ালে যে ল্যাবরেটরি তৈরী করেছেন মানব–মানবীর শরীরে তা সবচেয়ে বিস্ময়জনক ল্যাবরেটরি। এক মাতৃজঠোরের মধ্যে ল্যাবরেটরীতে জন্ম নেয় নতুন এক প্রাণ, নতুন এক অঙ্কুর। ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় পেরেছিলেন মাতৃজঠোরের বাইরে তৈরী করতে অন্য এক মাতৃজঠোরের ন্যায় ল্যাবরেটরি যেখানে প্রানের স্পন্দন অঙ্কুরিত হবে। বন্ধ্যা মাতৃজঠোর পাবে মাতৃত্বের স্বাদ। নিঃসন্তান দম্পতি পাবে সন্তানসুখের স্পর্শ। ডাঃ মুখোপাধ্যায় ছিলেন মহাভারতের সেই অর্জুন, যার লক্ষ্য স্থির, মাছের চোখে লক্ষ্যভেদের মতো তিনি IVF(ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেশন) সাধনায় মগ্ন। এবার এল সেই আকাঙ্ক্ষিত সময়, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,– ১৯৭৮ সালের ৩রা অক্টোবর কলকাতায় জন্ম নিল ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা প্রসুত ভারতে IVF পদ্ধতির প্রথম সফল টেস্ট টিউব বেবী ‘দুর্গা’(কানুপ্রিয়া আগরওয়াল), সাথে সহায়তায় ছিলেন ক্রায়োবায়োলজিস্ট ডাঃ সুনীত মুখোপাধ্যায় এবং গায়নোকোলজিস্ট ডাঃ সরোজ কান্তি ভট্টাচার্য। মাত্র ৬৭ দিন আগে ইংল্যাণ্ডে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর প্রথম টেস্টটিউব বেবী ‘লুইস জয় ব্রাউস’ সেই গৌরব লাভ করেছেন R.G. Edwards এবং Patric Steptoe. এমন সময়ে ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন তাঁর নিজস্ব গবেষনায় জন্ম নেওয়া ‘দুর্গা’র কথা। বিস্মিত হল সমগ্র চিকিৎসক মহল। আর আসল গল্পটা শুরু হল এখান থেকেই।
রবার্ট Edwards তাঁর আবিস্কারের পর নোবেল পেলেও ডাঃ মুখোপাধ্যায় নিজের দেশেই পেলেন অবহেলা, অপমান, অপবাদ, মানসিক যন্ত্রনা, লাঞ্ছনা শত অপরাধে অপরাধীর শিরোপা, সাথে প্রবঞ্চকের তকমা। হায়রে ভারতবর্ষ!!! সাধে কি বিশ্বকবি বলেছেন, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান!’ যেকোন আবিস্কারের বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পাবার ছাড়পত্র হল কোন আন্তর্জাতিক জার্নালে বিষয়টি প্রকাশ করা।ফলে সারা বিশ্বের সকলেই ব্যাপারটি জানতে পারেন এবং পুরোকাজের কৃতিত্বটি নিজের অধীনে থাকে। কিন্তু ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে তা হতে দেওয়া হয়নি। কাজটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশে বাধা দেন প্রশাসন।জীবিত অবস্থায় বারবার নিজের সহকর্মীদের দ্বারা অপমানিত হয়েছেন।
সন্তান হীনতার প্রসঙ্গে ‘বন্ধা’ শব্দটিকে যিনি কার্যত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, সেই প্রতিভাধর চিকিৎসক বৈজ্ঞানিক কে ভুল প্রমাণের জন্য যেন নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল চারপাশের মানুষেরা। ফলে বিদেশের জার্নালে নিজের গবেষণাপত্র প্রকাশ, কিংবা বিদেশে কনফারেন্সে যোগ দিতে না পারা, এমনকি তাঁর বিদেশযাত্রার উপরও সম্পুর্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জাপানের একটি বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ তাদের খরচা তে চিকিৎসক বৈজ্ঞানিক সুভাষ কে আমন্ত্রণ জানানো হয় তাঁর আবিস্কার সম্পর্কে বলার জন্য কিন্তু অনুমতি তো তিনি পাননি উপরন্তু বিদেশ যাত্রার ওপর জারি হলো কড়া নিষেধাজ্ঞা। যেখানে এই আবিস্কারের জন্য ‘শিরমনি’ করে তাঁকে রাখা উচিত ছিল, পরিবর্তে পেলেন তাঁর আবিস্কারকে হেও করার জন্য এক ‘তদন্ত কমিটি’। এই কমিটিতে একজন রেডিও ফিজিওলজিস্ট ছিলেন প্রধান। অন্য সদস্যদের মধ্যে একজন গায়নোকলজিস্ট ছিলেন। এই কমিটির সদস্যদের কারুরই আধুনিক প্রজনন বিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণা সম্বন্ধে কোন রকম ধরনা ছিল না ,তার ফল স্বরূপ ‘ভুয়ো গবেষণা’ উপাধি ভূষিত হতে হয় ডাঃ মুখোপাধ্যায়কে।
তৎকালীন সরকার এবং তদন্ত কমিটির লোকজনের মুখে একটাই কথা ছিল, “আমেরিকা যে কাজ করতে পারেনি, সে কাজ কিভাবে কলকাতায় করা সম্ভব হল?” আসলে তারা ভুলেই গেছিলেন রিপ্রোডাক্টিভ ফিজিওলজি ছিল ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষনার ভিত্তি। ডাঃ সুভাষ তার নিজের ছোট ফ্লাটটিকে নিজস্ব মৌলিক চিন্তায় বানিয়ে নিয়েছিলেন ল্যাবরেটরি। ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সহকারী সুনীত মুখোপাধ্যায় পাঁচটি ভ্রূণকে তরল নাইট্রোজেনে ৫৩ দিন ধরে হিমায়িত রাখার পর “বেলা আগরওয়ালের” গর্ভে পর পর তিনদিন তিনটি ভ্রূণ ডাঃ সরোজ ভট্টাচার্যের(গাইনোকলজিস্ট)সহায়তায় সংস্থাপন করেন। যার ফলস্বরূপ ওই আগরওয়াল দম্পতি লাভ করেন ‘দুর্গা’ কে। ইউরোপ বা আমেরিকায় নয় খোদ কলকাতাতে বসেই স্বল্প খরচে এমন উন্নত মানের গবেষনায় সাফল্য লাভ করা, সমাজকে অহেতুক আনুগত্য প্রদর্শন না করা অনমনীয় ,দৃঢ়চেতা যুগান্তকারী আবিস্কারক ডাঃ মুখোপাধ্যায়।
১৯৭৮ সালে ১৮ই নভেম্বর গঠিত তদন্ত কমিটি ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত গবেষণাকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে বলেন, “Everything that Dr. Mukhopadhyay claims is bogus.”–এরপর ঘটনাপ্রবাহ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে,– সহস্র অপরাধে যেন অপরাধী তিনি,– যেন বিশ্বের বড্ড ক্ষতিসাধন করে ফেলেছেন এমন চিকিৎসক বৈজ্ঞানিককে শিরচ্ছেদ না করতে পারলেও বদলির ব্যবস্থা পাকা করে ফেলা হোলো। পরবর্তী দীর্ঘ সময়টা শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন, অপমান, অসম্মান, অপবাদ দিয়ে কলকাতা থেকে প্রথমে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, পড়ে আর জি কর হসপিটালে বদলি করা হল। তাঁর গবেষণাকে সম্পুর্ন স্তব্ধ করে দিতে শেষ বদলি ‘রিজিয়নল ইন্সটিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি’তে। একের পর এক অপমান, অবমাননা তাঁর জন্য বরাদ্দ। চক্ষু বিশেষক বিভাগে ১৯৮১ সালের জুন মাসে ইলেক্ট্রো ফিজিওলজির প্রফেসর হিসাবে বদলি অথচ তাঁর ‘সাবজেক্ট’ এবং দুটি পি. এইচ .ডি ডিগ্রি সম্পুর্ন আলাদা বিষয়ে। এত অবমাননা আর নিতে পারেন নি ডাঃ সুভাষ। ১৯৮১ সালের ১৯শে জুন নিজের ফ্ল্যাটেই সিলিং থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় চিরনিদ্রার দেশে চলে গেলেন, নতুন প্রানের স্পন্দন সৃষ্টির ভারতীয় জনক।
অসীম প্রতিভা সম্পন্ন এই মানুষটির আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল রমাপদ চৌধুরির উপন্যাস ‘অভিমন্যু’ যা পরে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক তপন সিংহ ‘এক ডক্টর কী মউত’ নামে হিন্দী ছবি তৈরি করেন। সেই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ছিল এক ‘ডক্টর’- এর অবিস্মরণীয় ‘লেপ্রোসি’ বা কুষ্ঠ রোগের টিকা আবিষ্কার এবং তাঁর মর্মান্তিক আত্মঘাতি পরিণতি।
আর এখানেই প্রশ্নটা চলে আসে ডাঃ মুখোপাধ্যায়!!! আপনি তো অর্জুন ছিলেন, মাছের চোখ অব্যর্থ লক্ষ্যে ভেদও করেছিলেন, সব্যসাচির মত দু’হাতে দুটি পি. এইচ. ডি ডিগ্রি ছিলো, সমাজ সংসার থেকে ‘বন্ধ্যাত্ব’ শব্দটাকে তুড়ি মেরে চেয়েছিলেন উড়িয়ে দিতে, পেরেছিলেনও। তাহলে কেন ডাঃ সাহেব অর্জুন থেকে মহাভারতের হতভাগ্য ‘কর্ণ’ চরিত্রে পরিণত হলেন? আসলে আপনার সাথে কোনো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন না, তাই অর্জুন হয়েও আপনাকে হতভাগ্য কর্ণ হতে হোলো, আর আপনার রথের চাকা গ্রাস করে নিল তদানিন্তন সরকারসহ সহকর্মীরা ও তদন্ত কমিটির প্রহসন!!! আপনি ছিলেন সব্যসাচী অর্জুন, তবু চক্রব্যূহের মধ্যে ঢুকে অভিমন্যু হয়ে গেলেন কিভাবে? সপ্তরথীসম চারপাশের শত্রুরা কিভাবে আপনাকে তিল তিল করে হত্যা করল!!! হরমোন নিয়ে গবেষণা করা গবেষক আপনি, জরুরিকালীন হরমোন তো আপনার ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে না!! বিশ্ব সৃষ্টিকর্তার উপরও কলম চালিয়ে মাতৃ জঠোরের বাইরে প্রাণ সৃষ্টি, অঙ্কুরোদগম করেন যে প্রতিভায় – তাঁর তো নিজের প্রাণ এভাবে দেওয়া চলে না!! আপনি নারীসমাজের কান্না শুনেছিলেন, তাঁদের যন্ত্রনাকে মুক্তি দেওয়ার অগ্রদূত ছিলেন আপনি, বড্ড অসময়ে নিজের প্রাণকে এভাবে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দিলেন কেন?
সমাজ দেরিতে হলেও তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে বিজ্ঞানী টি. সি. আনন্দকুমারের হাত ধরে, আনন্দকুমার স্বীকৃতি দেন তিনি নন, ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় হলেন ভারতীয় টেস্টটিউব বেবীর জনক। কিন্তু যে প্রশ্নটা আজও কুরে কুরে খায়—-আত্মহত্যা ছাড়া আর কী সত্যি কোন রাস্তা ছিল না? তখনি বিদ্যুত্চমকের মতো মনে হয়, আপনি অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে নিজেকে শেষ করেছিলেন, এটা জেনেও যে আত্মহত্যা কখনোই কোন সমাধান হতে পারে না। তবু কারণ হিসেবে আমার অনুভূতি,—- সমগ্র ভারতবাসীকে বোধ হয় এটা উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন ‘ওহে অজ্ঞ জনেরা, তোমরা বিজ্ঞানীকে হত্যা করতে পারো, কিন্তু বিজ্ঞানকে নয়।’
রচনাসূত্র (Reference):
১)মনের বিকাশ ও প্রতিকার,ধীরেন্দ্রনাথনন্দী
২)সমাজকল্যাণে বিজ্ঞান,শ্রী বসন্তকুমার মুখোপাধ্যায়
৩)আজকের বাঙালি বিজ্ঞানীদের মানসিক সংকট আমার চোখে, আলোকময় দত্ত
৪)শৃঙ্খলিত বিজ্ঞানী,শঙ্করঘটক
৫)ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়,রাজদীপ ভট্টাচার্য
৬)সুভাষ মুখোপাধ্যায় অভিমানী এক বিজ্ঞানীর গল্প,Roar Media
৭)এন আর এসের এক বিখ্যাত চিকিত্সকের মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক রয়েছে আজ,শঙ্করঘটক
৮)ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়,উইকিপিডিয়া
৯)ভারতে প্রথম টেস্টটিউব বেবীর নাম,বঙ্গদর্শন
১০)ছবিঃ আন্তর্জাল (Internet)