তিন হাজার কোটি টাকা। মানে ৩০,০০০,০০০,০০০ টাকা। ঠিক কী কী হয় তিন হাজার কোটি টাকায়? ধরা যাক আপনি শ্যামবাজার ক্রসিংয়ে। শতচ্ছিন্ন নাকে-সর্দি বাচ্চাটা এসে ঝুলে পড়ল, কাকু দুটো পয়সা দাও। আপনি খানিক মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন পারলেন না, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী করবি? উত্তর এল, ভাত কিনে খাব। অমনি আপনি ক্যাঁক করে চেপে ধরলেন। ইয়ার্কি পায়া হ্যায়? খাবার নামে অন্য ধান্দা! চল দেখি কোথায় ভাত পাওয়া যায়। তোকে বসিয়ে খাওয়াবো। যাস কোথায় বাছাধন? পাশের এঁদো গলিটা ঘুরেই বেঞ্চিপাতা একটা দোকানে হাঁক দিলেন, একটা সবজি ভাত দিন তো দাদা। তাড়াতাড়ি। আর ওমা, হাভাতের মতো গিলতে লাগল ছেলেটা ! এক্কেবারে হাভাতের মতো ! আপনাকে লুকিয়ে দোকানদারটা এক পিস মাছের টুকরোও তুলে দিল পাতে। আপনি আড়চোখে দেখলেন। মগের জলের ছলাৎছল পেরিয়ে প্যান্টের পেছনে হাত মুছে কালো কালো দাঁত বের করে যখন ঢিপ করে পেন্নাম করল ছোঁড়াটা, আর আপনি লংহর্নের ওয়ালেট থেকে তিরিশটা টাকা বের করলেন, অমনি দোকানদার আপনার হাতদুটো ধরে বলল, দাদা, কুড়ি টাকা দিন, মাছটা আমিই দিলাম। বেশ। আপনি আত্ম্ভরিতার ঢেকুর তুলে গাড়ির সীটে মাথা এলিয়ে দিলেন। হালকা এসিতে তন্দ্রা এসেছে সবে। আধোঘুমে কে যেন হঠাৎ বলে উঠল, তিন হাজার কোটি টাকা ! ঐ তিন হাজার কোটি টাকায় এরকম হাকুচ্ছিত হাড়হাভাতে ১৫০ কোটি ছেলেমেয়েকে একবেলা পেটপুরে খাওয়ানো যেত ! ১৫০ কোটি জনকে ! আরে মোলো যা ! বড্ড জ্বালাতন করছে মাছিটা !
কিংবা ধরুন আপনার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর খানিক বাতিক আছে। জঙ্গলমহল বা অযোধ্যার কোলে গাঁয়ে গাঁয়ে চলে যান কখনো। শাল-মহুয়ার দেশে। আপনার পায়ের তলায় আলতো আলতো ভাঙে শুকনো পাতার সারি। পাশে পাশে হাঁটে পাহাড়ী নদী তিরতির। আর আগুনরঙা পলাশ কৃষ্ণচূড়া রাঙিয়ে থাকে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। ঊষর টাঁড় মাটির বুকে ভূমিপুত্ররা আখ-টম্যাটো ফলায়। টম্যাটো বেচে পঞ্চাশ পয়সা কিলো। হ্যাঁ, পঞ্চাশ পয়সা ! মুখ্যুগুলো জানেও না ওদের বেচে দেওয়া টম্যাটো আপনি — আপনারা কেনেন কুড়ি টাকায়। মানিকতলা-ফুলবাগানে স্করপিও থামিয়ে। তা ধরা যাক আপনারা গুটিকয় বন্ধু তাদের মাঝে করেন মেডিক্যাল ক্যাম্প, একদিন পেটপুরে খিচুড়ি লাবড়া খাওয়ান, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার উৎসাহ জোগাতে হাতে তুলে দেন খাতা-পেন। মেডিক্যাল ক্যাম্পটা আপনার চিকিৎসক বন্ধুদের নীরব সেবা। দিনের শেষে আপনি যখন খতিয়ান নিয়ে বসেন, দেখেন খরচ হয়েছে সাকুল্যে হাজার পনেরো-কুড়ি। আর আপনি মাটির ভাঁড়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে চমকে ওঠেন। তিন হাজার কোটি টাকা ! এই তিন হাজার কোটিতে তো এরকম পনেরো লক্ষ আদিবাসী গ্রামকে সেবা করা যেত ! আর আপনার পায়ের তলায় টলে ওঠে মাটি ! কে জানে প্রেসারটা বাড়ল কিনা !
বাড়বেই। যা চাপ নিচ্ছেন ! তারচে’ বরং চলুন মানভূমের ছোট্ট একটা গ্রামে। যেখানে কোনো কোনো দেবী, কোনো কোনো দেবতার বাস। সেইসব দেবদেবীরা তৈরি করেছেন গুটিকয় স্কুল। প্রবল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে জুটিয়েছেন অর্ধউলঙ্গ বাচ্চাগুলোকে। হামদের ছিলাগুলান পেন্দাই লিখাপঢ়া শিখ্যে কী কইরবেক গ ! বুঝিয়েছেন অবুঝ মানুষগুলোকে। আর চমকে উঠেছেন এই জেনে যে এই স্বচ্ছ আলোকপাতের যুগেও এমন জায়গা আছে যেখানে প্রাতঃকৃত্য যে এক দৈনন্দিন স্বাস্থ্যকর শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, এটুকু ধারণাও নেই। সেইসব কপর্দকহীন বোধহীন মাড়ভাতভোজী ছেলেপুলেদের জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন অবৈতনিক আবাসিক বিদ্যালয়। সব দায়িত্ব সমেত। ধরা যাক আপনারা কয়জন পথচলতি হাজির হয়ে গেছেন অকুস্থলে। জনসেবার আত্মপ্রসাদবলে জানতে চেয়েছেন প্রয়োজন। উত্তর পেয়েছেন, মাসে হাজার কুড়ি হলে দেড়শো-দুশো বাচ্চার থাকা-খাওয়া-পরা-শিক্ষার সব খরচ চালানো যায়। আর নিমেষে আপনার চোখ চলে গিয়েছে আপনারই খুলে-রাখা পাঁচহাজারী উডল্যান্ডসের জুতোজোড়ার দিকে। চোখ যখন তুললেন, ভিজে গেছে চশমার কাঁচ। বাঁশের খুঁটিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছেন আপনি। আপনার মাথা কাজ করছে অল্পই। তবু হিসেব করে চলেছেন, তিন হাজার কোটি ! তিন হাজার কোটি টাকা মানে এরকম প্রতি দেড়শো-দুশো বাচ্চার দশ হাজারটা স্কুলের এক মাসের যাবতীয় খরচ ! খানিক দূরেই ভেসে আসছে খলবলে শিশুগুলোর কলকাকলি।
কী সব ভ্যাজর ভ্যাজর করছেন মশাই ! এ হল নয়া ভারত। শাইনিং ইন্ডিয়া।তার মাঝে এইসব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট আনলে চলে? বেশ ! তবে খানিক অন্য কথা হোক। সামান্যই। এই ধরুন, ভারতের মঙ্গল অভিযান, মার্স মিশন, যা নিয়ে তদানীন্তন দেশপ্রেমী জনতা রে রে করে উঠেছিল, “ভারতের মতো গরীব দেশে এসব চূড়ান্ত বিলাসিতা”। সেই মার্স মিশন সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল অভাবনীয় কম খরচে এত বড় সাফল্যের পরাকাষ্ঠা হিসেবে। বিশ্ববিজ্ঞানের দরবারে সামান্য হলেও এগিয়ে দিয়েছিল দেশকে। তা সেই মার্স মিশনে কত খরচ হয়েছিল জানেন? সাকুল্যে ৪৫০ কোটি টাকা। এইবার ভাবুন, ঐ তিন হাজার কোটি টাকায় মেরেকেটে এরকম খানছয়েক বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের সফল রূপায়ণ ঘটানো যেত। যার যে-কোনো একটাই ঐ স্ট্যাচুর চেয়ে অনেক অনেক উঁচুতে মাথা তুলে ধরতে পারত দেশের। জানি, আপনি বলবেন, কিছু হচ্ছে তো! যে দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমতে কমতে জি-ডি-পি-র মাত্র ২.৭ শতাংশ (তুলনীয় ডেনমার্ক ৮.৭, নিউজিল্যান্ড ৭.২, সুইডেন ৭.০, জার্মানি ৫.১, মায় চীন ৭.৫ শতাংশ। ছোট দেশগুলো, যাদের ১২-১৩ শতাংশ, তাদের কথা বাদই দিলাম। — তথ্য উইকি), সে দেশে এই ‘কিছু’টা যে কতোখানি, এ আপনি দিব্যি জানেন মশাই ! তা যাকগে। তখন থেকে বড্ড জ্বালাতন করছে মাছিটা !
ও হ্যাঁ, তিন হাজার কোটিতে একটা স্ট্যাচু হয়। একটা অর্থহীন স্ট্যাচু। সে যত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরই হোক না কেন। আদপে অর্থহীন।