আমার হৃদয় রক্ত স্পর্শ করেনি কোনদিন…


শুক্রবার,৩১/০৮/২০১৮
1346

অশোক মজুমদার---

ওপরের লাইনটি একটি কবিতার। কবির নাম ভারাভারা রাও। ভারাভারা শুধু তেলগু ভাষার নয়, গোটা দেশের এক অগ্রগণ্য কবি। গত প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি লিখে চলেছেন। সারা দেশে গরীব, দলিত মানুষের ওপর যেকোন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হওয়াটাই তার অভ্যাস। বহুবার এরজন্য কারাবরণ করেছেন, অভিযুক্ত হয়েছেন নানা মিথ্যা মামলায়, কিন্তু তার অভ্যাস বদলায়নি। মোদী-অমিতদের জমানায় তাকে যে জেলে পোরার চেষ্টা হবে এটা জানা কথা। সেই ঘটনাটাই ঘটলো। অধ্যাপক, লেখক, আইনজীবী, সাংবাদিক, বাগ্মী, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার যারাই তাদের দেশটাকে গোল্লায় পাঠানোর পরিকল্পনায় বাধা দেবেন, তাদের জন্য এই জমানায় অপেক্ষা করছে জেল ও বধ্যভূমি।

ভারাভারা সহ সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, ভার্নান গঞ্জালভেস, অরুণ ফেরেরার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্টতার অভিযোগ এনে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট তাদের বাড়িতেই নজরবন্দি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব কথা আপনাদের সবার জানা। আমি বলবো এক অন্য ভারাভারার কথা। আশির দশকের একেবারে শুরুতে আমি ও আমার বন্ধু রঞ্জন সেন হায়দরাবাদে ভারাভারা রাওয়ের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম। তখন আমরা দুজনেই বিভিন্ন কাগজে ফ্রিলান্স করতাম। রঞ্জন লিখতো, ছবি তুলতাম আমি। গোটা অন্ধ্র তখন সিপিআই এমএলএ পিপলস ওয়ার গ্রুপের লাগাতার অ্যাকশনের সুবাদে রোজই সংবাদের শীর্ষে। চন্দ্রপুলা রেড্ডির নেতৃত্বে পিসিসি সিপিআইএমএলও তখন অন্ধ্রের কয়েকটা পকেটে সক্রিয়। আমরা ঠিক করলাম কিছুদিন অন্ধ্রের ওয়ারেঙ্গল, করিমনগর, আদিলাবাদ, খাম্মাম ও পূর্ব গোদাবরী মাইনস অঞ্চলে ঘুরে কয়েকটা প্রতিবেদন তৈরি করবো। ওপরের জায়গাগুলোর কয়েকটা এখন তেলেঙ্গানায় চলে গেছে। আমাদের কিছু পুরনো যোগাযোগের সূত্রে ভারাভারা রাওয়ের বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়েছিল। কবি, অধ্যাপক, লেখক ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারাভারা তখনই এক পরিচিত নাম।

মানুষটাকে দেখে আমাদের কিঞ্চিৎ আশাভঙ্গ হল। ছোটখাটো চেহারা, খুব কম কথা বলেন কিন্তু যে কথাটা বলেন তার কোন নড়চড় হয়না। শ্রোতাকে সেটা মানতে হয়। একতলা বাড়ি, দুটো ঘরে স্বামী স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন। থাকেন বললে ভুল হবে, তার কোন বিশ্রামের সময় নেই অনবরত লোকজনের আসা যাওয়া লেগেই আছে। কবি হিসেবে তিনি বিখ্যাত কিন্তু কথাবার্তা, কাজকর্মে কোন কবিত্বের লেশ আমরা খুঁজে পাইনি। গানে গদ্দার ও কবিতায় ভারাভারা রাওয়ের নাম তখন অন্ধ্রের ঘরে ঘরে ঘুরছে। কিন্তু তাকে দেখে কিছু বোঝা যায় না। তার সূত্রেই আমাদের গদ্দারের সঙ্গে পরিচয়। খবরের কাগজের ছবিতে দেখলাম তার সব চুল সাদা হয়ে গেছে। তখন তার সব চুল ছিল কালো। আমরাই কী আর আগের মত আছি!

অন্ধ্রে আমরা ছিলাম প্রায় পনেরো দিন। ভূমিহীন কৃষকদের বাড়ি থেকে খনি শ্রমিকদের মহল্লা, হতদরিদ্র আদিবাসীদের গ্রাম, দলিতদের টোলা কোন জায়গাতেই নকশালপন্থী ছাড়া আর অন্য কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব দেখিনি। তারা শুধু আছে শহরে আর জেলা সদরে। চন্দ্রপুলা রেড্ডি, সীতারামাইয়া, মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা বালাগোপালসহ যাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাদের অনেকেই আজ আর নেই। কেউ কেউ মারা গেছেন এনকাউন্টারে। গরীবদের মধ্যে গিয়ে তাদের হকের কথাটা সবচাইতে বেশি জোর দিয়ে নকশালপন্থীদের আগে আর কেউ বলেন নি। সেইজন্য তারাই সবচাইতে বেশি রাষ্ট্রের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন। রাজনীতির ভুল তাদের স্বপ্ন সফল হতে দেয়নি, কিন্তু তাদের আদর্শবাদকে অস্বীকার করা যায় না।

দেশে নকশালপন্থী রাজনীতির প্রভাব এখন বস্তুত নেই বললেই চলে। কিন্তু যে কোন প্রতিবাদীকে মাওবাদী বা উগ্রপন্থী হিসেবে দেগে দেওয়াটাকে শাসকরা বেশ রপ্ত করে নিয়েছেন। ঠিক সেই কারণেই পুনের কাছে মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওতে দলিতদের ওপর সরকারি মদতপুষ্ট উচ্চবর্ণের মানুষদের আক্রমণের প্রতিবাদে যারা সরব হয়েছেন তাদেরকেই মাওবাদী বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হল তারা সবাই ভীমা কোরেগাঁওতে সরকারি মদতপুষ্ট উচ্চবর্ণের সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করেছিলেন। এর আগে কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদদেরও মূলত একই কারণে নকশালপন্থী বলা হয়েছিল।

গোটা দেশের যেখানে আদিবাসী ভূমিপুত্ররা তাদের জল, জমি, জঙ্গলের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন তাদের সবাইকেই দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করার এক অদ্ভুত রাজনীতি শুরু করেছে শাসকদল। আগের শাসকরা যে গরীবদের প্রতি নিজেদের কর্তব্য পালন করেছিলেন তা নয়, কিন্তু মোদী-অমিতরা সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছেন। আদিবাসী ও দলিতদের হয়ে মামলা লড়া আইনজীবীরা তাদের শত্রু, অরণ্য সংরক্ষণ, খনি ও জঙ্গল লুণ্ঠনে বাধা দেওয়ার জন্য পরিবেশ কর্মীরা তাদের শত্রু, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরোধিতা করার জন্য মানবাধিকার কর্মীরা তাদের শত্রু। প্রতিবাদী সবাইয়ের জন্য একটাই বিশেষণ, তারা দেশের শত্রু এবং জাতীয়তাবাদ বিরোধী। মোদী-অমিতরা প্রমাণ করে দিয়েছেন তাদের জাতীয়তাবাদ মানে কর্পোরেট লুণ্ঠনের স্বাধীনতা, আদিবাসীদের জমি লুণ্ঠনের স্বাধীনতা, ডিমনিটাইজেশনের নামে গরীব মানুষের সামান্য সম্বলটুকু কেড়ে নেওয়ার স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বাধীনতা।

এই স্বাধীনতার বাদ সাধতে চাইলেই তার নামে উগ্রপন্থা এবং রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগ আসবে। বলা হবে মাওবাদী বা নকশালপন্থী। দলিত, মুসলমান, খ্রিস্টান, বামপন্থী, পরিবেশ কর্মী, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী যারাই মোদী-অমিতের তুঘলকি ফরমানের বিরোধিতা করবে তাদেরকেই দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। দেশকে ভালবাসার যাবতীয় দায়িত্ব যেন শুধু মোদী-অমিতরা নিয়ে নিয়েছেন। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, আজ সকালে দ্য হিন্দু কাগজে দেখলাম অরুন্ধতী রায় লিখেছেন এমারজেন্সি থেকেও খারাপ পরিস্থিতি। এটা যেন দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ। সত্যি মোদী যেন মনে করাচ্ছেন মার্কিন মুলুকের ম্যাকার্থি জমানার কথা। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করাটাই ছিল সেই সময়ের নিয়ম।

এটা নকশালবাড়ির লড়াইয়ের ৫০তম বর্ষ। আর এমন সময়েই মরা বলতে বলতে রাম হয়ে যাওয়ার মত একটা কাণ্ড করে ফেলেছেন মোদীরা। অভিযুক্ত সবাইকে মাওবাদী, নকশালপন্থী বলে চিহ্নিত করে নকশালদের রাজনীতিকে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুললেন তারা। মন্ত্রী মশাইরা যদি ষড়যন্ত্রী মশাই হয়ে যান, যে কোন প্রতিবাদে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজেন তখন এমনটাই ঘটে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতা হাতে পেলে এটাই হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষের কাছে ১৯এর ভোটই এই অবস্থা থেকে মাতৃভুমিকে বাঁচানোর একমাত্র অস্ত্র। তাহলে প্রতিবাদ, সমালোচনা, বিতর্কে আমাদের গণতন্ত্র বেঁচে থাকবে।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট