আহসানুল করিম: আট বছর আগে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এলে, আমার স্ত্রী তার স্কুলের রীনাদির কল্যাণে মেয়েটিকে পায়। রীনাদি আমার সামনেই বলেছিল, “এটাকে রাখ, বাড়ির নাম বুঁচি কাজের বাড়িতে নাম দিয়েছে নীতা। ভালো মেয়ে। ডিসিপ্লিন্ড। একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিস। বাঙালী বাড়িতে আগে কাজ করেনি তো। তবে মোমো টোমো দারুণ বানাতে পারে। আর নর্থ ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্টাল।” রীনাদি চলে গেলে আমার স্ত্রী কাজের লোক খুঁজে পাবার ক্রেডিট নিলেন। আমিও কৃতজ্ঞতা জানালাম। কারণ আমার বেশি পরিচিতি আর মেলামেশা হলেও, কার্যক্ষেত্রে আমি তা কাজে লাগাতে পারি না। নীতা ডিসিপ্লিনড। নীতা ফাস্ট। নীতা দারুণ ডেকোরাম জানে ও মানে।
টিভির দিকে তাকাচ্ছিল না একবারও। তার আন্টি দারুণ শিক্ষিকা। তার নির্দেশে কাজ করে চলে গেল। পরদিন সকালে নীতা আর আসে না। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো এই নতুন পাড়ায়। আমি তার বাড়ি গেলাম খোঁজ নিতে। বস্তি বাড়ি। এ কী বাড়ি! না গুহা! সেই গুহার ভেতরে প্লাস্টিকের ভরা ভরা বস্তা সব। বড় বড় বোঁচকা। পাশের দোকানের বৌটি বললো, “শুনলাম আপনারা ওকে কাজ দিয়েছেন? জনম দু:খিনী মেয়েটা। ছোটবেলা বাবাকে হারায়। ওর বাবা তো ঐ হিমুল কেটেল ফীডে ক্যাজুয়াল কাজ করতো। না ওদের খাবার উপায় আছে, না আছে শোবার ব্যবস্থা। আপনারা ওর সহায় হোন। বুঁচি, এ বুঁচি, দেখ্ বাসাবাড়ি সে বাবু আয়া হ্যায়।” নীতার ধুম জ্বর।
আমি সেই অবস্থায় ওকে কোনওরকমের জবাবদিহি না চেয়ে, তুতোভাই ড.সোহাগকে ফোন করে ওষুধ কিনে দিই, পাউরুটি কিনে দিই। ওর বুড়ো অথর্ব মাকে জিগেস করি, বলুন আর কিছু লাগবে? নেহি সাহাব, ঠিক হ্যায় সাহাব। কল সে জায়েগী। সেদিনই নীতা আমার মধ্যে তার লম্বা বাবাকে খুঁজে পেয়েছিল। তারপর থেকে এই আট বছর নীতা আমাদের কাজে আছে। অন্যদের কাজও করে। কিন্তু আমাদেরটা সর্বাগ্রে। এই সাইটের মুন্সি ওম প্রকাশ বলতো, করিমদা আপনি তো সবার নাম দেন সিনেমা থেকে, বুঁচির কী নাম দিলেন? আমি বলেছিলাম নিরুপা রয়। মায়ের রোল করে। সেই থেকে “মেরি মা” বললে পরিচিতজনেরা হয় আমার ভাইঝি জেনিকে বোঝে, নইলে নীতাকে বোঝে। আর নীতার ছোট-বড়োর জ্ঞান খুব কড়া আর মূল্যবোধ খুব উঁচুমানের।
আমার ছেলেকে তাকে ডাকতে হয়, “দিদি, আপ” করে। একদিন একটু এদিক ওদিক করায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপরে তার আন্টি আর ভাই রাজ্যান্তরী হলে, ও আমার একার কাজই করতো। একই মাইনে দিতাম। সবাই যখন জিগেস করতো, কী রে তোর বিয়ে হয়ে গেলে করিমদার কাজ কে করবে? সে বলতো, বিয়ে হয়ে গেলেও বাবার কাজ বন্ধ হবে না। বিয়ে হয়ে গেলেও মেয়ে তার বাবার খেয়াল রাখতে পারবে।
নীতার দাদাটা তেমন কিছুই করে না মন দিয়ে, নেশা ছাড়া। আর তার যে বিবাহিতা ও অভাবী দিদি আছে, সেটা প্রথম থেকেই টের পেতাম। এবং সেই দিদি “মায়া”র প্রতি তার কী যে টান! দিদিটা একেবারেই মাটির মানুষ। এত্তো বিনয়ী, এত্তো ঠান্ডা মানুষ কমই দেখা যায়। সেও এই অ্যাপার্টমেন্টে কাজ করতে আসে। জামাইটি বাইরে বাইরে (পাহাড়ে) মাছ ফেরি করে আর লোকে বলে বাড়ি এলে একটা করে বাচ্চা উপহার দিয়ে যায়।
সেই মেরি মা এখন চেন্নাইতে। তার আন্টি মাঝখানে এসে নিয়ে গেছে। আমার ছেলে মানে তার ভাইও সেখানে। তার বাড়ির লোক কোনোই আপত্তি করে নি। ওদের কাছে আমরা বরাবরই বিশেষ। এবার চেন্নাইতে তার রান্না করা খাবার চব্বিশ দিন ধরে খেয়ে সুস্থ ও সবল হয়ে ফেরার আগে এখানকার রান্নার লোকটিকে বিদেয় করে গেছিলাম। এখন কী হবে? আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকা কাজিন সিস্টার পিঙ্কি তার প্রবাসপত্নীক দাদার জন্য আগেই বুদ্ধি করে রান্নার লোক দেখে রেখেছে আর ঠিকে কাজের জন্য মায়াকে বলে রেখেছে। মায়াকে আরও বলে দিয়েছিল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবি। যাহোক, মায়া ঠিকে কাজ দারুণ করছিল।
কিন্তু আমার বিধি বাম। সে অসুস্থ হয়ে পড়লো আঙ্গুল নিয়ে আর জ্বর নিয়ে। কিন্তু নিজে না আসতে পারলেও সে তার মেয়ে ক্লাস সিক্সে মার্গারেটে পড়া বৈষ্ণবীকে রোজ পাঠায়, যাতে আঙ্কেলের অসুবিধে না হয়। তাছাড়া নিচের টী টেস্টারের অফিসের কাজে অ্যাবসেন্টিজম্ চলে না। পিঙ্কি বলেছিল, ও কি পারবে? ওর মাজা টাজা কিন্তু একদম ভালো না। সেই “বৈষ্ণভী” তবু রোজ আসে। অফিসটা করে দিয়ে। সেও আমাকে ডাকে আঙ্কেল। ভোজপুরি টানে কখনও “আঙ্ক-অল”। আমার ছেলেকে সেও “ভাই” বলে উল্লেখ করে। মাঝে মাঝে জানতে চায় ভাই আর তার মওসি কবে আসবে চেন্নাই থেকে? আমি তাকে বেটা বেটা করে ইন্সট্রাকশান দিই হাল্কা কাজের, কখনও বলি মাকে জিগেস করবি কীভাবে এটা করতে হয়। কাজে সময় যখন দিচ্ছিসই, শিখে রাখিস। তোরই কাজে লাগবে। একদম বাচ্চা বলে মাঝে মাঝে (ডাস্টিং) কাজের শেষে মিস্টি বা ক্যাডবেরি দিই। একদিন বললামও শনিবার করে আমার কাছে অঙ্ক করবি। আমি তোকে অঙ্ক শেখাবো। রান্নার মাসিটা বলে, দাদাকে তোর মা-মাসিও আঙ্কেল বলে, তুইও আঙ্কল বলিস, বেশ বেশ।
সকালে এরা কাজে এলে আমি খুব তাড়াতাড়ি বাংলা নিউজ চ্যানেল সরিয়ে ইংরেজী এনডিটিভি দেখতে থাকি। কারণ গঙ্গারামপুরের এই কামিনী দাস (ওর বর রিক্সা চালায়। বড় মেয়ে গঙ্গারামপুরেই পড়ে।ইলেভেনে।) মাসি ফ্রিজ থেকে জিনিস বের করে কিচেনে যেতে যেতে খবর নিয়ে নানা মন্তব্য করে আর প্রশ্নও করে। বেশিরভাগ দিন কামিনীর কাজ আগে হয়ে যায়। সে নীচে পিঙ্কির ওখানে চলে যায়। বৈষ্ণবীকে আমি তাড়া মারতে থাকি।তার কাজ শেষ হলেই কেবল আমি অফিসে ছুটতে পারি জ্যামের গুঁতো খেতে খেতে।
গতকাল এনডিটিভি ২৪x৭ চলছিল। আসিফা বানোর মুখ দেখাচ্ছিল। করেসপন্ডেন্ট বর্ণনা দিচ্ছিল। নিউজ রীডারের প্রতিবাদের ভাষা শোনা যাচ্ছিল। কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ বারো বছরের বৈষ্ণবী (শিশুশ্রম অপরাধ। কাল থেকে মায়াই আসবে। সে এখন সুস্থ। অনেক কাজ পড়ে আছে তার জন্য)বলে আঙ্ক-অল ক্যা হুয়া ইস লড়কীকা? আমি কী বলবো? আপনি হলে কী বলতেন? কীডন্যাপ টিটন্যাপ বলে চালিয়ে দিলাম আর কী। আর আজ? কামিনী দাসের কাজ শেষ হলে, “দাদা আমি নিচে যাই” বললো। তখন দেখি ডাস্টিং করতে করতে মুখ তুলে বৈষ্ণবী তাকে কিছু বলছে। কী বলে? “থাকতে বলে। দেখেন তো আপনার বোনের অসুবিধা হবে।” হঠাৎ আজই কেন বৈষ্ণবী এ কথা বললো? আমি একা আছি বলে? কাল কী তবে সে এনডিটিভির খবরটা বুঝেছে? বা পরে হিন্দি চ্যানেলে দেখেছে? হয়ত তাই।
হয়ত ফাঁকা ফ্ল্যাটে সে তার “আঙ্ক-অল”কে বিশ্বাস করে না আর। হোক না আঙ্কেলরা তাদের কাছে বিশেষ। পুরুষ হবার অপরাধে আমি লজ্জিত হলাম, মেরি মা। তোমার বোনঝি আজ আমার কাছে নিজেকে আনসেফ মনে করে। আমার নিজের জন্মদাত্রী মাকে জিগেস করতে ইচ্ছে করছে, আম্মা, দুই দিদির পরে যখন আমি “বাবু” হয়ে জন্মেছিলাম তখন তুমি খুশি হয়েছিলে? আজ যে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আম্মা। ছিঃ, ধিক্ এই পুরুষ জন্ম। ধিক্, ধিক্, ধিক্কার! থুঃ! নিজের গায়ে থুতু ছেটাতে ইচ্ছে করছে আমার।মনে হচ্ছে জহরব্রতের আগুণ জ্বালি এই একবিংশ শতাব্দীতে, জাটিঙ্গার পাখির মতো তাতে আত্মাহূতি দিই। ধিক্ পুরুষ জন্ম! ধিক্!