অশোক মজুমদার: মানুষকে ভালবাসা, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা, অন্যের ধর্ম ও মতকে শ্রদ্ধা করতে শেখার প্রথম পাঠটা কিন্তু বাড়ির থেকেই শুরু হয়। বাবা, মা, কাকা, জ্যাঠাদের কাছ থেকে আমরা তা শিখে নিই। এই শিক্ষার কোন নির্দিষ্ট পাঠক্রম নেই, নেই কোন লেকচার বা জ্ঞান দেওয়া, জীবনের নানা ঘটনা ও অভিজ্ঞতার সূত্রটুকু ধরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই তারা তা আমাদের শিখিয়ে দেন।
পাড়া প্রতিবেশীরাও এব্যাপারে একটা বড় ভুমিকা নেন। এসবকিছুই এখন ভীষণ কম, মানুষে মানুষে বিভেদ মাথা তুলছে। আমরা এখন শুধুই নিজের প্রয়োজনে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পটু, কিন্তু কারও সঙ্গেই আমাদের প্রকৃত কোন সংযোগ নেই। তাদের হৃদয়ের কোন খোঁজখবর আমরা রাখি না। ধর্মের নামে যারা বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় সেই বিজেপির মত সংগঠনগুলি এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে শান্ত এলাকাতেও পুঁতে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার মাইন।
ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল আমার। তখন হাওড়ায় থাকি, এক দাদার সঙ্গে পিলখানা এলাকায় গিয়ে পেটপুরে গরুর মাংস খেয়েছিলাম। দাদা সেকথা বাড়িতে বলতে বারণ করেছিল। রাতে পেটে আর কিছু ধরার জায়গা ছিলনা। মা জিজ্ঞেস করলো, কীরে খাবিনা কেন? বললাম, মাংসটাংস খেয়েছি তাই ক্ষিদে নেই। মা’র প্রশ্নের জবাবে গরুর মাংস খাওয়ার কথা বললাম। মা শুধু বললো, জেনে খেয়েছিস নাকি না জেনে খেয়েছিস? কেউ তোকে জোর করেনি তো? বললাম, কেউ জোর করেনি, জেনেই খেয়েছি।
মা আর কিছু বললো না। জোর করেছে শুনলে মা কিন্তু ক্ষেপে যেত। এমনিতে আমাদের বাড়িতে আমার অনেক মুসলমান বন্ধু আসতো। তাদের বাড়িতে ঈদের নেমন্তন্ন কিংবা সত্যপীরের সিন্নি খেতে মা কোনদিন বারণ করেনি। অনেক বছর পেরিয়ে এসে এখন ভাবি বাংলাদেশের এক গণ্ডগ্রামের ক্লাস থ্রি পাশ করা এক মহিলা এত মুক্ত দৃষ্টি পেল কোথা থেকে? কোথা থেকে এল তার সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার এত সহজ বোধ! দেশভাগের যন্ত্রণা, ভিটেমাটি সব ছেড়ে চলে আসাও তার মনে কোন সঙ্কীর্ণতার ছাপ ফেলতে পারেনি। কোন জ্ঞান ছাড়াই নিজের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করার শিক্ষা আমি আমার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। এখন যেন সব অন্যরকম হয়ে গেছে।
দুচোখ খোলা রাখলেই কত কিছু আমরা শিখে নিতে পারি। বেশ কয়েক বছর আগের কথা মৌলালির মোড় দিয়ে যাতায়াত করার সময় মাঝেমধ্যেই এক যুবককে দাড়িয়ে থাকতে দেখতাম। তার বুকে ঝোলানো একটা ছোট পোস্টার, তাতে লেখা ‘ আমার সন্তানকে যেন আমি প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারি, সেটাই হবে বিপ্লব।’ রাজপথে দাঁড়িয়ে একটা একা মানুষ কী গভীর একটা সত্য উচ্চারণ করছে। ভাবলেও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়। আমার মনে হয় প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে সহনশীলতার শিক্ষা, বহুত্বকে বরণ করার শিক্ষা, মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা। কিছুদিন আগেই যে শিক্ষা আমরা আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল্লাহ্ রশিদির কাছ থেকে পেয়েছি।
হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা বিনা অপরাধে তার ছেলেকে নৃশংসভাবে খুন করা সত্বেও তিনি কোন বদলার রাজনীতিতে মদত দেন নি। উল্টে বলেছেন, আমার সন্তানের মৃত্যুর বদলা নিতে কারোর ওপর পাল্টা হামলা করা যাবেনা। আর যদি তা হয় তাহলে তিনি আসানসোল থেকে চিরতরে চলে যাবেন। কোন পুলিশ নয়, প্রশাসন নয় এমন মানুষেরাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আসল শক্তি।
তিনি তার সন্তানটিকেও নিশ্চয় এই প্রকৃত শিক্ষাই দিয়েছেন। এটাই একটা মানুষের স্বাভাবিক বোধ। যার জোরেই তিনি বলতে পারেন, এটা আমি বিরাট কিছু করেছি বলে মনে করিনা। মানুষের যা কাজ তাই করেছি। লম্বা চেহারার এই মানুষটা মনুষ্যত্বের গুণেই প্রকৃত অর্থে দীর্ঘকায় হয়ে ওঠেন। সারা পৃথিবী জুড়েই ধর্মান্ধ, দাঙ্গাবাজ বলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে প্রচার চলছে নুরানি মসজিদের এই ইমাম হয়ে ওঠেন তার বিরুদ্ধে এক জীবন্ত প্রতিবাদ। নিজেই হয়ে ওঠেন এক দৃষ্টান্ত। তিনি মানুষকে দেন প্রকৃত সংযম ও সহনশীলতার শিক্ষা। এক চিলতে ঘরে থাকা এই মানুষটি মনের সম্পদে অনেক ধনী।
ইমামের মত মানুষেরাই আজকের অন্ধকার সময় একটা রূপোলী রেখা। এই রেখা অনুসরণ করেই আমাদের চলতে হবে। তাদের কাছ থেকে নিতে হবে সাম্প্রদায়িকতাকে রোখার পাঠ। এরাই বিভেদপন্থাকে রুখে মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখেন। এদের জোরেই ডুবেও আবার উঠে আসবো আমরা। আমার মনে পড়ছে শ্রীজাত’র লেখা একটি কবিতা “ রাতে যাকে হত্যা করো, সকালে সে বেঁচে/ ডুবলে উঠতেই হয়, সূর্য শিখিয়েছে।”