বিকাশ সাহাঃ শীত পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায় উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জের পুতুল নাচ শিল্পীদের। মনোরঞ্জনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রামবাংলায় দাপিয়ে বেড়ানো পুতুল নাচ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জাঁতাকলে পরে ঘরে ঘরে বোকা বাক্সের দৌলতে কাঠ পুতুল নাচ আজ ইতিহাসে পরিনত হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভিন রাজ্য দাপিয়ে বেড়ানো পুতুল নাচ শিল্পীরা আজ অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। একসময় গ্রামগঞ্জের যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে আবাল বৃদ্ধ বনিতার মনোরঞ্জনের প্রধান উৎস ছিল পুতুল নাচ। উৎসব অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভিন রাজ্যের গ্রামগঞ্জে ঘাঁটি গেঁড়ে কাঠ পুতুল নাচ দেখাতেন কালিয়াগঞ্জের ‘’ নিউ দাদা ভাই’’ পুতুল নাচের দল। কালিয়াগঞ্জ শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দুরে সন্ধান মিললো একদা পুতুল নাচের জন্য বিখ্যাত ২ নম্বর ধনকৈল গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বালাস গ্রামের । যারা এক সময় পশ্চিমবঙ্গ সহ ভিন রাজ্যে কাঠ পুতুল নাচ দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতেন, পুতুল গুলিকে সযত্নে রাখতেন, যাতে পুতুলের মুখের রং সহ জামা কাপড় নোংরা না হয়। আজ সেই সকল পুতুলগুলো শিল্পীদের মাটির ঘরের এক কোনে পড়ে রয়েছে অনাদরে অযত্নে। আগে সরকারী প্রচার মূলক কাজে কাঠ পুতুল নাচ প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ছিল। কিন্তু শিল্পীদের আক্ষেপ সরকারী প্রচার মূলক কাজে পুতুল নাচ দেখাতে তাঁদের আর ডাকা হয়না।
পুতুল নাচ শিল্পী লোলিত সরকার, হরগোবিন্দ দেবশর্মারা বিগত দিনের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে জানান, একসময় আমাদের রুজি রোজগারের অন্যতম পথ ছিল পুতুল নাচ খেলা দেখানো। আমরা নিজের হাতে কাঠের গুড়ি কেটে তা দিয়ে পুরুষ ও মহিলা সহ বিভিন্ন পশু পাখির কাঠের পুতুল বানাতাম। সেই পুতুল গুলিকে বিভিন্ন পালাতে বিভিন্ন সাঁজে কখনও রাজা তো আবার কখনও চাষি সাজানো হতো। পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাথে বিহার সহ অন্যান্য রাজ্যে গিয়ে আমরা সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিয়ে বেড়াতাম। সেই সময় পুতুল নাচ দেখতে প্রচুর সাধারণ মানুষ ভীড় জমাত। কখনও কখনও এতো ভীড় হতো যে, আমরা তাঁদের বসার জায়গা দিতে পাড়তাম না। মাস গেলে যা উপার্জন হতো তা দিয়ে দিব্যি সংসার চলে যেত। শকুন্তলা, ভক্ত প্রহ্লাদ, রাজা হরিশচন্দ্র, লাইলামজনু সহ একাধিক হাসি, রোমান্সের সঙ্গে সঙ্গে চোখে জল আসা পালা দেখে মানুষ অভিভূত হত। জেলা তথা রাজ্যের ঊর্ধ্বশিখরে পৌঁছে যাওয়া আমাদের পুতুল নাচ রাশিয়া যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলো। বাড়ির লোকেরা আমাদের এতো দুরে যেতে না দেওয়ায় সে যাত্রায় আমাদের বিদেশ যাওয়া বানচাল হয়ে যায়। টেলিভিশন ও সিডি গ্রামগঞ্জে ঢোকার পর থেকেই মানুষের পুতুল নাচ দেখার প্রতি ঝোঁক একেবারে কমে গেছে। টাকা দিয়ে পুতুল নাচ না দেখে তাঁরা গ্রামগঞ্জে সিডি এনে প্রায় বিনা পয়সায় সিনেমা দেখতে শুরু করল। পুতুল নাচে দিন দিন ভিড় কমতে থাকলে আমরা বাধ্য হয়ে তা বন্ধ করে দিই। এখন আমরা লোকের জমিতে লেবারের কাজ করি। কেউবা নিজের সামান্য জমি চাষ করে সংসার চালায়। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধোপাধ্যায় গ্রামগঞ্জের শিল্প সংস্কৃতিকে সকলের সামনে তুলে ধরতে ও শিল্পীদের সাহায্যের ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি যদি আমাদের উপর পড়ে তাহলে আমরা আগামী দিনে নতুন করে পুতুল নাচ শিল্পকে সকলের সামনে তুলে ধরতে পাড়বো। পেশার সাথে সাথে মানুষকে আনন্দ দেওয়া ছিল আমাদের কাজ। দীর্ঘদিন ধরে তা করতে না পেরে আমরা খুবই দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।
আশির দশকে তৈরী হওয়া “নিউ দাদাভাই” পুতুল নাচের ১২ জনের দল ২০ থেকে ২৫ টি পুতুল নিয়ে খেলা দেখিয়ে গ্রামগঞ্জ মাতিয়ে দিতেন। মূলত ছাতিম গাছের গুড়ি দিয়ে পুরুষ, মহিলা সহ বিভিন্ন পশু পাখির অবিকল মূর্তি বানিয়ে ফেলতেন হরগোবিন্দ বাবু। সুতার টানে জীবন্ত হয়ে উঠত কাঠের পুতুলগুলি। বাজনার তালে গান গেয়ে মঞ্চ মাতাতেন লোলিত বাবু। আজ সবই অতিত। ঘুন ধরেছে ছাতিম কাঠে। পোকা ধরেছে মূর্তিতে। দশ বছর ধরে একটু একটু করে খেতে খেতে নষ্ট হয়েছে পুতুলগুলী। সব শেষের মাঝেই এখনও টিকে থাকা পুরুষ ও নারীর দুটি কাঠের পুতুল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
শীত পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায় কালিয়াগঞ্জের পুতুল নাচ শিল্পীদের
রবিবার,২৭/১২/২০১৫
1232