বিকাশ সাহাঃ নিজ পড়িবারের সাথে না থেকেও ভাই ফোঁটার আনন্দে মেতে উঠলো রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ায় অবস্থিত সূর্যদয় মূক ও বধির বিদ্যালয়ের আবাসিকরা। ওদের বাড়ির খবর কেউ জানেনা। বছর কয়েক আগে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু এদিন শুক্রবার সূর্যদয় হোমে তাঁদের দেখে তাঁদের মনের দুঃখ, বেদনা বোঝার উপায় ছিলনা। এদিন সূর্যটা যেন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্য রকম ভোরের রোদ ছড়িয়ে দিয়ে ছিল ওদের জানালায় । জানিয়ে দিয়েছিল আজ ভাইফোঁটা। তাই পশ্চিমবঙ্গ সমাজ কল্যাণ দফতরের অধীন উত্তর দিনাজপুর জেলার সূর্যদয় হোমের আবাসিকদের আজ সকাল থেকেই দম ফেলার ফুরসত ছিলনা। একদমই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। কিন্তু তাঁদের মধ্যে উৎসাহে কোন ভাঁটা নেই। ভোর বেলা উঠে পূজা, মৌলী, চামেলি, সুচিত্রা সবাই মিলে কাজে নেমে পড়েছে। রাতের শিশির ধরে রাখার জন্য বাটি গুলি রাখা হয়েছিল মুক্ত আকাশের নীচে। সেগুলি তুলে নিতে হবে। গোটা বারান্দা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করার পর তাঁরাই মুছে নিলো। এরপর আলপনা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে তুললো বারান্দা। ভাইদেরও উৎসাহে অন্ত নেই। কেউ বলেনি তবুও এদিন খুব ভোরে ওঠে ছোট্ট আকাশ, উদিত, মন্টু, চন্দ্রকান্তরা একগাদা শিউলি ফুল কুড়িয়েছে। রাত থেকেই তারা শুনছে কাল সকালে এই হোমে একটা অনুষ্ঠান হবে। তাদের থেকে যারা একটু বড়ো তাঁরা আবার রঙ্গিন কাগজ কেটে কাগজের শিকল ও বাহারী ফুল তৈরি করেছে। তাই দিয়ে সাত সকালে এরা সবাই গোটা বারান্দা সাজিয়ে দিল। আর যেন তর সই ছিল না তাদের । বারবার অধ্যক্ষের ঘরে উকি দিয়ে যাচ্ছিল মৌলী, চামেলি, সুচিত্রা, পুজারা। হাত নেরে চোখমুখের প্রকাশের সাথে সাথে কপালে হাত দিয়ে বারবার বলছিল ফোঁটা দেব। ভাইফোঁটার জন্য মিষ্টি সহ বাকি সব কিছুর আয়োজনে সামিল হয়েছিলেন সূর্যদয় হোমের অধ্যক্ষ, শিক্ষক সহ হোমের কর্মীরা। ফোঁটা দেওয়ার সময় হতেই হোমের বারান্দায় শতরঞ্চি পেতে সার বেধে বসে পড়লো ছোট্ট উদিত, চন্দ্রকান্ত, মন্টু, আকাশরা। তাদের সামনে হাতে থালায় ধান, দূর্বা, চন্দন, প্রদীপ ও মিষ্টি নিয়ে বসে পড়েছে বোনেরা । সূর্যদয় হোমের মুখ ও বধির ২১ জন বোন মিলে ৩৫ জন ভাইকে ফোঁটা দিল। বোনেরা ভাইদের সামনে তিনবার থালা ঘুরিয়ে মাথায় শিশির, দই, চন্দন আর কাজলের ফোঁটা পড়িয়ে দিয়ে প্রদীপের উষ্ণতা ছুঁইয়ে দিতে থাকে। এরপর ভাইদের মিষ্টি মুখ করায় বোনেরা। এদিকে রায়গঞ্জের দেবীনগরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনশিক্ষা দপ্তর নিয়ন্ত্রিত আবাসিক হোম “শিশু সদন”, সেখানেও হোমের আবাসিকদের মধ্যে ভাইফোঁটার আয়োজন করা হয়।
সূর্যদয় হোম ও শিশু সদনের আবাসিকরা ভাইফোঁটার মধ্য দিয়ে গোটাদিন আনন্দে মেতে ছিল। তারা জানায় ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান পালন করে আমাদের খুব ভালো লাগছে। সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আমরা নিজেদের মধ্যে আনন্দে মেতে উঠি।
সূর্যদয় হোমের অধ্যক্ষ পার্থ সারথি দাস বলেন, সূর্যদয় হোমে মুখ ও বধির ছেলে মেয়েরা বসবাস করে। ছেলে ও মেয়ে এখানে একই হোমে থাকে। সেই কারণে ছেলে মেয়েদের মধ্যে এখানে ভাই বোনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই ভাই বোনের সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বোনেরা ভাইদের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ ও স্নেহ ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে আবাসিক ছেলে মেয়েরা। আজকে ভাইফোঁটার দিনে হোমের ছেলে মেয়েরা ধান দূর্বা যোগার করার পাশাপাশি হোমের বারান্দায় সুন্দর সুন্দর আলপনা এঁকেছে । এদিন তাদের মধ্যে উৎসাহের অন্ত ছিলনা। পরিত্যক্ত ছেলে মেয়ে ও ভীষণ দুঃস্থ পরিবারের ছেলে মেয়েরা চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটির মাধ্যমে এখানে আসে। নানা আচার অনুষ্ঠানে আমরা যখন আনন্দ উৎসবে মেতে থাকি তখন কেন সূর্যদয় হোমের আবাসিকরা চুপচাপ হোমের ভিতরে বসে থাকবে। তাই নানা অনুষ্ঠানের সাথে সাথে ভাইফোঁটা পালনের মধ্যে হোমের আবাসিক ছেলে মেয়েদের বুঝিয়ে দেওয়া যে তারা এই সমাজেরই অঙ্গ। এই সমস্ত ছেলে মেয়েদের সমাজের যাবতীয় অধিকার ও মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে ।
রায়গঞ্জের সূর্যদয় হোম ও শিশু সদনের আবাসিকরা ভাইফোঁটায় মেতে উঠলো
শুক্রবার,১৩/১১/২০১৫
684