বিকাশ সাহাঃ উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রাম ও কালিয়াগঞ্জের পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামে মূর্তি পূজার সাথে সাথে গোটা গ্রাম জুড়ে ধন দেবীর আরাধনায় মেতে উঠলো। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রামের বাসিন্দারা সকলে মিলে লক্ষ্মী পূজোর আয়োজন করেছেন। কিন্তু এবছর ধানের ফলন তেমন না হওয়ায় টেনহরি গ্রামের মানুষের ঘরে ধন দেবীর কৃপা কতটা পড়বে তা নিয়ে চিন্তিত গ্রামবাসীরা। অপরদিকে কালিয়াগঞ্জে নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে কষ্টি পাথরের লক্ষ্মী নারায়নের পূজো হয়ে আসছে দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে। এই কষ্টি পাথরের মূর্তির একটি ইতিহাস রয়েছে। ১৯ বছর আগে কালিয়াগঞ্জ ব্লকের ৭ নম্বর ভাণ্ডার গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের একটি জমিতে চাষ করছিলেন কৃষি লেবার নরেশ বর্মণ। গোকুল চন্দ্র বর্মণের জমিতে চাষ করার সময় নরেশ বাবুর লাঙ্গলের ফলায় আটকে যায় একটি পাথর। সঙ্গে সঙ্গে সে কোদাল দিয়ে পাথরটিকে তোলে। পাথরটি জল দিয়ে পরিস্কার করলে দেখা যায় কাল পাথরে খোঁদায় করা লক্ষ্মী নারায়নের মূর্তি। মূর্তি পাওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই সেই গ্রাম থেকে এমনকি দূরদূরান্ত থেকে কয়েক হাজার লোক হাজির হয়ে যায় ঐ মাঠে। এরপর পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের বাসিন্দারা ঐ কাল পাথরের মূর্তিটিকে তাঁদের গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে কালিয়াগঞ্জ থানা, জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা ছুটে আসে। মূর্তিটির পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা যায় সেটি কষ্টি পাথরের মূর্তি। মূর্তিটি লম্বায় প্রায় দের ফিট, চওড়ায় এক ফিট। প্রশাসনের তরফ থেকে মূর্তিটিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হলে গ্রামবাসীদের বাঁধার মুখে পরে প্রশাসনকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। এরপর পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের বাসিন্দারা একটি মন্দির বানিয়ে মূর্তিটির পূজো শুরু করে ১৯ বছর আগে। সারা বছর নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে দু বেলা করে পূজো করলেও কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোর দিনটিতে মহাসমরহে পূজোর আয়োজন করা হয় এখানে। প্রতিবছর গ্রামের মহিলারা বাড়ির লক্ষ্মী পূজো কোনমতো সেরে সন্ধ্যার মধ্যে লক্ষ্মী নারায়ন পূজো মণ্ডপে এসে হাজির হন। পূজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের সমস্ত মহিলারা উপোষ থাকেন। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজো এখানে রাতে হয়।
লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির কমিটির সম্পাদক মনিন্দ্র নাথ রায় বলেন, বছরের প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল ও সন্ধ্যের সময় পূজো করা হয় এখানে। এই লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির খুব জাগ্রত। এখানে কেউ কোন কিছু মানত করলে মা লক্ষ্মী তাঁদের খালি হাতে ফেরান না। তাই গ্রামে বিয়ে, অন্নপ্রাশন হলে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে এসে গ্রামবাসীরা প্রথমে পূজো দিয়ে যান। এই মন্দিরে গোটা বছর ধরে প্রচুর সোনা ও রুপার গহনা দান করেন ভক্তপ্রাণ মানুষ। এই সকল গহনা সযত্নে জমা রাখা হয় লক্ষ্মী মাতার নামে। যার জমিতে এই কষ্টি পাথরের দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে সেই গোকূল চন্দ্র বর্মণ লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তির মন্দির করার জন্য ২ কাঠা জমি দান করেছেন। ১৯ বছর ধরে এই খানেই লক্ষ্মী নারায়ণের পূজো হয়ে আসছে। এই কষ্টি পাথরের মূর্তি পাওয়ার পর প্রশাসন আমাদের কাজ থেকে তা নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো। আমরা গোটা গ্রামের লোক এক হয়ে বলেছিলাম আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে দেব তবুও এই মূর্তিটিকে এখান থেকে নিয়ে যেতে দেবনা। গ্রামবাসীদের চাপে পরে সেদিন প্রশাসনকে খালি হাতে এখান থেকে ফিরে যেতে হয়েছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এখানে লক্ষ্মী নারায়ণ পূজো নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের লক্ষ্মী নারায়ণের পূজোকে কেন্দ্র করে আসে পাশের গ্রাম থেকে কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয় এখানে। এখানে বিশাল মেলা বসার পাশাপাশি তিন দিন তিন রাত ধরে চলে বাউল গানের আসর। জেলা সহ জেলার বাইরে থেকে প্রতিবারের ন্যায় এবারও বেশ কয়েকটি দল বাউল গানে অংশ নেবেন। বাউল গান চলাকালীন সময়ে এখানে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। তিন দিন পর মহাপ্রভুর ভোগ দিয়ে মেলা ভাঙ্গা হয়। এই পূজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দূরদূরান্তের অতিথীরা এসে হাজির হন। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোকে কেন্দ্র করে তিন দিন ধরে আনন্দ উৎসবে মেতে থাকেন বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে শুরু করে কচিকাঁচারা।
কালিয়াগঞ্জের কষ্টি পাথরের লক্ষ্মী নারায়ন পূজা সহ ধনদেবীর আরাধনায় মাতলো গোটা জেলা
সোমবার,২৬/১০/২০১৫
704