বিকাশ সাহাঃ পূজোর দিনে ভূপালপুর রাজ বাড়িতে আর শোনা যায়না কামানের আওয়াজ। কামানের জায়গা পূরণে আগ্নেয় অস্ত্র হিসেবে বন্দুকের গুলি চালানো হয়। উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ ব্লকের বিরঘই গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ভূপালপুর রাজবাড়ি যা লোকমুখে দুর্গাপুর রাজবাড়ি নামে পরিচিত । ইটাহার ব্লকের মহানন্দা নদীর পাড়ে অবস্থিত ছিল চূড়ামন স্টেটের রাজবাড়ি। চূড়ামন স্টেটের রাজা ছিলেন ঘনশ্যাম কুণ্ডু। সময়টা ছিল শেরশার আমল। সেই সময় থেকেই এই চূড়ামন ষ্টেটে পূজো শুরু হয়েছিল। উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা জেলা সহ বিহারের বেশির ভাগ এলাকা চূড়ামন স্টেটের অন্তর্গত ছিল। এরপর মহানন্দা নদী দিয়ে অনেকে জল গড়িয়েছে। শুরু হয়েছিল পাড় ভাঙ্গার খেলা। সেই পাড় ভাঙ্গার খেলায় মহানন্দা গ্রাস করে চূড়ামন স্টেটের রাজবাড়ি। তারপর সেখান থেকে চলে এসে রায়গঞ্জ ব্লকের বিরঘই এলাকায় তৈরি করা হয় ভূপালপুর রাজবাড়ি। ইংরেজ আমলে এই কুণ্ডু পড়িবার রায় চৌধুরী উপাধি পায়। রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর রাজ সিংহাসন একেবারে খালি হয়ে পরে। কারন রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র ভূপাল চন্দ্র রায় চৌধুরী নাবালক ছিলেন। সেই সময় ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন ভূপাল চন্দ্র রায় চৌধুরী। ভূপাল চন্দ্র রায় চৌধুরী বিবাহ করেন পদ্মাবতী রায় চৌধুরীকে। এরপর তিনি তাঁর রাজত্ব ফিরে পান। ভূপাল চন্দ্র রায় চৌধুরীর দুই ছেলে সতি প্রসাদ চন্দ্র রায় চৌধুরীর ও শিব প্রসাদ চন্দ্র রায় চৌধুরী। সতি প্রসাদ চন্দ্র রায় চৌধুরী ও জ্যোতির্ময়ী রায় চৌধুরীর তিন ছেলে ও চার মেয়ে। উৎপল চন্দ্র রায় চৌধুরী, স্বপন চন্দ্র রায় চৌধুরী, দিলীপ চন্দ্র রায় চৌধুরী, মিথিলা কুণ্ডু, জয়শ্রী সাহা, শিবানী সাহা, শুক্লা কুণ্ডু। শিব প্রসাদ রায় চৌধুরী ও মিনতি রায় চৌধুরীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। পার্থ রায় চৌধুরী, সিদ্ধার্ত রায় চৌধুরী, মিতালি রায়, পলি কুণ্ডু চৌধুরী, কাকলি শেঠ। সতি প্রসাদ রায় চৌধুরী ও শিব প্রসাদ রায় চৌধুরী দু বছর জমিদারী চালিয়ে ছিলেন। এরপর জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হওয়ায় তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ একেবারে কমে যায়। বর্তমানে তাঁদের জমি জায়গা রয়েছে মাত্র ৬০ বিঘা। এদিকে দুই ভাই সতি প্রসাদ চন্দ্র রায় চৌধুরী ও শিব প্রসাদ রায় চৌধুরী আলাদা হয়ে মূল রাজবাড়ি সহ দুর্গা মণ্ডপের এলাকা পেয়েছেন শিব প্রসাদ রায় চৌধুরী। অপর দিকে কাছারি বাড়ি এখন সতি প্রসাদ চন্দ্র রায় চৌধুরীর দখলে রয়েছে।
প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো রাজ পরিবারের পূজো চূড়ামন থেকে বিরঘই গ্রামে ৮৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত করেন ভূপাল চন্দ্র রায় চৌধুরীর মা দুর্গাময়ী রায় চৌধুরী। সেই সময় থেকে এই এখানেই পুজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা। সতি প্রসাদ চন্দ্র রায় চৌধুরী ও শিব প্রসাদ রায় চৌধুরী আলাদা হওয়ার কয়েক বছর পর থেকে এই বাড়ির পূজোও ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক বছর শিব প্রসাদ বাবুর মুল রাজবাড়িতে তো পরের বছর সতি প্রসাদ বাবুর অধিনে থাকা কাছারি বাড়িতে দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। এবার দেবী পুজিত হচ্ছেন সতি প্রসাদ বাবুর অধিনে থাকা কাছারি বাড়ির দুর্গা মন্দিরে।
রাজ বাড়ির এই পূজোতে এক সময় গোটা জমিদারী এলাকার লোকজনের সমাগম হতে দেখা যেত। জন্মষ্ঠমির দিন প্রতিমার কাঠামোতে মাটি লাগানো হত। পুজোতে লাগত অনেক রকম মাটি। যেমন হাতির দাঁতের মাটি, ইদুরের গর্তের মাটি, শুকুরের দাঁতের মাটি, সাত পুকুরের মাটি, নদীর এপার ও ওপাড়ের মাটি, কোটের মাটি, পতিতা বাড়ির মাটি। এছাড়াও লাগত কুয়োর জল, সুমুদ্রের জল, শিলের জল, বৃষ্টির,গঙ্গার জল। পূজোর আগে গঙ্গা থেকে ৭০০ থেকে ৮০০ কলস ভর্তি গঙ্গা জল আনা হত নৌকা করে। পুজোর চার দিন কুমারী পূজো ও সদবা পুজো করা হত। রান্না হোত পোলাও ও ঘি ভাত । সেই সঙ্গে ১৯ রকম ভাজা থাকতো। বোয়াল মাছ রান্না করে নবমীর দিন মায়ের ভোগ দেওয়া হত । দশমীর দিন সিদ্ধি বানিয়ে পুজোতে দেওয়া হত। সেই সিদ্ধি সকলকে প্রসাদ হিসেবে খাওয়ানো হত। যারা সিদ্ধি খেতনা তাঁদের গায়ে তা ছিটিয়ে দেওয়ার চল ছিল। পূজোর জন্য ত্রিশ চল্লিশ পদের মিষ্টি, সহ নারুবরু, মোয়া, লুচি পায়েস প্রচুর পরিমানে তৈরি হত। পূজোর প্রতিদিন ২ টা করে পাঁঠা বলি হত। নবমীর দিন মোষ বলি দেওয়া হত । এই চার দিন ধরে মেলা চলার পাশাপাশি চলত যাত্রা গান, গম্ভিরা গান, কবিগান। কিন্তু কখনই এই রাজ বাড়িতে বাইজি প্রবেশ করেনি। সপ্তমির দিন আর সন্ধি পূজোর সময় কামান দাগা হত। দশমীর দিন আগ্নেয় অস্ত্র সহ বাড়ির সমস্ত অস্ত্রের পূজো করা হত।
এখন আর রাজা নেই শুধু আছে রাজার বংশধর আর আছে রাজবাড়ির নামাঙ্কিত ঐতিহ্যবাহী দুর্গা পূজো। জমিদারী প্রথা উঠে যাওয়ার পর থেকেই রাজবাড়ির পুজোতে আগের মত আর জৌলুষ না থাকলেও নিষ্ঠার সঙ্গে এখানে আজও পুজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা।
৩০০ বছরের পুরানো রায়গঞ্জের ভূপালপুর রাজ বাড়ির পূজোতে আর শোনা যায়না কামানের আওয়াজ
শুক্রবার,১৬/১০/২০১৫
1008