বিকাশ সাহাঃ পৌরাণিক যুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবন বধের উদ্দেশ্যে মহাশক্তি সাধনার ব্রত নিয়েছিলেন । রাবণ ছিলেন ত্রিলোক বিজয়ী বীর। ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত রাবণ ছিলেন বিশ্বশ্রবা মণির সন্তান। মহামায়া মহাশক্তির বরপুত্র ও মহাদেবের মানসপুত্র রাবণকে বধ করে শ্রীরামচন্দ্র তাঁর অভীষ্ট পূরণের লক্ষ্যে অকাল বোধন করেছিলেন। সেই সঙ্গে রামচন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল মহামায়া দেবীকে সন্তুষ্ট করা। আর দুই উদ্দেশ্য নিয়েই রামচন্দ্র অকালে দেবীকে আহব্বাণ করেছিলেন। যা অকাল বোধন নামে পরিচিত। রাবণ বধের জন্য অকাল বোধনের আয়োজন করেন স্বয়ং রামচন্দ্র। বাসন্তী পূজা হল কাল- বোধিত পূজা। আর শারদীয়া পূজা হল অকাল পূজা। অকাল কেন? দিন রাত্রির পরিমাপে মানুষ ও দেবতা দের মধ্যে বহু পার্থক্য রয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বারো ঘণ্টা দিন আর বারো ঘণ্টা রাত্রি। কিন্তু দেবতাদের ক্ষেত্রে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি । বাংলা মাসের হিসেবে মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত এই ছয় মাস দেবতাদের দিন ও বাকি ছয় মাস অর্থাৎ শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত দেবতাদের রাত্রি। আমরা দিনে যেমন জেগে থাকি আর রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ি। তেমনই দেবতারাও দিনে জাগ্রত ও রাত্রে নিদ্রিত। যে ছয় মাস দেবতারা জাগ্রত থাকে অর্থাৎ মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত এই সময়কে বলা হয় উত্তরায়ণ এবং যে ছয় মাস দেবতারা নিদ্রিত থাকে অর্থাৎ শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত সময়কে দক্ষিণায়ন বলা হয়। বসন্তকালে বাসন্তী পূজা হয়। বসন্তকাল উত্তরায়ণের মধ্যে পড়ায় এই সময় দেবী জাগ্রত থাকার কারণে এই সময়কার পূজা হল কাল- বোধিত পূজা। আর শরৎকালে হয় শারদীয়া পূজা। শরৎকাল দক্ষিণায়নের মধ্যে পড়ায় এই সময় দেবী নিদ্রিত থাকার কারণে এই সময়কার পূজাকে অকাল পূজা বা অকাল বোধন বলে।
বাসন্তী পূজা করেছিলেন মহারাজা সুরথ আর শারদীয়া পূজা করেছিলেন রামচন্দ্র।
অকালে দেবী পূজা করতে গিয়ে রামচন্দ্র পুরোহিতের খোঁজ করলে ত্রিলোকে কোন পুরোহিতকে খুঁজে পাননি শ্রীরামচন্দ্র। শেষে দেবতাদের পরামর্শে ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত রাবণকে এই পূজা করার অনুরোধ করেন শ্রীরামচন্দ্র। রাবণ বধের জন্য আয়োজন করা হয়েছে এই অকাল পূজা, তা যেনেও নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে একজন নিষ্ঠাবান পুরোহিতের কর্তব্য পালন করতে সম্মত হন ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত রাবণ। মহা সন্ধির সন্ধিক্ষণে অন্ধকারকে আলোকিত করতে ১০৮ টি প্রদীপ জ্বালানোর পাশাপাশি দেবীর চরণে নিবেদন করা হয় ১০৮ টি পদ্ম । মানস সরোবর থেকে নীল পদ্ম আনেন বীর হনুমান । সেই ১০৮ টি নীল পদ্ম দেবীর চরণে নিবেদন করতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে একটি পদ্ম কম রয়েছে। একটি পদ্মের জন্য পূজো বানচাল হতে বসলে শ্রীরামচন্দ্র ধনুরবাণ দিয়ে পদ্মের বদলে তাঁর নীলাভ নয়ন দেবীর চরণে নিবেদন করতে চান। সেই মত ধনুরবাণ তোলা মাত্র দেবী স্বয়ং আবির্ভূত হন। দেবী রামচন্দ্রকে বলেন, আমি তোমার স্তবে সন্তুষ্ট হয়েছি। দেবী ছলনা করে যে পদ্মটি লুকিয়ে রেখেছিল তা ফিরিয়ে দিলে মহাসমারোহে পূজিত হন দেবী দুর্গা । দেবী দুর্গার পুজায় মহাসন্ধিতে সেই সময় থেকে আজও ১০৮ টি পদ্ম দেবীর চরণে নিবেদন করা হয়। কয়েক দশক আগেও দেখা যেত কয়েকটি গ্রামের মানুষেরা মিলে এক সঙ্গে একটি পূজা করতেন। এখন বাড়ির পুজা ও ক্লাবের মিলে এক এক অঞ্চলে বেশ কয়েকটা দুর্গা পুজা হতে দেখা যায়। পূজা যেমন বেড়েছে সেই সঙ্গে চাহিদা বেড়েছে পদ্ম ফুলের। কিন্তু দিন দিন পুজার সংখ্যা বাড়লেও কমছে জলাভুমি। ফলে চাহিদা থাকলেও জোগান নেই পদ্ম ফুলের। ফলে শারদীয়া পূজার সময় পদ্ম ফুলের আকাল দেখা দেয়। দুর্গা পুজার সময় পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাথে উত্তর দিনাজপুর জেলাতেও পদ্মের আকাল দেখা দেয় । তাই জেলা সহ কলকাতা ও বিহারের পুজামণ্ডপ গুলিতে পদ্মের জোগান দিতে পদ্ম ফুলের চাষ শুরু করেছেন উত্তর দিনাজপুর জেলার ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন হেমতাবাদ ব্লকের চৈনগর গ্রামের বাসিন্দারা। চৈনগর গ্রামের বাসিন্দা দিলীপ বর্মণ, রেনুকা বর্মণ, স্বপন বর্মণ, জগদীশ বর্মণের মত আরও আনেক চাষি তাঁদের পুকুরে রমরমিয়ে পদ্ম ফুলের চাষ করছেন । হাতে আর মাত্র কটা দিন তাঁর পরেই মা দেবী দুর্গা মর্তে আবির্ভূত হবেন। মায়ের পায়ে পদ্ম তুলে দিতে পদ্ম ফুল চাষিরা এখন থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও বুক সমান জলে নেমে তাঁরা পুকুরের আগাছা পরিস্কার করছেন। যাতে করে পুজার কদিন আগে পুকুর থেকে পদ্ম ফুল সংগ্রহ করতে কোনও অসুবিধে না হয়। এক একটি পদ্ম ফুল ৬ টাকা থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করে পূজার আগে বড় ধরনের মুনাফা ঘরে তোলেন হেমতাবাদ ব্লকের চৈনগর গ্রামের বাসিন্দারা।
হেমতাবাদ ব্লকের চৈনগর গ্রামের পদ্ম চাষি রেণুকা বর্মণ বলেন, আমাদের পুকুরে পদ্ম চাষ করে পূজার আগে একটা মোটা অঙ্কের টাকা পাই। তা দিয়ে আমরা সংসার চালাই। পূজার ২০ থেকে ২৫ দিন আগে থেকে পদ্ম ফুলের গাছ থেকে আগাছা পরিস্কার করে রাখি। যাতে পূজার সময় পদ্ম ফুল তুলতে কোনও অসুবিধে না হয়।
হেমতাবাদ ব্লকের চৈনগর গ্রামের পদ্ম চাষি দিলীপ বর্মণ বলেন, হেমতাবাদ ব্লকের বেশিরভাগ পুকুরে পদ্ম ফুলের চাষ হচ্ছে। আমরা পুকুরে পদ্ম ফুল চাষ করার সাথে সাথে মাছ চাষও করি। আষাঢ় মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত পদ্ম ফুলের গাছ পুকুরে থাকে। বাকি সময় মাছ ধরার জন্য পুকুরে জাল ফেলা যায়। পদ্ম ফুল শুধু আমদের জেলাতেই নয় কলকাতা সহ অন্যান্য জেলা, এমনকি বিহারেও আমাদের ফুল বিক্রি হয়। এই পদ্ম ফুল চাষে তেমন কোনও খরচ না হলেও আগাছা পরিস্কার করতে হয়, সেই সঙ্গে ফুলে যাতে পোকা না লাগে তাঁর জন্য একবার পোকা মারার বিষ স্প্রে করতে হয়। আমরা পূজার আগে মোটা টাকা পাই পদ্ম ফুল চাষ করে।
কালিয়াগঞ্জ পুরোহিত মঞ্চ ওয়েল ফেয়ার সোসাইটির সভাপতি শ্রী অজিত তলাপাত্র, পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, রাবণ বধের জন্য পূজার আয়োজন করেছিল শ্রী রামচন্দ্র। তা জানা সর্তেও শ্রী রামচন্দ্রের অনুরোধ রেখে পূজা করে একজন নিষ্ঠাবান পুরোহিতের কর্তব্য পালন করেছেন ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত রাবণ। প্রত্যেক পুরোহিতকেই নিষ্ঠাবান পুরোহিতের কর্তব্য পালন করা উচিত। পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে আলোচনায় ছিলেন স্বপন মজুমদার, জয়দীপ চক্রবর্তী, বাসুদেব বন্ধোপাধ্যায়, মলয় চক্রবর্তী, সুব্রত চ্যাটার্জী, প্রশান্ত চক্রবর্তী, রুদ্রদেব বন্ধোপাধ্যায়, কান্তি চক্রবর্তী, তাপস গাঙ্গুলি সহ সংগঠনের আন্যান্য সদস্যরা।
মহামায়া দেবীর চরণে নিবেদিত ১০৮ টি পদ্ম ঃ রায়গঞ্জ
মঙ্গলবার,২২/০৯/২০১৫
1539