পূজোর আগে চরম ব্যাস্ত উত্তর দিনাজপুর জেলার শোলা শিল্পীরা


মঙ্গলবার,১৫/০৯/২০১৫
793

বিকাশ সাহাঃ    বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজা। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সারা বছর ধরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রস্তুতি চালিয়ে যান মৃৎ শিল্পী থেকে শুরু করে মালাকাররা। পুজোর বাকি হাতে গোনা আর কয়েকটা দিন। ফলে এই কদিন নাওয়া খাওয়ার সময় নেই তাঁদের। মৃৎ শিল্পীদের থেকে বেশী ব্যস্ত হয়ে পরেছেন মালাকাররা। তাঁদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরী হয় রকমারী শোলার গয়নার সেট ও ডাকের সাজ। এখনও প্রাচীন বাড়ির পুজোগুলিতে কোথাও কোথাও সোনার গহনা পরানো হলেও বেশির ভাগ প্রতিমার সাজ হিসেবে শোলার গহনার কদর দিন দিন বেড়েছে। প্রতিমার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে শোলার গয়না তাৎপর্য পূর্ণ ভুমিকা গ্রহন করে। বাপ ঠাকুরদার হাত ধরে শোলার গহনা ও ডাকের সাজে হাত পাকিয়েছেন উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জের দক্ষিণ আখানগরের সাহা পাড়ার বাসিন্দা সুনীল মালাকার(৭৫)। বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার শাহাজাদপুর গ্রামে জন্ম সুনীল বাবুর। ১৯৬৭ সালে তাঁর পরিবার সহ তিনি এদেশে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। পিতৃ পুরুষের সময় থেকে আজ পর্যন্ত শোলার কাজ মুলত ডাকের সাজ তৈরি করা এই পরিবারের প্রধান জীবিকা। ডাকের সাজ সম্পর্কে সুনীল বাবু বলেন, শোলার গহনা দিয়ে বাংলাদেশের ঢাকার ঢাকেশ্বরী দেবীকে সাজানো হত। সেই জন্য শোলার এই গহনাকে বলা হত ঢাকের সাজ। যা পরবর্তীতে ডাকের সাজ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ডাকের সাজ সাধারনত দুই ধরনের হয়।একটি শোলার কাজ, অন্যটি জরির কাজ। ডাকের সাজ তৈরি করতে লাগে শোলা ও জরি। মালদা এবং উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার ও টুঙ্গিদিঘীর আড়ত গুলি থেকে শোলা কিনে আনেন সুনীল বাবু ও তাঁর ছেলেরা । এক বান্ডিল শোলার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা। এক একটি শোলা লম্বায় প্রায় এক হাতের মত। ৪ থেকে ৫ টি শোলা দিয়ে তৈরি এক বান্ডিল শোলার দাম নির্ধারণ হয় শোলার গুন মানের উপর। স্বাভাবিক উচ্চতার প্রতিমার ডাকের সাজ তৈরি করতে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকার শোলার প্রয়োজন হয়। প্রতিমার আকৃতি অনুযায়ী ডাকের সাজ তৈরি করতে সব কিছু মিলিয়ে খরচ হয় ২৫০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা। বাড়ির সবাই কাজে হাত লাগালে একটি প্রতিমার সাজ তৈরি করতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। বিভিন্ন উচ্চতার প্রতিমার জন্য জরির সেটের ডাকের সাজ তৈরি করতে খরচ হয় ৩০০০ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা। ডাকের সাজের মধ্যে তিনি তৈরি করেন প্রতিমার মুকুট, আঁচলা, চালি, বুক চেলি, ঘাড় বেণী, কলকা ও কান মোগর প্রভৃতি। এছারাও তিনি শোলার গয়নার মধ্যে তৈরী করেন কানের দুল, মালা, গলার চিক, হাতের বাজু ও ছুড়ি এবং পায়ের নূপুর।
তাঁর এই শোলার কাজের অর্ডার আসে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মৃৎ শিল্পীদের কাছ থেকে। সেই সঙ্গে বিহারের বেশ কিছু এলাকা সহ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নামিদামী ক্লাব গুলি থেকেও পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই তাঁর সাহা পাড়ার বাড়ীতে এসে অর্ডার দিয়ে যান।
ছোট থেকে শোলার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা ৭৫ বছর বয়সী শোলা শিল্পী সুনীল মালাকার এদেশে এসে ৪৫ বছর ধরে শোলার কাজে খ্যাতি অর্জন করলেও আর্থিক অনুদানের ছিটে ফোঁটাও জোটেনি তাঁর কপালে। ফলে এদেশে এসে শোলার কাজকে পেশা করে ৪৫ বছর ধরে সংসার চালাতে গিয়ে বিভিন্ন সময় হোঁচট খেতে হয়েছে তাঁকে। তবুও বাপ ঠাকুরদার পেশাকে আজও তিনি ছাড়তে পারেননি।
শোলা শিল্পী সুনীল বাবু বলেন, শোলা শিল্পে আগে লাভের পরিমান অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে শোলা, চুমকি, সাদা ও রঙ্গিন কাগজ, আঠা, মোম সহ ডাকের সাজ তৈরির যাবতীয় উপকরণের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। ফলে শোলা দিয়ে ডাকের সাজ তৈরি করে তা থেকে শ্রমিকের মজুরী বাদ দিলে লাভের পরিমান কিছুই থাকেনা। সেই কারনে আজ এই পেশায় যুক্ত অনেক শিল্পী এই পেশা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। বর্তমান সময়ে এই পেশায় দক্ষ শ্রমিকের খুব অভাব দেখা দিয়েছে। কোনও সরকারি সাহায্য না মেলার কারনে এই শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারছিনা। ভারতবর্ষের শোলা শিল্প ভারতবর্ষ ছাড়া বিদেশেও বিভিন্ন সময় কদর পেয়েছে। সরকার বড় বড় শিল্পের সাথে সাথে যদি শোলা শিল্পের মত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উপর বিশেষ ভাবে নজর দেয় তা হলে আগামী দিনে নতুন প্রজন্ম এই শিল্পকে পেশা করে এগোতে পারবে। আর তা না হলে এই শোলা শিল্প একসময় ইতিহাসে পরিণত হবে।DSCN8170

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট