আন্দোলনের নামে পুড়ে ছাই বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড “জলের গান”

‘বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি/ শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফোটে লো রাইতে শালুক ফোটে / যার সনে যার ভালোবাসা সেই তো মজা লোটে।’ ইউটিউবে গানটি ‘জলের গান’-এর দলের। ‘জলের গান’ রাহুল আনন্দের দল।


ফেসবুক প্রোফাইল এখনো “লাল” , প্রথম থেকে সমর্থনও ছিল তথা কথিত “ছাত্র আন্দোলনে” , তারপরও গতকাল, ৬ আগস্ট ২০২৪, খবর এল রাহুলের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ধানমণ্ডিতে তাঁদের ১৪০ বছরের পুরোনো বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ৪৮ বছরের রাহুলের সাধনার সংগ্রহ ৩০০০ বাদ‍্যযন্ত্র ।

“স্বপ্নে তুমি দাগ দিও না।
সরলরেখার স্বপ্নে কারো বাঁক দিওনা! বাঁক দিওনা!


জলের গানের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসত বাড়ি ছিলোনা; ছিলো পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সু্র, আর দাদার ভাবনা প্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র। শুধু তাই নয়। জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। দলের সকলের দলগত সংগীত চর্চা থেকে শুরু করে, সকল স্টুডিও ওয়ার্ক – রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হতো।


যারা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তারা জানেন যে রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সবসময় খোলাই থাকতো। তাতে তালা দেয়া হতোনা। যে কেউ, যেকোনো দরকারে যেন দাদার কাছে পৌঁছোতে পারে সেই ভাবনায়। আর যারাই দিনের যেকোন প্রান্তে এই বাড়িতে এসেছেন, সকলেই একটি চিত্রের সাথে খুব পরিচিত, তা হলো- রাহুল আনন্দ মাটিতে বসে একটি সিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে তাঁর নতুন বাদ্যযন্ত্রের কাঠ ঘষছেন।
জলের গানের বাদ্যযন্ত্র। রাহুল আনন্দের বিরাট ভাবনা ও স্বপ্নের দিকে ধাবমান এক নিরন্তর প্রয়াস। আমাদের দেশীয় কাঠে তৈরি, আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্র। শুধুই কি আমাদের? এই দলের? জলের গানের? না! এই প্রয়াস সকল নবীন মিউজিশিয়ানদের জন্য, যারা বিশ্বাস করবে – আমরাও আমাদের বাপ দাদার মতো নিজেদের বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারি! এই প্রয়াস সেই স্বকীয়তার; যার বলে এই দেশের মানুষ গর্বের সাথে বলতে পারে, এই আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্রে বেজে ওঠা অনন্য শব্দতরঙ্গ যা কিনা পুরো পৃথিবীর বুকে কেবল এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঝনঝন করে বাজে, সুর তোলে, স্বপ্ন দেখায়। যেই স্বপ্নের ঝিলিক সুদূর ফ্রান্স থেকে আরেকজন মিউজিশিয়ানকে আমাদের দেশে টেনে আনে। পুরো পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের চোখের আলো পড়ে আমাদের এই দেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের এই বাড়িটিতে।


তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ? যারা ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছেন কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছেন তারা সকলেই খবরটি জানেন।


হ্যাঁ! – রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার, এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন। কিন্তু, রাহুল দা এবং আমাদের দলের সকল বাদ্যযন্ত্র ,গানের নথিপত্র এবং অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও, দাদার পরিবারের খাট-পালং, আলনা আর যাবতীয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! সব! সকলের জন্য নিরন্তর ভেবে যাওয়া মানুষটিকে পরিবারসহ এক কাপড়ে তাঁর নিজ ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব হয়তো আজীবন লালিত থাকবে তাঁর সন্তানের মনে; যার বয়স কিনা মাত্র ১৩ বছর – ভাবতেই কষ্ট হয়। এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন সংসারের সবকিছু দাউদাউ করে জ্বলেছে চোখের সামনে। কিছু মানুষের ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার আগুনে!


এই বাদ্যযন্ত্র, গান বা সাজানো সংসার হয়তো আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে আবার গড়ে নিতে পারবো। কিন্তু, এই ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুনকে নেভাবো কিভাবে! কেন আমরা ভালবাসা আর প্রেম দিয়ে সবকিছু জয় করে নিতে পারি না? যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি, সেই স্বাধীনতার রক্ষায় যদি একইভাবে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হই, তাহলে চরম নিরাশা, অপমান ও লজ্জায় নিজেদের গানই গেয়ে উঠি এক ভগ্ন হৃদয়ে-
“কোন্ ছোবলে স্বপ্ন আমার হলো সাদা কালো?
আমার বসত অন্ধকারে; তোরা থাকিস ভালো!”

হামলার আগের ছবি
হামলার পরের ছবি
হামলার পরের ছবি

সকল প্রাণ ভালো থাকুক। নতুন আগামীর স্বপ্নকে আমরাও অভিবাদন জানাই একইভাবে। কিন্তু, নিজের উল্লাসের চিৎকার এবং সজোর হাততালিতে কারো স্বপ্ন ভেঙে না দেই!


এই গানটি আমাদের এই ঘরে রেকর্ড করা শেষ গান। ভিডিওতে যা দেখছেন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। উত্তাল সময়ের সাথে আমরাও একাত্ম ছিলাম গানে গানে। এই শেষ কাজটিই তবে সকলের জন্য আনন্দ উপহার।


জয়তু
জলের গান

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

বাংলাদেশ : মাথায় রাখতে হবে ঘুমন্ত সব রা*ক্ষস এখন জেগে উঠবে

মুহাম্মদ হোসাইন: একটা বিষয় পরিষ্কার বলে দেই। পাবলিক ভার্সিটির কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সাধারণ জনগনের…

1 month ago

ছেলের হাতে খুন “মা”, ঘটনার জানাজানির পর এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য

ছেলের হাতে মা খুন, প্লাস্টিক মুড়ে বাড়ির মধ্যেই ফেলে রাখলো ছেলে। রাতেই মহিলার রক্তাক্ত দেহ…

2 months ago

AIIFA টেকসই স্টিল উৎপাদক সমিতি কলকাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়োজন করলো

কলকাতা: এআইআইএফএ টেকসই স্টিল উৎপাদক সমিতি, যা সেকেন্ডারি স্টিল শিল্পের অনন্য কণ্ঠস্বর, আজ কলকাতার দ্য…

2 months ago

মগরাহাটে গুলিবিদ্ধ ব্যবসায়ী, ৭ লক্ষ টাকা লুঠ

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মগরাহাটে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে সর্বস্ব লুট করে চম্পট দুষ্কৃতী দলের।…

2 months ago

২১ জুলাইয়ের প্রস্তুতি শুরু, সভাস্থল পরিদর্শনে তৃণমূল নেতারা

শুধু শহীদ স্মরণ নয়, লোকসভা নির্বাচনে বিরাট সাফল্যের পর রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর সমাবেশ। একুশে জুলাই…

2 months ago

সায়ন্তিকা ব্যানার্জির সাথে রাজ্যপালের বিরোধ চরমে

এক মাস একদিন হলো নতুন বিধায়ক হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের দুই বিধায়ক। সায়ন্তিকা ব্যানার্জি ও রিয়াদ…

2 months ago