সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, গ্রীষ্মের তাপদাহে মানুষ, প্রকৃতি যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তখন ধরণীকে শান্ত, শীতল ও শুদ্ধ করতে বর্ষা ঋতু আসে আমাদের মাঝে। খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, ডোবা ধীরে ধীরে ভরে ওঠে নতুন পানির জোয়ারে। গাছপালা ধুয়ে মুছে সবুজ হয়, কদমফুলের মনোহরি সুঘ্রাণ শোভা মাতিয়ে মন ভালো করে দেয় প্রতিটি বাঙালির। কৃষকের মনে দোলা দেয় এমন দিনে কী কী কাজ করা যায়। প্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন বর্ষার তন্ময়তার পর্দা সরিয়ে আসুন আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নেই কৃষির করণীয় ভুবনের আবশ্যকীয় কাজগুলো।
আউশ ধান
আউশ ধানের বাড়ন্ত পর্যায় এখন। এ সময় ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য যত্ন নিতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে হবে। এ মাসে বন্যার সম্ভাবনা এবং প্রকোপ দুটোই বাড়ে। বন্যার আশঙ্কা হলে আগাম রোপণ করা আউশ ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলেই কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
আমন ধান
আমন ধানের বীজতলা তৈরির সময় এখন। পানিতে ডুবে না এমন উঁচু খোলা জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজতলায় বীজ বপন করার আগে ভালো জাতের সুস্থ সবল বীজ নির্বাচন করতে হবে। রোপা আমনের উন্নত জাতগুলো হলো বিআর১০, বিআর২৫, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১। এছাড়া লবণাক্ত জমিতে ব্রি ধান৪৪ চাষ করতে পারেন। এসব মানসম্মত বীজ আপনার কাছে না থাকলে বিএডিসির বীজ বিক্রয় কেন্দ্র, বিশ্বস্ত ডিলার বা অভিজ্ঞ চাষিভাইদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। ভালো চারা পেতে হলে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি গোবর, ১০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
আষাঢ় মাসে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ শুরু করা যায়। অধিক ফলন পেতে হলে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ৯০ কেজি টিএসপি, ৭০ কেজি এমওপি, ১১ কেজি দস্তা এবং ৬০ কেজি জিপসাম দিতে হবে। জমিতে চারা সারি করে রোপণ করতে হবে। এতে ধানক্ষেতের পরবর্তী পরিচর্যা বিশেষ করে আগাছা দমন সহজ হবে।
পাট
পাট গাছের বয়স চার মাস হলে ক্ষেতের পাট গাছ কেটে নিতে হবে। পাট গাছ কাটার পর চিকণ ও মোটা পাট গাছ আলাদা করে আঁটি বেঁধে দুই/তিন দিন দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। এত গাছের পাতা ঝরে যাবে। পাতা ঝরে গেলে ৩/৪দিন পাটগাছগুলোর গোড়া এক ফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর পরিষ্কার পানিতে জাগ দিতে হবে। জাগ দেয়ার পর জাগের উপর কচুরিপানা বা খড় বিছিয়ে দিলে ভালো হয়। জাগ দেয়ার পর নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে যেন পাটের আঁশ খুব বেশি পচে না যায়। পাট পচে গেলে পানিতে আঁটি ভাসিয়ে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পাটের আঁশের গুণাগুণ ভালো থাকবে। ছাড়ানো আঁশ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাঁশের আড়ে শুকাতে হবে।
যেসব জায়গায় জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে পাট কাটার সাথে সাথে ছালকরণ করতে হবে, তা না হলে পরবর্তীতে রৌদ্রে পাট গাছ শুকিয়ে গেলে ছালকরণে সমস্যা হবে।
চাষিভাইরা ইচ্ছা করলে পাটের বীজ উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে পারেন। আষাঢ় মাসেই এ উদ্যোগ নেয়া দরকার। পাট গাছের বয়স ১০০ দিন হলে গাছের এক থেকে দেড় ফুট ডগা কেটে নিতে হবে। এসব ডগাকে আবার ৩/৪ টুকরা করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে প্রতি টুকরায় যেন দুটি গিঁট থাকে। এসব টুকরো ভেজা জমিতে দক্ষিণমুখী কাত করে রোপণ করতে হবে। রোপণ করা টুকরোগুলো থেকে ডালপালা বের হয়ে নতুন চারা হবে। পরবর্তীতে এসব চারায় প্রচুর ফল ধরবে এবং তা থেকে বীজ পাওয়া যাবে।
ভুট্টা
খরিফ ভুট্টার মোচা এখন সংগ্রহ করা যাবে। পরিপক্ব হওয়ার পর বৃষ্টিতে নষ্ট হবার আগে মোচা সংগ্রহ করে ঘরের বারান্দায় সংগ্রহ করতে পারেন। রোদ হলে শুকিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর যদি মোচা পাকতে দেরি হয়, তবে মোচার আগা চাপ দিয়ে নিম্নমুখী করে দিলে বৃষ্টিতে মোচা নষ্ট হবে না।
শাকসবজি
এ সময়ে উৎপাদিত শাকসবজির মধ্যে আছে ডাঁটা, গিমাকলমি, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, ঝিঙা, শসা, ঢেঁড়স, বেগুন। এসব সবজির গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনে মাটি তুলে দিতে হবে। সবজি ক্ষেতে পানি জমতে দেয়া যাবে না। পানি জমে গেলে সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতার/গাছের ১৫-২০ শতাংশের পাতা লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে। কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা তৈরির সময় গর্তপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম সরিষার খৈল, ২ কেজি ছাই, ১০০ গ্রাম টিএসপি ভালোভাবে মাদার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।এরপর প্রতি গাদায় ৩/৪টি ভালো সবল বীজ রোপণ করতে হবে। বর্ষায় পানি যেন মাদার কোন ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সম্ভব হলে মাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছপালা
এ সময়টা গাছের চারা রোপণের জন্য খুবই উপযুক্ত। বসতবাড়ির আশপাশে, খোলা জায়গায়, চাষাবাদের অনুপযোগী পতিত জমিতে, রাস্তাঘাটের পাশে, পুকুর পাড়ে, নদীর তীরে গাছের চারা বা কলম রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ সময় বনজ গাছের চারা ছাড়াও ফল ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে পারেন। ফলের চারা রোপণের আগে গর্ত তৈরি করতে হবে। সাধারণ হিসাব অনুযায়ী এক ফুট চওড়া ও এক ফুট গভীর গর্ত করে গর্তের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার মিশিয়ে, দিন দশের পরে চারা বা কলম লাগাতে হবে। বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে উন্নত জাতের রোগমুক্ত সুস্থ-সবল চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। চারা শুধু রোপণ করলেই হবে না। এগুলোকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোপণের পর শক্ত খুঁটির দিয়ে চারা বেঁধে দিতে হবে। এরপর বেড়া বা খাঁচা দিয়ে চারা রক্ষা করা, গোড়ায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, সেচনিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।
নার্সারি মালিক যারা তাদের মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব জরুরি। সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, দুর্বল রোগাক্রান্ত ডালপালা কাটা বা ছেঁটে দেয়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
বর্ষাকালে হাঁস-মুরগির ঘর যাতে জীবাণুমুক্ত ও আলো-বাতাসপূর্ণ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এ মাসে হাঁস-মুরগির কৃমি, কলেরা, রক্ত আমাশা, পুলরাম রোগ, সংক্রমণ সর্দি দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। হাঁস-মুরগিকে ভেজা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় না রেখে শুকনো ঘরে রাখতে হবে এবং মাঝে মধ্যে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে।
বর্ষাকালে গবাদিপশুকে সংরক্ষণ করা খড়, শুকনো ঘাস, ভুসি, কুঁড়া খেতে দিতে হবে। সে সাথে কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে। মাঠ থেকে সংগৃহীত সবুজ ঘাস ভালোভাবে পরিষ্কার না করে খাওয়ানো যাবে না। বর্ষাকালে গবাদিপশুর গলাফোল, তড়কা, বাদলা, ক্ষুরা রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এ জন্য প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। কৃমির আক্রমণ রোধ করার জন্য কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। হাল চাষের পর গরুকে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এছাড়া যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
মৎস্য সম্পদ
বর্ষা মৌসুমে বন্যায় মাছ চাষের অনেক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য পুকুরের পাড় উঁচু করে দেয়া জরুরি। বন্যার সময় পুকুরে মাছ আটকানোর জন্য জাল, বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আষাঢ় মাস মাছের পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। মাছ চাষের জন্য মিশ্র পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। পুকুরে তিন স্তরের উপযোগী মাছের পোনা ছাড়তে হবে। একই সাথে পুকুরে নিয়মিত খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। বড় পুকুরে, হাওরে, বিলে, নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করতে পারেন। মাছ চাষের যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আপনাদের আগাম নিশ্চিত প্রস্তুতির জন্য আগামী মাসে বৃহত্তর কৃষির সমুদয় কাজের উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে জানিয়ে দেই। আমাদের বিশ্বাস সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়নে আপনাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতে এগুলো বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। এরপরও যদি আরও নতুন কোন তথ্য প্রযুক্তি বা কৌশল জানার থাকে অথবা কোন বিষয়ে বিস্তারিত জনতে চান তাহলে স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি-মৎস্য-প্রাণী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিলে আরও বেশি লাভবান হবেন। সে সাথে দেখবেন কৃষির সফলতায় শুধু আপনিই উদ্ভাসিত নন, উদ্ভাসিত দেশের কৃষি এবং পুরো দেশ। আবার কথা হবে আগামী মাসের কৃষিকথায়। নববর্ষার প্রতিটি ফোঁটা বয়ে আনুক আমাদের কৃষির সুখ-সমৃদ্ধি। আপনাদের সবার জন্য নিরন্তন শুভ কামনা। কৃষির সমৃদ্ধিতে আমরা সবাই গর্বিত অংশীদার।
লেখক:
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট,