পুষ্টি ও ওষুধি গুণাগুণের বিবেচনায় সজিনা বর্তমানে বসতবাড়ির জন্য আদর্শ সবজি বা গাছ। সজিনার ইংরেজি নাম উৎঁস ঝঃরপশ এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম গধৎরহমধ ড়ষবভবৎধ উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ হলেও শীত প্রধান এলাকা ছাড়া সব জায়গায়ই এটি পাওয়া যায়। বারোমাসি সজিনা গাছ সারা বছরই ফল দেয়। গাছে সব সময় ফুল ও কচি ফল হতে দেখা যায়।
সজিনার পুষ্টিগুণ
পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনা গাছকে অলৌকিক গাছ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যক এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ থাকে যা বহু উদ্ভিদে নাই। সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আধার। এছাড়া শুকনো সজিনার পাতায় উচ্চ মাত্রায় পুষ্টি থাকে। সজিনার বীজের তেলে সে এসিড থাকে তা বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। এ গাছের প্রতি গ্রাম পাতায় গাজরের চারগুণ বেশি ভিটামিন এ, দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালশিয়াম, কলার চেয়ে ৩ গুণ বেশি পটাসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ভিটামিন, দইয়ের চেয়ে ২ গুণ বেশি প্রোটিন আছে। বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সজিনা পাতায় ৪২% আমিষ, ১২৫% ক্যালসিয়াম, ৬১% ম্যাগনেসিয়াম, ৪১% পটাশিয়াম, ৭১% লৌহ, ২৭২% ভিটামিন-এ এবং ২২% ভিটামিন -সিসহ দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতাসহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতিজনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
সজিনার পাতাকে এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা হয়। ৪৬ রকমের এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। এরমধ্যে ভিটামিন-সি, বিটা ক্যারোটিন, কিউরেকটিন এবং ক্লোরোজেনিক এসিড বিদ্যমান। উল্লেখ্য, এসব উপাদানই মানবদেহের জন্য উপকারী। বিশেষ করে ক্লোরোজেনিক এসিড রক্তের চাপ ও শর্করা কমাতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে এবং পালং শাকের চেয়ে তিনগুণ বেশি আয়রন বিদ্যমান, যা এ্যানেমিয়া দূরীকরণে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। সজনে শরীরে কোলস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও অন্যতম অবদান রাখে। ৩ মাসের ব্যবহারে এটি কোলস্টেরল লেভেল অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।
বারোমাসি সজিনার ইতিহাস :
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে ২০১৯ সালে বারোমাসি সজিনার চাষাবাদ উৎপাদন ও বিতরণ শুরু হয়। চকঝ-২ জাতের এ সজিনার চারা গবেষণার মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাইখালীতে অবস্থিত কৃষি গবেষণা কেন্দ্র হতে বারোমাসি সজিনার জাতটি সর্বপ্রথম উদ্ভাবন হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) থেকে পরবর্তীতে তা জাত হিসেবে অবমুক্ত হয়।
জাতটির বৈশিষ্ট্য :
এ জাতটি মাটিতে চারা রোপণের ৬ মাসের মধ্যে গাছে ফল বা ডাটা ধরবে এবং সারা বছরই তা পাওয়া যাবে। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে মোট ১৬০০টি পর্যন্ত ফল ধরবে।
পলিমাটি সজিনা চষের জন্য সর্বোত্তম। এটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। কাটিং রোপণের জন্য উত্তম সময় এপ্রিল থেকে মে মাস। প্রতিটি লম্বা সজিনার ফলে ১০-১৫টি বীজ থাকে, এগুলো তিন শিরাবিশিষ্ট এবং ত্রিভুজাকৃতির। বীজ থেকে বংশবিস্তার সম্ভব হলেও অঙ্গজ বা কাটিং থেকে নতুন চারা তৈরি করাই সহজ এবং উত্তম।
চারা তৈরি :
বীজ থেকে চারা তৈরির ক্ষেত্রে গাছ থেকে পরিপক্ব সজিনা সংগ্রহ করে মে মাসে সজিনা বীজ ডাঁটা থেকে আলাদা করা হয়। সংগৃহীত বীজ হালকা রোদ্রে শুকিয়ে বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। জুন-জুলাই মাসে সিডবেড ভালোভাবে কুপিয়ে পচা গোবর দিয়ে বেড প্রস্তুত করা হয়। সিড বেডের আকার ১ মিটার প্রস্থ ও জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করা যেতে পারে। তবে বেডের চতুর্দিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০-৫০ সেমি. আকারে ড্রেন রাখতে হবে। অতঃপর বীজ, বেডে ১০-১৫ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বপন করতে হবে। ৫০-৬০ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। চারা গজানোর থেকে শুরু করে চারা উঠানো পর্যন্ত সীডবেড আগাছামুক্ত ও সেচ প্রদান করতে হবে। কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে বীজ থেকে তৈরি চারার ফল আসতে ৩-৪ বছর সময় লাগে।
কাটিং হতে চারা তৈরি :
কাটিং থেকে চার তৈরি করাই উত্তম। এক্ষেত্রে অল্প যতেœ দ্রæত ফলন পাওয়া যায়। বয়স্ক গাছ থেকে প্রæনিং এর সময় যে ডাল কেটে ফেলা হয় তা থেকে রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত সতেজ ও স্বাস্থ্যবান শক্ত ডাল ২.৫-৩ ফুট (৭৫-৯০ সেমি.) লম্বা ও ৩-১৬ সেমি. ব্যাসবিশিষ্ট ডাল নির্বাচন করা উত্তম। প্রস্তুতকৃত কাটিং সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করা হয়। কাটিং রোপণের জন্য উত্তম সময় এপ্রিল থেকে মে মাস।
কাটিং রোপণ পদ্ধতি :
এক্ষেত্রে জমি ভালোভাবে চাষ করে ২০ ইঞ্চী ২.৫ ফুট আকারের গর্ত করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যে, কাটিং গর্তে লাগানোর সময় প্রতিটি কাটিং এর তিন ভাগের এক ভাগ গর্তের মাটির নিচে রাখতে হবে। কাটিং লাগানোর সময় গর্তের মাটির থেকে ৩-৪টি নিমপাতা এবং ১০ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডবিøউপি গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে কাটিং লাগালে মাটিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। গর্তে কাটিং লাগানোর পর কাটিংয়ের মাথায় আলকাতরা দিয়ে প্রলেপ দিতে হবে। এতে কাটিংয়ের মাথা শুকিয়ে যাবে না।
সার প্রয়োগ :
সজিনার ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি গর্তে পচা গোবর/কম্পোস্ট ৪০-৫০ কেজি, টিএসপি ৫০ গ্রাম, ইউরিয়া ১০ গ্রাম, এমওপি/পটাশ- ১০০ গ্রাম, জিপসাম- ১০ গ্রাম, দস্তাসার-১০ গ্রাম ও বোরন সার- ১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
প্রয়োগ পদ্ধতি :
সজিনার কলম চারা রোপণের জন্য ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে উপরোক্ত সার মাটির সাথে মিশিয়ে ঢেকে রেখে দিতে হবে। এছাড়া রাসায়নিক সার না দিয়ে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর সার গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে উক্ত গর্তে সাথে সাথে চারা লাগানে যায়।
গাছ লাগানোর পর সার প্রয়োগ :
প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি. এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ৫০ গ্রাম করে সার দুপুর বেলায় সূর্যের আলো গাছের উপর পড়লে, গাছ যে পরিমাণ জায়গায় ছায়া প্রদান করে, সেই পরিমাণ জায়গায় গাছের চতুর্দিকের মাটি কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি বছরে প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর ঠিক রেখে ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট সার ২০ গ্রাম করে বর্ধিত হরে প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা :
সজিনা গাছের তেমন একটা পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। শুধু গরু ছাগলের উপদ্রব ঠেকানো সম্ভব হলেই গাছগুলো বড় হয়ে ওঠে এবং তাতে ভালো ফলন হয়। মাটির উপর সার ও কীটনাশকের খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
সজিনার মাথা কাটা বা ঝোপালোকরণ :
গাছ ১ মিটার উচ্চতা হলেই প্রথম ডগা কাটতে হবে। গাছকে বেশি লম্বা হতে না দিয়ে ২-৩ বার মাথা কেটে দিলে গাছে বেশি ফল ধরে ও দ্রæত বড় হবে। চারা রোপণ করলে প্রথমে ১০ সেমি. আগা কাটতে হবে। দ্বিতীয় বার ডগা বের হলে তা ২০ সেমি. পর কেটে ফেলতে হবে। পছন্দসই ডগা রেখে বাকিগুলো সব কেটে ফেলতে হবে। এতে করে গাছের আকৃতি ঝোপালো, ফলন বেশি এবং ফল সংগ্রহ সুবিধা হবে। নতুবা লম্বা ডালে অল্প সজিনা হবে যা পাড়তে গেলে ডাল কাটতে হবে।
ফলন : একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ১৬০০টি পর্যন্ত সজিনার ফল বা ডাটা উৎপাদন হবে। বারোমাসি চারা লাগানোর ৬ মাস পর থেকে ফল ধরবে এবং তা সারা বছর পাওয়া যাবে।
সাথী ফসল :
সজিনা গাছকে বাউনি বৃক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে গাছআলু চাষ করা যায়। শীতের পূর্বেই গাছআলু সংগ্রহ করে নিলে বসন্তে সজিনার ফলন শুরু হয়। সজিনা লাগালে স্থায়ী ফসল হিসেবে শীতকালীন সবজি যেমন- ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, ব্রোকলি, টমেটো, ধনিয়া ও হলুদের চাষ করা যায়।
লেখক: কৃষিবিদ মোঃ মোসারফ হোসেন
পরিচালক (অব.), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।