পারমিতা মালী: অত্যাচারী অথবা অত্যাচারিত যেই হোক না কেন, প্রাণপণ হুঙ্কার দিয়ে চিৎকারের নাম দাহাড়।
সিরিজের শুরুতেই প্রথমেই একটা মেয়ের বিষ খাওয়ার ছবি, কয়েক সেকেন্ড। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। আবছা ছবি। এক দু সেকেড, ব্যস। তারপর টাইটেল সং। এরপর শুরু হয় সিনেমা।
টাইটেল সং এ একের পর এক মেয়েদের ড্যানিশ হয়ে যাওয়ার ছবি। মেয়ে হারানোর পুলিশ ফাইল আর কটা হয়? হলেই কতটুকু কেস এগোয়? কটা মেয়েই বা পাওয়া যায় ফিরে? এতোবড় দেশ, দারিদ্র্য সীমার নিচেই আছে এতো কোটিজন! খেটে খাওয়া নিম্নবর্গের অধিকাংশ সব পরিবার, সেখানে থেকে দুচারটে মেয়ে যদি ‘না’ হয়েই যায়, কি এমন আসমান গিরে পড়বে মাথায়? এসব ঢেউ বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মা-বাপ বড়জোর একটু বিনবিন করে কাঁদবে, পরের দিন চোখ মুছে আবার কাজে বেরোবে তারা। ব্যস, শেষ তার মানবজন্মের কাহিনী।
এই সিরিজের কাহিনী অবশ্য এক সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলারের। ফলে মৃত্যুর কারণ অন্য। তবে সেসব গল্প ছাপিয়েও ফুটে উঠেছে আমার দেশের সমাজ, পিছিয়ে পড়া ঘরগেরস্থালি, জাতপাতের যাচ্ছেতাই সব চিন্তাভাবনা, আর দীর্ঘমেয়াদি পুলিশি ব্যবস্থা, আর তারই সাথে জড়িয়ে মরিয়ে চলতে থাকা আমি,আপনি, রাম, শ্যাম, টম, ডিক, হ্যারি সব্বাই।
রিভিউ না করে বরং সিরিজের লাস্ট সিনটা উল্লেখ করি সবার আগে। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। খুনিকে ধরার পরে যখন তাকে প্রশ্ন করা হলো,
“কেন মারলে তুমি ২৯ টা ইনোসেন্ট মেয়েকে?”
খুনির উত্তর।
“ইনোসেন্ট! কে ইনোসেন্ট? কেউ ইনোসেন্ট নয়। দুদিন আড্ডা হলো, হাশি-মজাক হলো, অমনি পা ফাঁক করে শুয়ে পড়লো? এদেরকে ইনোসেন্ট বলে? নেহি। কভি নেহি। ইনোসেন্ট মেয়েরা এরকম হয় না, অন্যরকম হয়।”
“কেমন হয় ইনোসেন্ট মেয়েরা?”
“বললুম তো, অন্যরকম হয়।”
না জানি সেই ইনোসেন্ট কী আকাশকুসুম ব্যাপার।মেয়েদের চারিত্রিক innocence , বা purity র এই অভূতপূর্ব চিন্তাধারা কি সমাজে আগে থেকেই ঘোরে না? এই খুনি নাহয় সাইকোপ্যাথ, কিন্তু এইসব চিন্তাধারা তো সে আকাশ থেকে পাড়েনি। সে তো আগে থেকেই ছিলো, এবং এখনো আছে।
সমাজ খুব সচেতনভাবেই এগুলো মাথার মধ্যে ঢোকায়। যে সমাজে শিক্ষার হার কম, সেই সমাজে আরো বেশি করে এইসব থাকে। আর এই বিপজ্জনক purity বাঁচাতে বাঁচাতে মেয়েরা বড় হয়, যুবতী হয়, বাচ্চার মা হয়, বুড়ি হয় তবুও তার purity র হাত থেকে সে রেহাই পায় না। প্রতি মুহূর্তে চাপ এই বুঝি অপবিত্র হয়ে গেলো।
বিয়ের বয়সে পড়লে মেয়েদের উপর আসে অন্যরকম পরোক্ষ চাপ। বর না জুটলে তার দোষ, ছেলেপক্ষ পছন্দ না করলে তার দোষ, উঠতে বসতে খোঁটা খেতে হবে কেন বেশি বরপণ চাইছে। পশ্চিমবঙ্গে বসে আমরা হয়তো ভেবেই উঠতে পারছি না যে ইউপি, রাজস্থান, বিহার, এমপি এমন বহু জায়গায় এখনো কী বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয় দহেজ বাবদ! তারপর তো লোকলশকর খাতিরদারি আছেই। এগুলো তো সাধারণ ভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে যায় প্রায়! আর বিচিত্র এদের সামাজিক রীতিনীতি বাপু!..এদিকে মেয়ে হলে বলবে “ঘরমে লক্সমী আয়ী হ্যায়! ঘরকি বেটি লক্সমী বরাবর, আর সেই লক্ষ্মীবিদায় করতে গেলেই একেবারে ঘটিবাটি বিক্রি ছাড়বে। কি অদ্ভুত থিওরি!
এহেন মেয়েদের মধ্যে যারা তেড়েফুঁড়ে উঠে ঘরসংসারের সঙ্গে একা লড়ে চাকরি বাকরি করে নিজের পায়ের তলায় শক্ত মাটি তৈরি করে নিতে পারলো, তারা নাহয় অন্য ধাতুতে তৈরি। তারা আলাদা। কিন্তু বাকিরা? বিপুলা এ দেশের বেসিক মেয়েরা? যারা বেশিরভাগই কলেজ অব্দি পৌঁছই না? যাদের না আছে পয়সাকড়ি, না আছে একাডেমিক সার্টিফিকেট? তারা কি করবে? তারাও বাঁচে।
তাদের জন্য আছে এক রঙীন দুনিয়ার হাতছানি। রূপকথার জগৎ, ভালোবাসার ঘর বাঁধা, স্বপ্নের প্রেমিকের সাথে, যে তাকে ঘোড়ায় চড়ে এসে নিয়ে যাবে। ঠিক যেমন সিনেমায় দেখি, শাহরুখ- শালেমন -রানী-মনীষা, মাধুরী, এদের ভালোবাসা আর নাচেগানে আনন্দে ভরা দুনিয়া, ঠিক তেমনি এক দুনিয়ায় থাকবে সে শুধু ভালোবাসবে আর নাচবে গাইবে। এসব স্বপ্ন ভাঙতে অবশ্য ২৪ বা ৪৮ ঘন্টার বেশি সময় লাগে না। প্রেমিককে বিশ্বাস করে বাড়ি থেকে পালায় তারা। বাপ-মা, গঞ্জনার জীবন সব ছেড়ে এক রঙিন জীবনের টানে।
অবিশ্বাস বা আতঙ্ক কি হয় না তাদের ?
হয় বোধহয়, তবুও তারা বেরোয়। বাপের বাড়ি যদি একটু কম গঞ্জনা দিতো, যদি একটু বুঝতো তাদের! তাহলে হয়তো এমন ভুল করতো না তারা। বিয়ে যে মহার্ঘ কিছু বস্তু নয়, মেয়ের বিয়ে দিলেই যে সে উদ্ধার হয়ে যায় না, সেটা বোঝে যখন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এ কাহিনীর ভিলেন অবশ্য এক সাইকোপ্যাথ। সে মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসায়, বিয়ের স্বপ্ন দেখায়, তারপর ঘরছাড়া করায়। সেইসব মেয়েদের, যারা কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পড়া, ঘরেলু মেয়ে। অবশ্যই আলাপের সোর্স সোসাল মিডিয়া, কোথাও বা হয়তো সামনাসামনি। তাদের রূপের প্রশংসা, মনযোগ আকর্ষণের সাধারণ সব ফ্লার্টিং, এতেই গলে যায় তারা। অবহেলার জীবনে সামান্য একটু মায়া-মমতা…ব্যস, তাতেই তারা দিয়ে ফেলে সর্বস্ব। ওই একমুখী মোহে পড়ে একদিন ঘর ছাড়ে তারা। এ অবশ্য নতুন কিছু কাহিনী নয়। যুগে যুগে এমন ঘটনা ঘটেছে। মেয়েরা প্রেমের জালে পড়ে সঞ্চিত সামর্থ্যটুকু নিয়ে ঘর ছেড়েছে, পাড়ি জমিয়েছে চোরাবালিতে। কয়েকদিনের প্রেমঘন আদর যাপন শেষপর্যন্ত তারা এসে পৌঁছেছে সোনাগাছি হাড়কাটা গলিতে। এসব গল্প খুব চেনা আমাদের। পুলিশ অবশ্য পারে কিছু মেয়েদের উদ্ধার করতে। তারা বাড়ি ফিরে যায় কেউকেউ, কারোর বাড়ি হয়তো ফেরতই নেয় না। এ পর্যন্ত গল্প আমাদের চেনা। কিন্তু এই কাহিনী একটু অন্যরকম। বাড়ি থেকে ভাগিয়ে নেওয়া প্রতিটি মেয়েকে খুন করে সেই প্রেমিক। বিয়ের পরের দিন সকালেই সেই কন্যের অবস্থান হয় কোনো রাস্তার পাবলিক টয়লেটে, মৃত অবস্থায়। কেন, কিভাবে সে মরলো সে গল্প না হয় সিরিজটা দেখলে বোঝা যাবে।
কিন্তু পুরুষ চরিত্রটি ভারি অদ্ভুত। ভদ্র, মার্জিত, সভ্য একটি ছেলে, যে কিনা কলেজের লেকচারার, বছরের পর বছর ধরে এই তার নেশা!
আরে ভাই কিঁউ?? খুন করছিলে কেন? বেচে দিলে তবু নাহয় একটা কারণ থাকে। টাকার জন্যে করেছে। খুন করে কি লাভ হয়? এতোগুলো নিরপরাধ মেয়েকে খুন ? কেন!!!
ওই যে উত্তর,
” ইনোসেন্ট কোনো মেয়েকে মারিনি আমি। শোয়ার সময় খেয়াল ছিলো না?”
কী ভয়াবহ চিন্তাভাবনা!
” তা সমাজ শোধরানোর দায়িত্ব কি তুমি নিয়েছ হে খুনি?”
খুনির চোখে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ নেই। সে এই আদি পৃথিবীর আদিমতম পুরুষ। গলা তুলে বলে,
“সব্বাই দোষী, সব মেয়েই দোষী, এ দুনিয়ায় সব পাপের দায় মেয়েদের। S.I. Bhaati তুমিও দোষী। মেয়ে হয়ে জন্মেছ আর নারীত্বের বিভা ছড়াবে না, তা কি হয়? পুলিশের উর্দি চাপিয়েছ বলেই স্পেশাল হয়ে গেছো? যে পোশাকেই থাকো না কেন তোমরা, সেই পোশাক ছাপিয়ে তোমাদের শরীর আমরা পুরোপুরি দেখতে পাই। তোমরা আমাদের নিচেই থাকবে!
অসভ্য অশ্লীল উক্তিগুলো জেলচত্তর ছড়িয়ে চারিয়ে পড়ে সমস্ত আকাশে বাতাসে। সেই শব্দকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় S.I Bhaati, দলিত জাতির এক নারী। যে প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজের জাত আর নারীত্বের লাগামকে দাবড়ে বেঁচে থাকতে। না জানি আরো কত লড়াই বাকি..না জানি আরো কত হাজার বছর ধরে এই পাপ, এই মৃত্যু এই দাবিয়ে রাখার ইতিহাস। এর থেকে আমাদের রেহাই নেই।
সিরিজটার একলাইনই রিভিউ হয়।
it’s quite next to natural..
তাও কয়েটা কথা বলি।
১.সিরিজ দেখতে বসলে আগেই বোঝা যাবে কে খুনি। জেনারেলি ক্রাইম থ্রিলারে এরকম হয় না। তবুও গল্প টানটান আছে। গতি আছে।
মারাত্মক কিছু টুইস্ট নেই। দেশের পুলিশি ব্যবস্থায় যতটুকু যা সম্ভব সেভাবেই হয়েছে। একেবারে স্কটল্যান্ডের পুলিশের মতো ঝাঁ চকচকান মারপিট কিছু হয়নি।
২. সোনাক্সী সিং ভালো করেছেন, তবে একটু বাড়াবাড়ি করেছেন। দাবাং এর মতো হিরোগিরি দেখিয়ে ফেলেছেন, যেটা বড্ড বেশি চোখে পড়ছে। উনি আর একটু সেসসেটিভ হলে ভালো হতো। তবে কথা বলার টোন সুন্দর ভাবে পাল্টে নিয়েছেন গোটা সিরিজটাতেই। সেটা ভালো লেগেছে।
৩. বিজয় বর্মা আরেক লিডিং ক্যারেক্টর। ওই প্রেমিক খুনীর ক্যারেক্টর। অনবদ্য অভিনয় তাঁর। শীতল নিয়ন্ত্রিত উচ্চারণ তাঁর এতোটাই ন্যাচারাল আর লো টিউনে বাঁধা যে, অভিনয় করছেন বলে মনেই হচ্ছে না। মির্জাপুর থ্রি তে যে এই ভদ্রলোক অনেকটাই স্ক্রিন শেয়ার করবেন সেটা নিশ্চিত।
৪. এটিও ‘এক্সেল এন্টারটেইনমেন্ট’ এর প্রোডাকশন যারা মির্জাপুর তৈরি করছে। কাহিনীতে ফারহানের বোন জোয়া আখতার, আর পরিচালনা রিমা কাগদি। দুজনেই অসাধারণ। রিমা কাগদি কে মনে আছে তো? সেই ‘জিন্দেগী না মিলেগী দোবারা’ ‘গল্লি বয়’, ‘তালাশ, ধোবিঘাট, মারকাটারি সব মুভির পরিচালক। আর ফারহানের প্রতি দুর্বলতা আমার বহুদিনের। শুধু তার রূপ নয়, তাঁর গুণমুগ্ধও আমি। এতো বছর পেরিয়ে গেলো ফারহান আখতারের প্রতি মোহ আমার বিন্দুমাত্র টসকায়নি।
৫. মান্ডোয়া রাজস্থানের একটি ছোট্ট শহর। সেই শহরের পুলিশ স্টেশন ঘিরে গল্পটি তৈরি হতে থাকে। এক নিচু জাতের মেয়ে কৃষ্ণা চাওল উধাও হয়েছে। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায় এক নয়, দুই নয়, পাক্কা ২৯ টা মেয়ে উধাও হয়েছে আশেপাশের পরিধির মধ্যেই। তাদেরই খোঁজ হতে হতে একের পর এক সুতোয় টান পড়তে থাকে। থানার ইনচার্জ এর ভূমিকায় গুলশান দেবাইয়া। ইনি আর একজন শক্তিশালী অভিনেতা। কত timid অভিনয়! কিছু কিছু লোকের অভিনয় দেখলে মনে হয় সালেমন খান, গোবিন্দা র মতো এমন বেশ কিছু আকাট অভিনয়হীন লোক সারাজীবন ধরে করেকম্মে খেয়ে গেলো সিনেমার হিরো হয়ে, আর এই মাপের অভিনেতাদের লোকের চোখের পড়ে না! কী আশ্চর্য!
৬. অনেক ল্যুপহোল আছে। যাঁরা নিয়মিত দেশি-বিদেশি সিরিজ দেখেন তাঁরা বুঝতে পেরেই যাবেন। আমি আর আলাদা করে উল্লেখ করছি না।
যাই হোক, সিরিজটা দেখলে ঠকবেন না। এটা সিওর।