শতাব্দী দাস: ‘মিরর’ নিঃসন্দেহে এ সিরিজের শ্রেষ্ঠ ফিল্ম। আমার মতে লাস্ট স্টোরিজ ১ ও ২ মিলে আটটি শর্টের মধ্যেই সেটি সবচেয়ে পরিণত ও উত্তীর্ণ। নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষার কথা বলার জন্য শুধু নয়, জেন্ডারের সুতোটির সঙ্গে ক্লাস, কাস্টের রাজনীতির সুতোগুলি সুনিপুণ ভাবে বুনে একটি বিনুনি বাঁধা। এখানে উচ্চবিত্ত নারীটির মাথায় যে ভয়ারিজমের ভূত চেপেছে, তাকে কোথাও জাস্টিফাই করা হয়নি। ছবিটি অনেক তথাকথিত নারীবাদী ছবির মতো ডাইড্যাক্টিক নয়। মানে ‘মেসেজ’ দেওয়া তো আর শিল্পের প্রধান কাজ নয়, সেটা গোদা ভাবে করলে আবার ছবি কম, ( বা সাহিত্য কম)। আর প্রোপাগ্যান্ডা বেশি মনে হয়। এখানে চরিত্রদের কাঁধে মায়াভরা হাত আলগোছে রাখা পরিচালকের। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা যে যা করে, তা পরিচালকীয় সায় ও সম্মতি নিয়ে করে। অভিজ্ঞ গল্পকাররা বলেন, লেখকের চরিত্রদের ঘেঁটি ধরে থাকলে হয় না। “An author must let the characters free, let them be” কঙ্কণা সেটা পেরেছেন। অপর্ণা পারেন না।
মালকিন শেষের আগের দৃশ্যে স্বীকার করে যে সে গর্হিত কাজ করেছে। তাহলে কেন মনে হচ্ছে যে কাজটিকে সেলিব্রেট করেছে ছবিটা? আর কাজের মেয়েটি স্বীকার যায় যে সেও উপভোগ করত মালকিনের সেই দেখা। কেন করত? কেন এই এক্সিবিশনিজম? তার উত্তর ক্লাসরুমে পড়ানোর মতো করে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। সফল, বড়লোক, ইংরেজি বলা নারীর জীবনেও সেই যৌনসুখ নেই, যা তার আছে— তার শ্রেণীগত বঞ্চনার কারণেই এ বোধ তাকে আনন্দ দিত। ঈশিতার বাড়ি আছে, সম্পদ আছে, অথচ যৌনতা নেই। আর অন্যজনের সক্ষম যৌনসঙ্গী বর আছে, অথচ একটুও আড়াল নেই যৌনতা উপভোগ করার মতো। আড়াল খুঁজতেই তো মালকিনের বাড়িকে ব্যবহার করা। তবে আড়াল তো তারও দরকার আসলে। কিন্তু আড়াল বিসর্জন দেয় সে শ্রেণিগত প্রতিশোধস্পৃহায়। যৌনতা এখানে কেবলই যৌনতা নয়, যেমনটা পশুরা করে। এখানে যৌন ফ্যান্টাসির মধ্যে নিপীড়িতর প্রতিশোধস্পৃহা পুরে দেওয়ার কায়দাটি আমার ভাল লেগেছে। সে সঙ্গীকে ওরাল সেক্সের জন্য দাড়ি কেটে আসতে বলে, কারণ সে ফিমেল অর্গাজম চায় অন্য নারীর চোখের সামনে; যে নারী তার চেয়ে আর সব দিক থেকে বেশি সুখী, অথচ যার অন্তর্বাসও তাকে কেচে দিতে হয়, তার সামনে।
আর দুই নারীর এই খেলায় পুরুষটির ‘প্রাইভেসি’ যে বলিপ্রদত্ত হয়, তা স্পষ্ট স্বীকার করা হয় ছবিতে। পুরুষটি বলে রাতে বস্তির ওই দৃশ্যে। পুরুষটি বুঝতে পারে সে বলিপ্রদত্ত হয়েছে তার স্ত্রীর ইচ্ছানুসারেই, কনসেন্ট ছাড়াই। কিন্তু ক্ষমা করে শরীরের তাড়নায় বা সম্পর্কের খাতিরে। নাকি বিত্তবানের ওই অসহায়তা অবচেতনে তারও ভাল লাগে?
ছবিটি অনেক জায়গায় নিজ নিজ ইন্টারপ্রিটেশনের জায়গা ছেড়ে রেখেছে। কিন্তু তা বলে কখনই তাকে ভয়ারিজমের সমর্থক বলা যায় না। ক্ষমা চেয়ে নিজের চাবি ফেরত দেয় মালকিন কামওয়ালি বাই-কে। সেটা দেয় ও নেয় তারা যে যার পেশাগত প্রয়োজনে এবং এটা বোঝার পরে যে তারা দুজনেই দোষী। কিন্তু একমিনিট। আবারও দেখবে মালকিন, এবার ওদের সম্মতিক্রমে, থ্রিসাম….এমন ত নয় বিষয়টি।
আমাদের ফাঁকা ঘর দেখানো হয়। ফাঁকা ঘরে তিনটে বাজে। লিফট ওঠে। ভিতর থেকে দেখি, দরজা খোলা হচ্ছে বাইর থেকে। ছবি শেষ হয়। আবারও নানা ইন্টারপ্রিটেশন হতে পারে। ১)কাজের মেয়ে কাজে এসেছে। ২)মালকিন ফিরে এসেছে অভ্যাসবশে। ৩)মালকিন আবার একবার দেখতে চায়, ওদের মিলনদৃশ্য দেখা যায় কিনা— কিন্তু এলে ফাঁক ঘরই দেখবে ( আগের শটে ফাঁক ঘর বিছানা দেখানো হয়েছে)। ৪)কাজের মেয়ে যৌনক্রিয়া করতে এসেছে, বরের সঙ্গে, কিন্তু মালকিন আর এসে দেখবে না।
নারীবাদী ছবি দেখলেই চটে গিয়ে এত রেগে যাবেন না যে ভয়ারিজমের সমর্থক ভাববেন। বরং নারীবাদী ছবি হয়েও ডাইড্যাক্টিক নয়, বহুস্তরী, এমন ছবি কম হয়৷ ছবিটি দেখুন।