এবার ভোজ্য তেলের যোগান দিতে নতুন ফসল সাউ পেরিলা

দিন দিন বাড়ছে ভোজ্যতেলের চাহিদা। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বাড়ছে আমদানি ব্যয়। আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং মানসম্মত ভোজ্যতেলের ফলন বৃদ্ধিতে দেশে নতুন তেলফসল ‘গোল্ডেন পেরিলা’ নিয়ে এসেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) একদল গবেষক। এখন থেকে দেশে চাষ হবে সম্ভাবনাময় ভোজ্যতেল ফসল ‘গোল্ডেন পেরিলা’। দীর্ঘদিন গবেষণা করে পেরিলাকে দেশীয় আবহাওয়ায় অভিযোজন করাতে সক্ষম হয়েছেন এ গবেষক দল।
পেরিলা (চবৎরষষধ) ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ একটি ভোজ্যতেলের জাত। সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) বাংলাদেশে অভিযোজিত পেরিলার একটি জাত। বাংলাদেশে জাতটি সম্প্রসারণের জন্য কাজ করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত¡ বিভাগের প্রফেসর ড. এইচ এম এম তারিক হাসান, উদ্যানতত্ত¡ বিভাগের প্রফেসর ড. আ ফ ম জামালউদ্দিন এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ২৭তম বিসিএস (সৃষি) ক্যাডারের অফিসার মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম মজুমদার।

ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন গবেষণার ফলে ফসলটি বাংলাদেশের প্রচলিত কৃষি মৌসুমে চাষের উপযোগিতা নির্ধারণ করত ৪টি ফসলসহ ফসল বিন্যাসের উপযোগী চাষাবাদ পদ্ধতি নির্ধারণ সম্ভব হয়। এর ফলে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি ফসলটি সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) জাত হিসেবে নামকরণপূর্বক কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বীজ বোর্ড (ঘঝই) কর্তৃক অবমুক্ত। ইতোমধ্যে দেশের ১২টি জেলায় এ ফসলটি পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করা হচ্ছে এবং এর বাম্পার ফলন আশা করা যাচ্ছে।
এ ফসলটির বিশেষত্ব হলো এর বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল এ ৫০-৫৫% লিনোলিনিক এসিড (ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের প্রধান উৎস) যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী। এর বীজ থেকে ৪০% তেল আহরণ করা যায়, যার প্রায় ৯১% অসম্পৃক্ত ফ্যাটিএসিড। দেশীয় প্রদ্ধতির প্রচলিত ঘানিতে এ বীজের তেল আহরণ করা যায়।
জাতের বৈশিষ্ট্য

সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) জাতটি লেমিয়াসি (মিন্ট ক্রপ) পরিবারভুক্ত। এ জাতের গাছের উচ্চতা ৯০-১০০ সেমি. পর্যন্ত হয়। বীজ সাদা, ধূসর, গাঢ় বাদামি হতে পারে এবং হাজার বীজের ওজন ৩.৫-৪.০০ গ্রাম। জাতটি খরাসহনশীল। খরিফ-২ তে চাষ করা যায়, যা শীতকালীন চাষনির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে।

পেরিলার ঔষুধি গুণ :
এর তেল আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী বিশেষত হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগে এটি কার্যকর ভ‚মিকা রাখে। এতে শতকরা ৫০-৫৫ ভাগ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে যা হার্টের জন্য খুব উপকারী। মোট ফ্যাটের শতকরা ৯১ ভাগ অসম্পৃক্ত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। এটি চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
সাউ পেরিলা-১ তেলের ব্যবহার : বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল পরিশোধন করে এবং পরিশোধন ছাড়া দুইভাবেই খাওয়া যায়। এ তেল নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন- বিভিন্ন ধরনের রান্নার কাজে। সালাদের সাথে মিশিয়ে। বিভিন্ন ধরনের ভর্তা তৈরিতে। আচার এবং চাটনি তৈরিতে। বিভিন্ন খাবারের সুগন্ধি বৃদ্ধিতে।
সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) এর উৎপাদন প্রযুক্তি পানি জমে না এমন প্রায় সব ধরনের মাটি ফসল চাষের জন্য উপযোগী। তবে বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটি পেরিলা চাষের জন্য বেশি উপযোগী। খরিফ-২ মৌসুমে চাষ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ১.০-১.৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১৫ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই। মোট উৎপাদনকাল ১০০-১০৫ দিন (বীজতলায় ৩০ দিন এবং রোপণ পরবর্তী ৭০-৭৫ দিন)।

বীজতলা তৈরি :
বীজতলার প্রস্থ ১.০-১.৫ মিটার দৈর্ঘ্য জমির আকার অনুযায়ী যে কোনো পরিমাণ নেওয়া যাবে। বীজতলায় জৈবসারের ব্যবস্থা করলে স্বাস্থ্যবান চারা পাওয়া যাবে। বীজতলায় দুই বেডের মাঝে নালার ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন বৃষ্টি হওয়ার পর অতিরিক্ত পানি জমে না থাকতে পারে। বীজের আকার ছোট হওয়ায় মাটি যথাসম্ভব ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। পিঁপড়ার আক্রমণ যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মৌসুমী বৃষ্টির কারণে চারা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বীজ বপনের প্রথম ১৫ দিন পর্যন্ত বীজতলার চারপাশে খুঁটি দিয়ে উঁচু করে পলিথিনে ছাউনি দেয়া যেতে পারে।

বীজবপন :
বীজতলার মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। আধাইঞ্চি গভীর লাইন করে বীজ বপন করলে বীজের অঙ্কুর ক্ষমতা বাড়ে। লাইন ছাড়া বীজ বপন করলে বীজ বপনের পর ঝুরঝুরে মাটি বীজের উপর ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের পর বীজতলায় হালকা করে পানি দিতে হবে। বীজতলা যেন একেবারে শুকিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

জমি তৈরি :
চার-পাঁচটি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। জমির চারপাশে নালার ব্যবস্থা করলে পানি নিষ্কাশনের জন্য সুবিধা হবে।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি:
চারা রোপণ :
বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর চারা রোপণের উপযোগী হয়। এই সময় প্রতিটি চারায় ৫-৬টি পাতা হয়। চারা উত্তোলনের সাথে সাথে রোপণ করতে হবে। চারা উত্তোলনের পর চারার আঁটি বাঁধার সময় শিকড়ে মাটি রেখে দিলে রোপণের পর গাছের দ্রæত বৃদ্ধিতে উপকার হয়। চারা রোপণের পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে। চারা রোপণের দূরত্ব গাছ থেকে গাছের ৪০-৫০ সেন্টিমিটার এবং লাইন থেকে লাইনের ৩০-৫০ সেন্টিমিটার।
সেচ ও নিষ্কাশন :
খরিফ-২ মৌসুমে পেরিলার চাষ হওয়ায় সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে একটানা ১৫-২০ দিন বৃষ্টি না হলে ফুল আসার সময হালকা সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেজন্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা :
চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর একবার এবং ২৫-৩০ দিন পর দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হবে। ফসলের সাধারণত রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ খুবই কম। তবে নিম্নের পোকাগুলোর আক্রমণ দেখা দিতে পারে।
১. কাটুই পোকা : এ পোকা দিনের বেলায় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে এবং রাতের বেলায় চারা গাছ কেটে দেয়।
প্রতিকার : আক্রান্ত কাটা গাছ দেখে তার কাছাকাটি মাটি উল্টে-পাল্টে কীড়া খুঁজে সংগ্রহ করে মেরে ফেলা উচিত। এ পোকার উপদ্রব বেশি হলে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ মোতাবেক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

২. হক মথ : এ মথের ক্রীড়া গাছের কচি পাতা, কাÐ, ফুল ও ফল পেটুকের মতো খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফুল ধারণ বাধাগ্রস্ত হয়। গাছের বৃদ্ধির প্রাথমিক অবস্থায় এ পোকা বেশি আক্রমণ করে।
প্রতিকার : সকালে ও বিকেলে ক্রীড়া হাত দিয়ে সংগ্রহ করে মেরে দমন করা যায়। জমির মাটি গভীরভাবে উলটপালটের মাধ্যমে ক্রীড়া ধ্বংস করা যায়। এ পোকার উপদ্রব বেশি হলে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ মোতাবেক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৩. বিছা পোকা : গাছের অঙ্গজবৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত এদের আক্রমণ দেখা যায়। তবে ফল ধরার সময় আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় ছোট ছোট কীড়া ১-২টি পাতা খেয়ে জালিকা সৃষ্টি করে। বয়ষ্ক কীড়াগুলো জমিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল খেয়ে ক্ষতি সাধন করে।
প্রতিকার : রাতে আলোর ফাঁদ দ্বারা মথ আকৃষ্ট করে মারা যেতে পারে। কীড়াসহ আক্রান্ত পাতা হাত দিয়ে ছিঁড়ে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করা। এ ব্যাপারে উপদ্রব বেশি হলে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ মোতাবেক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
ফলন : হেক্টরপ্রতি ১.৩-১.৫ টন ফলন পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে মোট ভোজ্যতেলের চাহিদা ৫১.২৭ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে ৪৬.২১ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয়। এর মূল্য ৩.২০ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় ২৭ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আমাদের দেশে তেলফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন ও সূর্যমুখী প্রভৃতি চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সরিষা, তিল এবং সূর্যমুখী থেকেই সাধারণত তেল বানানো হয়। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র ৪ ভাগ তেল ফসলের আবাদ হয়। দেশে মোট ৪.৪৪ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়, যা থেকে ৬.৫ লাখ মেট্রিক টন সরিষা এবং সরিষা থেকে ২.৫০ লাখ টন তেল উৎপন্ন হয়। (সূত্র : এআইএস)

লেখক:
কৃষিবিদ মো. জাহিদুল আমিন অতিরিক্তপরিচালক, ডিএই, যশোর অঞ্চল, কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ আল নোমান প্রশিক্ষক, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঝিনাইদহ

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

17 hours ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

17 hours ago

বিহারের জামুইতে ভগবান বীরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনজাতীয় গৌরব দিবসে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের জামুই জেলায় জনজাতীয় গৌরব দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে…

17 hours ago

২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আগামী ২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। ঐ একই দিনে নান্দেথ…

2 days ago

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তায় ‘সরস মেলা’র উদ্বোধন করবেন ।আগামীকাল তিনি যাবেন…

2 days ago

কলকাতায় এসআইপি অ্যাবাকাস ইন্টারন্যাশনাল প্রডিজি ২০২৪: বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগীদের গাণিতিক দক্ষতার অসাধারণ প্রদর্শন

কলকাতা, ১০ নভেম্বর ২০২৪: অ্যাবাকাস প্রশিক্ষণের অন্যতম শীর্ষ সংস্থা, এসআইপি অ্যাকাডেমি, কলকাতার বিশ্ববাংলা মেলা প্রাঙ্গণে…

3 days ago