সারা বছরই কোনো না কোনো ফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ সারা বছরই কোনো না কোনো গাছে ফল ধরে। আবার অনেক সবজি আছে যেগুলোর ফলই আমরা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। এসব সবজিতে বা একটি বয়স্ক ফলগাছে যেমন ফল ধরে তেমনি ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যায়। ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে যদি সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তাহলে একটি ফলগাছ থেকে বা একটি সবজি ক্ষেত থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন আশা করাই যেতে পারে। অনেকেই ফল ঝরে যাওয়া সমস্যার কারণে ফল চাষের আগ্রহ হারান।বেশকিছু ফলগাছ আছে যেগুলোতে স্ত্রী ও পুরষ গাছ দেখা যায়। যেমন পেঁপে গাছ। পেঁপে বাগানে যদি শতকরা ১০টি পুরষ গাছ রাখা যায়, তাহলে পেঁপের স্ত্রী ফুলের পরাগায়ণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং পেঁপের পরাগায়ণজনিত সমস্যায় ফল ধরা রোধ করা যায়।
এ ছাড়া অনেক ফলগাছে প্রথমদিকে শুধু পুরম্নষ ফুল কিংবা অধিকাংশ ফুলই পুরম্নষ হিসেবে ফোটে, সে ক্ষেত্রে শেষের দিকে পুরম্নষ ফুলের সংখ্যা কমে যায় এবং স্ত্রী ফুলগুলো পরাগায়ণের অভাবে ঝরে যায়। যেমন- কুমড়াজাতীয় গাছে প্রথম ১২-১২ গিঁট পর্যন্ত্ম পুরম্নষ ফুল ফোটে, এরপর পর্যায়ক্রমে স্ত্রী ও পুরম্নষ ফুল ফোটে। আবার শেষের দিকে স্ত্রী ফুলের সংখ্যা বেড়ে যায়, পুরম্নষ ফুলের সংখ্যা কমে যায়। তখন অন্যগাছ থেকে পুরম্নষ ফুল সংগ্রহ করে হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ণ করতে হয়। তাতে ফল সংখ্যা বাড়ানো যায়।নাইট্রোজেনজাতীয় সারের অতিরিক্ত প্রয়োগে বা অতিরিক্ত গ্রহণে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি বেশি হয় বা গাছের তেজ বেশি হয়, এতে ফুল অনিয়মিতভাবে ফোটে বা স্ত্রী ফুলের চেয়ে পুরম্নষ ফুল বেশি ফোটে বা স্ত্রী ফুল দেরিতে ফোটে। এসব কারণে অনেক স্ত্রী ফুল সঠিকভাবে পরাগায়িত না হওয়ায় ফল ঝরে যায়। নাইট্রোজেনের অভাবে ফুলের আকার ছোট হয়। এসব ফুল পরাগায়িত হলেও ফল অনেক সময় ঝরে যায়। গাছে নাইট্রোজেনজাতীয় সার সুষম মাত্রায় প্রয়োগ করলে সমভাবে ফুল ধরার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।ফল গাছে কোনো রোগ দেখা দিলেও ফল ঝরে পড়তে দেখা যায়। যেমন- পেঁপের গোড়া পচা রোগে, নারিকেলের কুঁড়ি পচা রোগে এবং কুলের সাদা গুঁড়া রোগে ফল ঝরে যায়।
এনথ্রাকনোজ বা ফোস্কা পড়া রোগে কচি আম ও পেয়ারা এবং কাঁঠালের মুচি ঝরে যায়। পেঁপেগাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে বা গোড়ার মাটি সঁ্যাতসেঁতে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। নারিকেলগাছে কপারজাতীয়, কুলগাছে ৮০% সালফারজাতীয় ছত্রাকনাশক এবং আম, পেয়ারা ও কাঁঠালগাছে মেনকোজেবজাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। মিলিবাগ বা ছাতরা পোকার আক্রমণ হলে কচি ফল ঝরে পড়ে। কুল, পেঁপে, পেয়ারা, কাঁঠালসহ অনেক ফল গাছেই এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়। গাছে পিঁপড়ার আনাগোনা বেড়ে গেলে গাছের কচি অংশ এবং ফুল বা ফলের বোঁটার কাছে লক্ষ্য করলে ছাতরা পোকা দেখতে পাওয়া যায়। পিঁপড়া চলাচল ঠেকানোর জন্য গাছের গোড়ার চারদিকে ছাই ছিটিয়ে দিতে হয়। এ ছাড়া মিলিবাগের আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরপিডজাতীয় কীটনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে আক্রান্ত্ম অংশসহ পুরো গাছে স্প্রে করতে হয়।অনেক সময় নারিকেলগাছে ইঁদুরের আক্রমণ হলে ফল ঝরে পড়ে। গাছে ইঁদুর ওঠা নিয়ন্ত্রণ করতে গোড়ার চারদিকে ৩ থেকে ৪ ফুট অংশ পাতলা টিন বা পলিথিন দিয়ে এমনভাবে মুড়ে দিতে হয় যেন গাছ ও টিন বা পলিথিনের মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে। এতে টিনের বা পলিথিনের পিচ্ছিলতার জন্য ইঁদুর গাছে উঠতে পারবে না।
অনেক ফল গাছে একই বোঁটায় বা শাখায় এক সঙ্গে অনেক ফল ধরে। এক সঙ্গে ধরার কারণে সব ফলে পুষ্টি একইভাবে পৌঁছায় না এবং সমভাবে পুষ্ট না হওয়ায় ফলের আকার ছোট-বড় হয়। এসব ক্ষেত্রে ছোট ফলগুলো অনেক সময় ঝরে পড়ে। কিন্তু প্রথমেই যদি কিছু ফল ছাঁটাই করে দেয়া যায় তাহলে বাকি ফলগুলো প্রায় একই আকারের ও বড় হয়।
ফল ঝরে পড়ার অনেক অজৈবিক কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা যায় খরায় মাটিতে রসের অভাব হলে। এতে মাটি থেকে গাছ পুষ্টি উপাদান বা খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না এবং ফল ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায়। খরার সময়ে হঠাৎ বৃষ্টি হলে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যায় অথবা খরার সময় মাটিতে হঠাৎ রসের পরিমাণ বেড়ে গেলে ফল ও ফলের বোঁটার সংযোগ স্থলে একটি নির্মোচন স্ত্মর তৈরি হয়। এতে কচি ফল ঝরে পড়ে। নিয়মিতভাবে সেচ দিয়ে মাটির রসের পরিমাণ যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে ফল ঝরা কমানো যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের আবহাওয়ায় এরকম পরিস্থতির সৃষ্টি হলে আম ও লিচুর গুটি ঝরার পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পর বা রাতে গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার ব্যবস্থা করলে ফল ঝরা কমানো যায়।
সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ না করার কারণে গাছে পুষ্টির অভাব হলে ফল ঝরে পড়তে পারে। বিশেষ করে পটাশিয়ামের অভাব হলে ফল ঝরা বেশি হয়। বোরণের অভাবেও ফল ঝরে। ক্যালসিয়ামের অভাবে টমেটো ও মরিচে ফলের বোঁটা পচা রোগ দেখা যায়, শেষে ফল ঝরে যায়। এসব পুষ্টি উপাদানযুক্ত সার স্প্রে করে বা গোড়ায় প্রয়োগ করে ফল ঝরা প্রতিরোধ করা যায়। পুষ্টির অভাবের পাশাপাশি গাছের ভেতরে হরমোনগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে। হরমোনের অভাব বা সঠিক মাত্রায় গাছের ভেতরে হরমোন তৈরি না হলে, অনেক সময় ফুল ধরলে এবং পরাগায়ণ হলেও বেশির ভাগ ফলই ঝরে পড়ে বা আকারে খুব একটা বড় হয় না। গাছে হরমোনের সাম্যতা ঠিক রাখার জন্য সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
ফলন্ত্ম গাছের ওপর দিয়ে যদি ঝোড়ো বাতাস বয়ে যায় তাহলে ছোট-বড় সব আকারের ফলই ঝরে পড়তে পারে। এজন্য ফল বাগান করার সময় বাগানের চারদিকে বিশেষ করে পশ্চিম ও উত্তরদিকে বাতাস প্রতিরোধী গাছ যেমন- নারিকেল, তাল, খেজুর, জাম, মেহগনি, বাবলা গাছ রোপণ করা যেতে পারে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহে গাছের ফল না ঝরলেও গাছের পাতায় শীতের ক্ষত দেখা দিতে পারে এবং গাছে খাবার উৎপাদন ব্যাহত হয়ে গাছ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এতে কিছু ফল ঝরেও যেতে পারে। শৈত্যপ্রবাহের সময় নিয়মিতভাবে শুধু পানি পাতায় স্প্রে করলে পাতা শীতের ক্ষত থেকে রক্ষা পায় এবং পরে ফল ঝরা অনেক কমে যায়।
গ্রীষ্মকালে বাতাসের তাপমাত্রা বেশি এবং আর্দ্রতা কম থাকলে ফল ঝরে পড়ে। ফলের ভেতরের ও বাইরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পার্থক্যের কারণে ফলের বোঁটা দুর্বল হয়ে ফল ঝরে পড়ে। আবার তাপপ্রবাহেও গাছের জৈবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দৈহিক বৃদ্ধিও স্থবির হয়ে পড়ে। গাছে ভেতরে ও বাইরে আর্দ্রতার হেরফের হওয়ায় ফল ঝরে পড়তে শুরম্ন করে। তাপপ্রবাহের সময় নিয়মিতভাবে মধ্যরাতের দিকে গাছের গোড়ায় ও স্প্রে মেশিন দিয়ে গাছের পাতায় স্প্রে করলে ফল ঝরা অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।
কোনো একটি ফল গাছে বা ফল বাগানে ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যা একটি না হয়ে এক সঙ্গে একাধিকও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সঠিক কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এ ব্যাপারে যদি বিশেষ কোনো পরামর্শের প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে নিকটবর্তী উপজেলা কৃষি অফিস বা হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। ফল ঝরে যাওয়ার সঠিক কারণ বের করে যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে ফল গাছ বা ফল বাগান থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন অবশ্যই পাওয়া সম্ভব।