আমি রাই কিশোরী
অনিন্দিতা মাইতি নন্দী
আমি রাইকিশোরী, জীবনের অনেকটা কঠিন পথ পেরিয়ে এসেছি। আপনারা আমায় চিনবেন না, চেনার কথাও নয়, আসলে জীবনে এমন কিছু মহৎ কাজ করিনি যে আপনারা আমায় চিনবেন এক ডাকে। তবু এই চলমান জীবনের অনেকটা উঁচু-নীচু পথে এলোমেলো পায়ে এগোতে এগোতে আজ হঠাৎ জীবনের সবকিছু যখন প্রায় থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বিশ্বত্রাস মহামারির প্রবল পরাক্রমের কাছে, তখন মনে হল আপনাদের সবার সাথে মনের কথা একটু ভাগ করে নিই। হয়ত বা আর কখনো বলার অবকাশ পাবোনা।
বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ থেকে জানালা খুলে দেখি, সামনের চৌকো মাঠটা ফাঁকা, একদম একাকী মাঠ,- যেন তীব্র চিৎকারে ডাকছে সমস্ত শিশুদের, কিশোরদের- ‘ওগো ছেলের দল, এসো আমার বুকে লাফালাফি কর। তোমাদের কলতানে, তোমাদের দাপাদাপি, ফুটবল, ক্রিকেট, চিৎকারে ভরিয়ে দাও।’
সামনের খালি পার্কের বেঞ্চগুলি যেন আবাল-বৃদ্ধ বনিতাদের হাতছানি দিয়ে বলে, ‘আমার কোলে বসে তোমরা তোমাদের মনের কথা বলবে এসো।’ আবাসনগুলির এবং প্রত্যেকটি বাড়ির শিশু, কিশোরেরা জানালার ধারে বসে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, অবাক বিষ্ময়ে ভেবেই পায় না তারা, কেন তাদের খেলতে মানা, কোথাও যেতে বারণ!! সারাদিন গৃহবন্ধী, শৈশব!! কোথায় হারিয়ে গেল তাদের স্কুল জীবন? বন্ধুদের সাথে মাতামাতি, টিফিন ভাগ করে খাওয়া, ঝগড়া করে আবার ভাব করে নেওয়া। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক শিক্ষিকাদের উজাড় ভালোবাসা সব যেন মরিচীকা। স্কুলের টিফিন বাক্স যেন অসহায় ভাবে বলছে আর কতদিন? স্কুলব্যাগটা নিঃশব্দে কাঁদে, যেন অনেক জমা ব্যথায় ডুকরে ওঠে, স্কুলের গেট নীরবে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে, যেন কাতর স্বরে মিনতি করছে: ‘ওগো দামাল ছাত্রছাত্রী দল,তাড়াতাড়ি ফিরে এস আমার কাছে, তোমরা ছাড়া আমি মূল্যহীন,দ্যুতিহীন জড়পদার্থ মাত্র’।
এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের শৈশবের স্মৃতি ভীড় করে আসে মনে- চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই। একে একে স্মৃতি পটে ভেসে আসে আমার হারিয়ে যাওয়া রঙ্গিন শৈশবের দিনগুলি, – “একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক কালের কথা।”
তখন ঠিক কতো বয়স আমার জানি না- হয়ত তিনবছর, বাড়ীর সামনেই ১০০মিটারের মধ্যে দুখানা বড় মন্দিরের পাশেই নাট মন্দির। প্রতি বছরই চৈত্র মাসে চড়ক, গাজন, ওড়া ইত্যাদি হতো, সাথে শিবমন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা। ঐ সময়ে বিশেষ আকর্ষণ ছিল পাড়ার সকলে মিলে যাত্রা করা। আমি মায়ের কোলে চেপে নাটমন্দিরে, সামনের মঞ্চে যাত্রা চলছে- কী হচ্ছে না হচ্ছে বোঝার ক্ষমতা নেই আমার- হঠাৎ একজন বিকলাঙ্গ রূপী ভয়ানক দর্শণ অভিনেতা, ঐ মঞ্চ থেকে নেমে গ্রীণরুম যাওয়ার পথে নাটমন্দিরে এসে আমাকে ওনার কাছে নিতে চাইলেন!! সজোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠি ভয়ে, মা’কে প্রবল ভাবে জড়িয়ে ধরি ,পরক্ষণেই চমকে উঠি, ঐ মানুষটির ডাকে, ‘রাই, আমি বাবা- আয় মা কোলে আয়।’
আবার কিছুদিন পরে গ্রামের সকলে মিলে ‘মেঘনাদ বধ’ পালা অভিনয় মঞ্চস্থ হচ্ছে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি ,হটাৎ মেঘনাদ রুপে সজ্জিত ‘বাবা’ কে লক্ষনের রূপধারী অভিনেতা তীর নিক্ষেপ করলে, ছুটে মঞ্চের ওপর শায়িত তীরবিদ্ধ ‘বাবা’ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি । দুঃখ হয় দেখে ,এই প্রজন্মের শিশুরা ‘যাত্রা’ কি জিনিস তার স্বাদ থেকে প্রায় বঞ্জিতই রইল।
আমাদের ছেলেবেলায় স্কুলে ভর্তি হবার জন্যে এত চাপ ছিল না, ইস্কুল প্রাঙ্গণ ছিলো আনন্দ নিকেতন। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে একসাথে হেঁটেই স্কুলে চলে যেতাম। ইস্কুলে যাবার জন্য না ছিল কোন ইস্কুল ভ্যান, আবার ইস্কুলে পৌঁছে দেবার জন্যও কেউ যেতেন না। আমরা ছাত্রছাত্রীদল নিজেদের মতো করেই দলবেঁধে একসাথে পৌঁছে যেতাম। প্রথম দিকে শ্রেণীকক্ষে নীচে বসেই দুলে দুলে সব্বাই ‘সহজ পাঠ’, ‘কিশলয়’, ‘গণিত মুকুল’ নামতা বলতাম। টিফিন হলেই ইস্কুলের পেছনে একটি বড় তেঁতুল গাছের নীচেই চলত এক্কা দোক্কা, গোল্লাচুড়ি, সীতাহরণ, রুমাল চুরি খেলা। হেডমাষ্টারমশাই অফিসরুম থেকেই সব লক্ষ্য করতেন। আমাদের দুষ্টুমি, দাপাদাপি, চঞ্চল প্রকৃতি যে ওনার ভালো লাগতো- তা বুঝলাম কিছুদিন পরেই। গদি খেলার সময় এক সহপাঠীর সাথে ঝামেলা হওয়ায়, সে গেল অফিস রুমে আমার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে। ব্যাস, ভয়ে একদম সিঁটিয়ে আছি- অফিস রুমে ডাক পড়েছে আমার, হেডমাষ্টারমশাই দুজনের কাছ থেকেই সব শুনলেন ,আমার দুচোখে তখন ভয়ে জল বইছে, হঠাৎ মাষ্টারমশাই আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “রাই তুই তো আমার নুরজাহান, তুই কাঁদছিস কেন? জানিস ‘নুরজাহান’ মানে ‘জগতের আলো’, যা দুই বন্ধু খেলবি যা।”
তবু ভয় যায় না, দাঁড়িয়ে আছি দেখে হেডমাষ্টারমশাই অদ্ভুতভাবে বলে উঠলেন,
“সে ছেলে কে চায়? বলো কথায় কথায়–
আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়।”
অমনি বন্ধুর হাত ধরে খেলার মাঠে দৌড়ে গেলাম দুজনেই। এখনো আপনার কথা ভীষণ মনে পড়ে মাষ্টারমশাই। ভাবি আমাদের পরের প্রজন্ম তো আজ বছর খানেকের বেশী ঘরবন্দী, তাদের সরাসরি সংযোগ নেই আজ- শিক্ষকমশাইদের সঙ্গে। হয় মোবাইল ফোনে কিংবা Google Meet, Zoom App –এ কেবল মাষ্টারমশাইদের গলা শুনে পড়তে অভ্যস্ত। মোবাইল স্ক্রীনে তাকাতে তাকাতে চোখের জল আজ শুকিয়ে গেছে ছাত্রছাত্রীদের। কোথায় হারিয়ে গেছে তাদের জীবনের সহজ ছন্দ। আজ তারা শুধুই যন্ত্রমানব শিশু।
বিকেলবেলায় পাড়াতে সব ছেলেমেয়েরা একসাথে জড়ো হতাম খেলার মাঠে- “হৈ হৈ করে পাল্লা দিয়ে ডাংগুলি, পিট্টু, কিতকিত ,কাবাডি কিংবা ক্রিকেট খেলা চলত। ছোটবেলা থেকেই দুরন্তপনায় আমার জুড়ি মেলা ভার ,ডাংগুলি ,পিট্টু ,কিংবা ক্রিকেট সবেতেই আমি সিদ্ধহস্ত। পিট্টু খেলাটি ছিল আমার ভীষণ পছন্দের,– টালিভাঙ্গা গুলি সংগ্রহ করে অনেক যত্নে সবাই সেগুলিকে একটি গোল ধরণের তৈরী করে, অনেকগুলি গোল গোল টুকরো টালিভাঙ্গা একটার ওপর একটা চাপিয়ে অনেকটা উঁচু তৈরী করা হতো । তারপর নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব থেকেই বল দিয়ে টালিগুলোকে একের পর এক ফেলা হতো।
ইস্কুলে সবচেয়ে অপেক্ষার সময় ছিল আমাদের, কখন মাষ্টারমশায় এসে পাঁউরুটি সব্বাইকে দেবেন। আসলে আমাদের ছাত্রজীবনে ইস্কুলে ‘মিড ডে মিল’ সিস্টেম ছিল না। বরং আমাদের টিফিনের আগে পাঁউরুটি দেওয়া হত, তাই-ই ছিল অমৃত সমান। কত না তূপ্তি করে সব্বাই খেতাম। একবার ইস্কুল চলাকালীন দেখলাম বহু ছাত্রছাত্রী অফিস রুমের সামনে, লম্বা লাইন দিয়ে অপেক্ষায়,– ব্যপারটা না বুঝেই ঐ লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম, এক মাষ্টারমশাই দেখেই বলে উঠলেন, “রাই, তুই কেন দাঁড়ালি? এটা তো ইস্কুলের জামা প্যাণ্ট পাওয়ার লাইন।”
মাষ্টারমশাই জোর করে আমায় বের করে দিলেন। লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম অনেক ছাত্রছাত্রী কেউ গাঢ় নীল রংএর জিব ওয়ালা ফ্রক, কেউ বা নীল প্যাণ্ট সাদা জামা পেল। আমি তো হাপুস নয়ণে কাঁদছি দুঃখে ,-প্রাণে বড্ড ব্যথা, ঐ অমূল্য সম্পদ নীল রংএর জিব ওয়ালা ফ্রক পাইনি বলে। বাড়ী ফিরে বাবা’র কাছে জেনেছি, যারা একদম দুঃস্থ পরিবার শুধুমাত্র তারই এটা পাবে। কী আর করি!! মনের দুঃখে ছোটদের মহাভারত পড়ছি- এমন সময় শুনি আজ মাঠে পরপর দুটি যাত্রা হবে, ‘গান্ধারী জননী’ ও ‘আমি সুভাষ বলছি ‘ কলকাতার নামকরা একটি যাত্রাসংস্থার যাত্রাপালা।
খুব বেশী কিছু মনে নাই যাত্রাটির, তবে যা ভেবে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়- ‘আমি সুভাষ বলছি’ তে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা, খুশি কে গীত গাইয়ে যা’ গানটির সাথে সুভাষরূপী চরিত্রাভিনেতা মঞ্চে প্রবেশ করতেই ,সমস্ত দর্শকমন্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত করতালি ধ্বনি তে স্বাগত জানালেন এমনভাবে যেন স্বয়ং নেতাজি ওনাদের সামনে এসেছেন ,- আবার মঞ্চে ‘গান্ধারী জননী’র সম্ভবতঃ দ্বিতীয় দৃশ্য চলছে। আলুথালু বেশে গান্ধারী কুরুক্ষেত্র শ্মশানে ‘দুর্যোধন’ বলে ক্রন্দনরত অবস্থায় পার্ট বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন, পার্ট ভুলে যাওয়ায় সমস্ত দর্শক চিৎকার করছে এমত অবস্থায় গ্রীণরুম থেকে কোন এক অন্য শিল্পী মঞ্চে এসে নিজের মতো কিছু একটা বলতে বলতে ‘গান্ধারী’ চরিত্রাভিনেত্রীর পাট -এর ক্লু ধরিয়ে গেলেন, -আবার শুরু হল পুরো যাত্রা ।
বার্ষিক পরীক্ষার শেষে সবচেয়ে মজার ছিল গরুর গাড়ীতে চেপে ধানের ক্ষেতে যাওয়া। সারাদিন ধান কাটা, বিড়ে বাঁধা দেখা এবং ধানের শীষ কুড়ানো অদ্ভুত এক আনন্দের। মাঠে যাওয়ার সময় গরুর গাড়িতে চেপে গেলেও ফেরার সময় গাড়ি ভর্তি ধানের বিড়া, তাই গরুর গাড়ীর পেছন পেছন ধানের শীষ ভরা ঝুড়ি হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে বাড়ী ফেরা।
আমাদের ইস্কুলের পাশেই একটা বড়ো মেলা বসতো। সহপাঠীরা সবাই বলল মেলায় নাকি একজন ম্যাজিসিয়ান এসেছেন। আমরা বন্ধুরা মিলে চললাম ম্যাজিক দেখতে।ম্যাজিসিয়ান প্রথমেই চমক দিলেন কমলাভোগ মিষ্টান্ন থেকে পান্তুয়া তৈরী করে। পরক্ষণেই আবার আগুন ছাড়াই একটি গোটা কাঁচা ডিম সেদ্ধ করে দেখালেন। আমাদের দর্শক থেকে একজনকে মঞ্চে ডেকে তার হাতের উপর রুমালে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। রুমাল অক্ষত থাকলো অথচ আগুন জ্বলতেই থাকল।
বাড়ী ফিরে এরপর কিছুদিন আমরা শুধুই ম্যাজিক নিয়েই ভাবতে থাকি। এমন সময় এক সহপাঠী বলে, ‘রাই, তোর বাবা তো অনেক সময় মঞ্চে যাত্রায় অভিনয় করার সময় ম্যাজিক দেখাতেন, তাঁর কাছ থেকে কিছু জানা যাবে না?’ ব্যাস সবাই মিলে চললাম- বাবা শুনে রাজী হলেন মেলাতে দেখা ঐ ম্যাজিকগুলি আমাদের সবাইকে দেখাতে। এই ফাঁকে তোমাদের চুপি চুপি বলি- একটু বড় হয়ে বুঝেছিলাম এগুলো সবই রসায়ণের কারসাজি। রসায়ণের বিভিন্ন বিক্রিয়াগুলিকে কাজে লাগিয়ে দর্শকদের ধোঁকা দেওয়া হয়। বাবার কাছ থেকে ছোট বেলায় শিখে নেওয়া সেই ম্যাজিকগুলি আজ তোমাদের বলে দিই।
আমরা সবাই জানি রুমালে আগুন ধরালে রুমালটি পুড়ে যাবে। কিন্তু যদি রসায়ণের সাহায্য নিই তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে। রুমাল ভাঁজ করে হাতের তালুর উপর রেখে মন্ত্রপুত তরল ঢেলে যদি রুমালে আগুন ধরানো যায় তবে দেখা যাবে আগুন জ্বলছে অথচ রুমাল পুড়ছে না। আসলে ঐ মন্ত্রপুত তরলটি হল ১:৪ অনুপাতে ইথাইল অ্যালকোহল এবং জলের মিশ্রণ। ইথাইল অ্যালকোহল ও জলের মিশ্রণটি খুবই তাড়াতাড়ি বাস্পীভূত হয়ে যায় ফলে খুব ঠাণ্ডা হয়। সেইজন্যই রুমালটিতে আগুন ধরে না।
এর পরের খেলাটি হল বিনা আগুনে ডিম সেদ্ধ করা। একটি মাটির হাঁড়িতে কাঁচা ডিম রেখে তার মধ্যে দুই বা তিন গ্লাস মতো ঠান্ডা জল ঢেলে হাঁড়ির মুখটি মাটির ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দিলে কিছুক্ষণ বাদে দেখা যাবে কাঁচা ডিমটি সিদ্ধ ডিম হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সত্যি মজার তো! কেমন করে আগুন ছাড়াই ডিম সেদ্ধ হয়ে গেল? আসলে প্রথমে কাউকে বুঝতে না দিয়ে হাঁড়ির মধ্যে পাথুরে চুন বা ক্যালসিয়াম অক্সাইড ভরে রেখে তার মধ্যে একটি কাঁচা ডিম ভরে দুই বা তিন গ্লাস জল ঢেলে হাঁড়িটি ঢাকনা বন্ধ অবস্থায় রাখলে, ক্যালসিয়াম অক্সাইড জলের সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড বা কলিচুনে পরিণত হয়, সাথে প্রচুর পরিমাণে তাপ নির্গত হয় কারণ এটি তাপমোচী (Exothermic) বিক্রিয়া। সেই নির্গত তাপে জল ফুটতে শুরু করে এবং ডিমটি সিদ্ধ হয়ে যায়।
তৃতীয় খেলাটি সবচেয়ে মজার কমলাভোগ থেকে পান্তুয়া প্রস্তুতি। তবে এই পান্তুয়াটি কিন্তু কোনভাবেই খাওয়া যাবে না। মিষ্টির কথা এলেই মন ছটপট করে, জিভে জল আসে। কমলাভোগ একটি হলুদ রঙের বড় মিষ্টি। এই মিষ্টিটি হাতে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে একটি বিকারের মধ্যে রেখে তার মধ্যে আবার মন্ত্রপুত তরল এমনভাবে ঢালতে হবে যাতে কমলাভোগ মিষ্টিটি তরলের মধ্যে ডুবে থাকে। এরপর বিকারটি বার্ণার বা স্পিরিট ল্যাম্প দিয়ে গরম করলেই হলুদ কমলাভোগ মিষ্টিটি লাল রঙের পান্তুয়াতে পরিণত হবে। আসলে এই খেলার মধ্যেই রসায়ণের অপূর্ব রসনিহিত রয়েছে। রসায়ণবিদ্যার প্রয়োগেই এটাই সম্ভব। আমরা জানি, কমলাভোগ বা হলুদ রঙের মিষ্টিতে থাকে টারটাজিন নামক একটি রঞ্জক পদার্থ। তবে অনেক সময় টারটাজিন না মিশিয়ে পরিবর্তে অন্য একটি ক্ষতিকারক রঞ্জক পদার্থ মেটালিন ইয়োলো মিশিয়ে হলুদ রঙ বিশিষ্ট কমলাভোগ তৈরী করা হয়।
এবার আসি মূল ম্যাজিকটিতে, কীভাবে রসায়ণের প্রয়োগ হল। দর্শকদের কথার মাধ্যমে ভুলিয়ে কমলাভোগে ভালো করে মেটালিন ইয়োলো রঞ্জক পদার্থের পাউডার মিশিয়ে নিয়ে বিকারের মধ্যে রেখে, মন্ত্রপুত তরল (যা আসলে লঘূ হাইড্রক্লোরিক অ্যাসিড, HCl) আস্তে আস্তে বিকারের মধ্যে এমনভাবে ঢালা হল যাতে কমলাভোগটি পুরোপুরি অ্যাসিডের মধ্যে ডুবে থাকে, এরপর বার্নার বা স্পিরিট্ ল্যাম্প দিয়ে গরম করলে হলুদ রঙের কমলাভোগটি লাল রঙের মিষ্টি পান্তুয়ার মতো মনে হবে। এবার বলি আসল রহস্য হল- অ্যাসিড দ্রবণে (লঘূ HCl) মেটালিন ইয়োলো রঞ্জক পদার্থটি বেঞ্জোকুইনোন গঠন করে ফলে রঙের পরিবর্তনে হলুদ থেকে পিঙ্ক বা সামান্য হালকা লালাভ বেগুনি রঙের পান্তুয়ার মতো দেখতে হয়।
এই মাজিকগুলি ছোটবেলার স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেও অসহায় লাগে , ভাবি যদি সত্যি সত্যি জাদুকর সরকারের মতো সব্বার চোখের সামনে প্যাসেঞ্জার ভর্তি ট্রেন কে ভ্যানিশ করার মতো, বর্তমান মহামারী অবস্থাকেও ভ্যানিশ করতে পারতাম! বিজ্ঞান যেন কেমন নিরুপায় আত্মসমর্পন করেছে ক্ষুদ্র জীবাণুর কাছে। যদি ফুটফুটে শিশুগুলির দুরন্ত শৈশব ফিরিয়ে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারতাম , যদি সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে যেত। !