আসছে। আবারও সে আসছে। সব কিছু তছনছ করে দিতে। সঙ্গে টেনে আনছে সাগরের নোনা জলকে। ঝড়ের ঝাপটায় সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে সাগরের জলের ঢেউয়ে সব ডুবিয়ে দিতে চাইছে। যেমনটি ঠিক ১২ বছর আগে আয়লা নামের ঝড় এসে সব কিছু শেষ করে দিয়েছিল। এও আসছে আবার সব কিছু শেষ করে দিতে। আর সেই ধ্বংসের আগাম প্রহর গোণা শুরু করে দিয়েছে সুন্দরবন। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। সুন্দরবনেরও সেই অবস্থা। আয়লা, আম্ফান আর এবার যশ। কাঁপছে সুন্দরবনবাসী।
আম্ফানের ভয়াবহ স্মৃতি উসকে এখন যশের আতঙ্কে প্রহর গুনছে সুন্দরবন। আর শুধু সুন্দরবন কেন, উত্কন্ঠার দিন গুনছে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা।২০০৯ সালে আয়লার তাণ্ডবে আর জলোচ্ছ্বাসে এই সুন্দরবনের সব নদী বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকায়। তার জেরে নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয়েছিল বিঘার পর বিঘা কৃষি জমি। ভেঙে গিয়েছিল ঘরবাড়ি। ভেসে গিয়েছিল মিঠে জলের পুকুর, মাছের ভেড়ি। ভিটেমাটি হারিয়ে নিমেশে খোলা আকাশের তলায় ঠাঁই হয়েছিল অনেকের। তার দশ বছর বাদে গত বছরে হানা দিয়েছিল আম্ফান। সেই একই ছবি আবারও ফিরে এসেছিল রাতারাতি। ততদিনে নদীবাঁধ কোথাও কোথাও সারাই হয়েছিল কোথাও বা হয়নি। সব কিছু হারানো মানুষগুলো ১০ বছর ধরে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আম্ফান সেখানেও ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে। এক বছর পর আরও একটা ঘূর্ণিঝড় আসছে ধেয়ে। আগামী বুধবার আছড়ে পড়বে যশ। আর সেই আতঙ্কেই বুক কাঁপছে সুন্দরবনের বাসিন্দাদের। তাঁরা বলছেন, ‘এই তো সবে একটা মাথা গোজার ঠাঁই তৈরি করেছিলাম। আবার ঝড় আসছে। কী হবে জানি না।’ সুন্দরবনবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছে প্রশাসন। এলাকায় এলাকায় চলছে মাইকিং। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় কোমর বেঁধে প্রস্তুত জেলা প্রশাসনও। আগামিকাল থেকেই সকলকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গোটা জেলায় ১১৫টি সাইক্লোন সেন্টার ইতিমধ্যেই খুলে দেওয়া হয়েছে। কাল থেকেই সেখানে সবাই আসতে শুরু করবে। তৈরি রাখা হয়েছে জেলার গ্রামীণ এলাকার সব স্কুল বাড়িগুলিকেও। বাঁধের ওপর বসবাসকারীদের উচুঁ জায়গায় কিংবা সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সতর্ক রয়েছে উপকূলরক্ষী বাহিনীও। আতঙ্কে দিন কাটছে উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, হাড়োয়া-সহ একাধিক এলাকার মানুষদেরও। যশের সম্ভাব্য অভিমুখ ওড়িশা উপকূল। তবে যে কোনও মুহুর্তে সে বাঁক নিয়ে হাজির হতে পারে বাংলার বুকে। সেক্ষেত্রে তার প্রথম ধাক্কাই লাগবে দুই ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবনের বুকে। মঙ্গলবার থেকেই দুই ২৪ পরগনা জেলায় বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে। এরপর সময় যতই গড়াবে ততই বাড়বে ঝড়ের বেগ আর বৃষ্টির জোর। ইতিমধ্যেই দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার সাগর, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, কাকদ্বীপ, কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হিঙ্গলগঞ্জ ও সন্দেশখালী এলাকায় লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এই সব এলাকার প্রতিটি ব্লক প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে সেখানকার সব সাইক্লোন শেলটারগুলি প্রস্তুত রাখতে। সঙ্গে চাল, ডাল, ত্রিপল ও খাদ্যপণ্যও সেখানে মজুত করতে। ইতিমধ্যেই ওই সব এলাকার নীচু জমির বাসিন্দাদের সরিয়ে আনা হয়েছে। মত্স্যজীবীদের সমুদ্রে যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছে নবান্ন। প্রশাসনে তরফে ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষকে বলা হচ্ছে, বাড়িতে যেসব খাদ্যশষ্য, প্রয়োজনীয় নথি রয়েছে তা গুছিয়ে রাখুন। এলাকার জলনিকাশী ব্যবস্থা ঠিক রাখুন। পাশাপাশি ঝড় সম্পর্কে সবসময় খবর রাখুন। পরিস্থিতি সেরকম বুঝলে কাছাকাছি ফ্ল্যাড সেন্টারে গিয়ে আশ্রয় নিন।