নীলমাধব অধিকারী: আজ আপনাদের বলবো এই বাংলার বিখ্যাত এক মিষ্টির কথা। সেটি হলো শক্তিগড়ের ল্যাংচা। ল্যাংচা আর শক্তিগড় এই নাম দুটি যেন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে । তবে শক্তিগড় আর ল্যাংচা এই নাম দুটি একে অপরের পরিপূরক হলেও ল্যাংচার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার আরো এক জায়গার নাম, সেই জায়গাটি হল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর। ল্যাংচার সৃষ্টিরহস্যে এই কৃষ্ণনগর জায়গাটির অবদানও কিছু কম নয়। শক্তিগড়ের পাশাপাশি ল্যাংচার সঙ্গে কিভাবে জড়িয়ে পড়ল কৃষ্ণনগরের নাম আসুন সেই কাহিনীই আমরা জেনেনি আজ। সে আজ অনেক কাল আগের কথা, শোনা যায় যে কৃষ্ণনগর ও বর্ধমান এই দুই রাজপরিবার নাকি এক সময় আবদ্ধ হয়েছিল পারস্পরিক বৈবাহিক সম্পর্কে অর্থাৎ কৃষ্ণনগরের রাজার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বর্ধমানের রাজার ছেলের। বিয়ের কিছুদিন পর রাজকুমারী অন্তঃসত্ত্বা হলে কৃষ্ণনগররাজ তার কন্যাকে নিয়ে আসেন আপন গৃহে। সবার মনে আনন্দ নতুন অতিথির আগমন ঘিরে কিন্তু এমন খুশির সময়েই রাজবাড়ীতে তৈরি হয় এক নতুন বিপত্তি।সে বিপত্তিটি হল রাজকুমারীর দেখা দেয় বেজায় অরুচি, কিছুই সে খেতে চায় না; তার মুখে কিছুই রোচে না। রাজবাড়ীর রাজভোগও তার বিস্বাদ মনে হয়।মেয়ের এই অবস্থা দেখে রাজামশাই তো পড়লেন মহা দুশ্চিন্তায়। ডাক পড়লো রাজ্যের তাবড় তাবড় হাকিম কবিরাজের কিন্তু তারাও কিছুই করতে পারলো না এমন সময় হঠাৎ একদিন দেখা দিল আশার আলো।
রাজকন্যা নিজেই বাতলে দিল তার অরুচির সমাধান। পিতাকে ডেকে সে বলল যে রসে ডোবানো এক ধরনের ভাজা কালো রংয়ের মিষ্টি সে খেয়েছিলো কৃষ্ণনগরেরই এক ময়রার হাতে সেই মিষ্টি এখন যদি সে পায় তবে তার মুখের অরুচি যায় কিন্তু কোথায় বা সেই মিষ্টির দোকান আর কি ই বা সে ময়রার নাম এসব কিছুই বলতে পারেনা কন্যা। শুধু এইটুকুই সে বলে যে ময়রার কাছে সে ওই মিষ্টি খেয়েছিল সেই ময়রার একটি পা খোঁড়া তাই সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। মেয়ের মুখে এই কথা শোনামাত্র রাজা তখনই কৃষ্ণনগরের সমস্ত ময়রা কে হাজির করার নির্দেশ দিলেন রাজবাড়ীতে। তখন রাজার আদেশ মত কৃষ্ণনগরের সমস্ত ময়রাকে হাজির করা হলো রাজার সামনে এবং সত্যিই দেখা গেল যে তাদের মধ্যে এমন একজন রয়েছে যার এক পা খোঁড়া আর সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। খুঁড়িয়ে বা লেংচে হাঁটার জন্য তাকে সবাই ডাকতো ল্যাংচা ময়রা বলে। রাজার মুখে সব কথা শুনে সেই ময়রা তখন রাজকন্যা কে তৈরি করে খাওয়ালো ঘিয়ে ভাজা রসে ডোবানো কালো রংয়ের একটু লম্বাটে অপূর্ব স্বাদের সেই মিষ্টি। সেই মিষ্টি খেয়ে তো রাজকন্যা মহাখুশি তার এতদিনের অরুচি দূর হলো।
আর রাজার মুখেও দেখা দিলো হাসি, রাজবাড়ির সবাই ধন্যি ধন্যি করল সেই মিষ্টি খেয়ে যেহেতু ল্যাংচা ময়রার হাতেই এই মিষ্টির সৃষ্টি তাই ল্যাংচা ময়রার নামেই সেই মিষ্টির নাম রাখা হল ল্যাংচা। এতদিন পরে মেয়ের মুখে হাসি দেখে রাজামশাই মহা খুশি হলেন সেই ময়রার উপর এবং প্রচুর ভুসম্পত্তি ও উপঢৌকন দিয়ে সম্মানিত করলেন সেই ময়রা কে। রাজার কাছে উপহার পেয়ে সেই ময়রা তখন আর কৃষ্ণনগরে থাকলো না সে চলে এলো বর্ধমানে এবং বর্ধমানের শক্তিগড় নামক জায়গায় সে গড়ে তুলল তার নতুন বসতি। ল্যাংচা ময়রার তৈরি লাংচার সুনাম তখন ছড়িয়ে পড়ল দিগ্বিদিকে এবং তা বিখ্যাত হল শক্তিগড়ের ল্যাংচা নামে। যার মহিমা আজও অবিচল, শুধু বাংলাতেই নয় ; বাংলা ছাড়িয়ে ভারত তথা গোটা বিশ্ব দরবারে।