তৌহিদুর রহমান: গ্রামের শীতের সকাল। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সাতক্ষীরা। শীতের মধ্যে সাধারণত তাপমাত্রা নিচের দিকে থাকে এই অঞ্চলে। প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে মুক্তি পেতে আগুনের আঁচ নিতে গিয়েই ঘটে যায় বিপত্তি। আগুন লেগে পুরে যায় রেহানারর শরীরের অনেক অংশ। চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সে যাত্রায় বেঁচে যায় রেহেনা। কিন্তু শুরু হয় নতুন জীবন-যুদ্ধ। কিছুদিন পর মায়ের মৃত্যু, তারপর সংসারের হাল ধরতে রেহানা শুরু করে সেলাইয়ের কাজ। কিন্তু রেহানার নেই কোন নিজস্ব সেলাই মেশিন। রেহেনার খবর শুনেই পাশে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ‘সংযোগ’।
২০২০ সালের মার্চ মাসে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট) এর একদল প্রাক্তন শিক্ষার্থী আর বিভিন্ন পেশার কিছু তরুণের উদ্যোগে ‘সংযোগ Connecting People’ একটি ফেসবুক গ্রুপ এর মাধ্যমে পথ চলা শুরু করে। সারা বিশ্বে যখন করোনার ছড়াছড়ি ঠিক তখনই বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক আশার আলো নিয়ে সামনের লাইনে আসে সংযোগ। সংযোগের ফাউন্ডার আহমেদ জাভেদ জামালের কথায়, ”দেশের করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট) একদল সাবেক শিক্ষার্থীসহ আর বিভিন্ন পেশার কিছু তরুণের প্রচেষ্টা এই সংযোগ: কানেক্টিং পিপল নামের সংগঠনটি। মূলত দাতা ও গ্রহিতার মেলবন্ধনের জন্য কাজ করছে সংযোগ: কানেক্টিং পিপল। ”
সংযোগের একমাত্র লক্ষ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বলেন মি. জামাল।
কোভিড -১৯ যখন পুরোদমে সাধারণ মানুষের নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে তখনই বাংলাদেশে সংকট পড়ে অক্সিজেনের। বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ খালি না থাকা এবং তীব্র অক্সিজেন সংকটের মধ্যেই দেশব্যাপী অক্সিজেন ও সিলিন্ডার সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয় সংযোগ। পরবর্তীতে অনলাইনের মাধ্যমেই প্লাজমা ও দাতা সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয় সংযোগ এর পক্ষ থেকে। সংযোগের ফাউন্ডর বলেন, এপ্রিলে (২০২০) সারা দেশে প্রায় সাত হাজার মেডিকেল পিপিই,দশ হাজার মাস্ক (সার্জিক্যাল এবং রেস্পাইটরি মাস্ক), দুই হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রায় শতাধিক হাসপাতালে সরবরাহ করে সংযোগ। যা সংযোগ দাতাদের কাছ থেকে উপহারর হিসেবে পেয়েছিল।
চিকিৎসা কর্মীদের পিপিপি বিতরণের পর লক ডাউনে বন্ধ হতে যাওয়া স্কুল গুলোর শিক্ষকদের, দুই হাজারের উপর শিক্ষককে সংযোগ এককালীন অর্থ সহায়তা (৩০০০/- টাকা করে)র উদ্যোগ নিয়ে দুই মাসে সম্পন্ন করে। এই আর্থিক সাহায্য পুরোটাই করেছে সংযোগের নিয়মিত দাতারা,যারা দেশে প্রবাসে অবস্থান করছেন।
পরে জুন (২০২০) মাসে সংযোগ শুরু করে অক্সিজেন সিলিন্ডার সংযোজন সরবারাহ। বাসাবাড়িতে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহের জন্যে সংযোগের একটা টিম এখন অবধি কাজ করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত খোদ ঢাকা শহরেই ১০০জনের উপর কোভিড আক্রান্ত মানুষ এই অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর সেবা পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, দুই হাজার পিসের উপর অক্সিমিটার সরবরাহ,বিভিন্ন এলাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহও করেছে সংযোগ।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাও সরবরাহ করে সংযোগ। নোয়াখালী সদর হাসপাতালের আইসিইউ স্থাপনের জন্যে আইসিইউ সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি সংযোগ সরবরাহ করেছে। কোভিডের শুরুতে আরও দুইটা জরুরি সেবা চালু করেছিল সংযোগ, যা এখনো চলমান।
সেবা দুটি হল ১)ব্লাড এন্ড প্লাজমা সাপোর্ট ২)কেয়ারার/কেয়ারগিভার সাপোর্ট
এই পর্যন্ত কোভিড আক্রান্ত মানুষজনকে সংযোগ থেকে ১০ জনের উপর প্লাজমা ডোনার ও ৬০ জনের উপর ব্লাড ডোনার ম্যানেজ করে দেয়া হয়েছে। জানান সংযোগের ফাউন্ডার।
গত বছরের শেষের দিকে করোনার প্রভাব কমতে শুরু করার পর নতুন প্রকল্প হাতে নেয় সংযোগ সারাদেশে যখন স্কুল-কলেজ সব বন্ধ তখনই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে গল্প, কবিতা, গান প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় সংযোগের পক্ষ থেকে। যার মাধ্যমে সকলের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। পরে ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পেক্ষাপট বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান কবিতা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়
মার্চ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাস। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে ২৬ জনকে স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা নিয়েছে সংযোগ। এছাড়াও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫০ জনকে স্বাবলম্বী করার অন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সংযোগ। আহমেদ জাভেদ জামাল জানান, সংযোগ ২০টি পরিবারকে স্বাবলম্বী করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কয়েকটি জেলায় লাইব্রেরীও স্থাপন করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকজনকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে।
‘সংযোগ মেডিকেল টিম’ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রাতদিন মানুষকে যেকোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং যাদের চিকিৎসার খরচের প্রয়োজন, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। প্রায় ১৫ জন মানুষের কাছে জরুরি চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে বলেও জানান মি. জামাল।
‘সারাদেশে প্রায় ৭ হাজার পিস কম্বল ও ৪ হাজার পিস শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে সংযোগ।’
এছাড়া কিশোরী মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়েও কাজ করছে সংযোগ। সম্প্রতি রিয়াদুল মুসলিমাত নামে একটা স্কুলের ১০০ মেয়ের সারাবছরের স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সংযোগ।
কোভিভ পরিস্থিতির পর সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। বিশ্বে এসেছে নতুন নিয়ম। কোভিড কেড়ে নিয়েছে অনেকের প্রিয় মানুষ, অনেকের চাকরি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ পড়েছেন নানান সমস্যায়। দেশের সব মানুষের নতুন নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, খারাপ অবস্থা থেকে টেনে তুলতে কাজ করছে সংযোগের মত অসংখ্য সংগঠন। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারলেই এসব উদ্যোগ সফল হবে বলে মনে করেন সচেতন মহল। এই সফলতা পেতে অবশ্য এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের। সুস্থ হোক পৃথিবী। সচেতন হোক মানুষ। সমাজ থেকে দূর হোক সব ধরনের অসহায় মানুষের দুঃখ।