শ্রী মোরারজি দেশাই – জানুন ভারতের প্রাত্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে

শ্রী মোরারজি দেশাইয়ের জন্ম ১৮৯৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের ভাদেলি গ্রামে। গ্রামটি বর্তমানে বালসার জেলার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতা ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ একজন স্কুল শিক্ষক। শৈশব থেকেই পিতার কাছে কঠোর পরিশ্রম এবং সত্যবাদিতার পাঠ নিয়েছিলেন তরুণ মোরারজি। সেন্ট বাসার হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ সালে তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশের উইলসন সিভিল সার্ভিস থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে তিনি দীর্ঘ ১২ বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।

১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মোরারজি দেশাই ঝাঁপিয়ে পড়েন। বৃটিশের অন্যায় অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। নিঃসন্দেহে ছিল এটি একটি খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু তিনি অনুভব করেছিলেন যে “দেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন যেখানে রয়েছে সেখানে পারিবারিক সমস্যা অতি তুচ্ছ ব্যাপার।”

১৯৭৭, ২৪ মার্চ থেকে ১৯৭৯, ২৮ জুলাই | জনতা পার্টি

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় শ্রী দেশাই তিনবার কারাবরণ করেছিলেন। ১৯৩১ সালে অখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির তিনি একজন সদস্য নির্বাচিত হন এবং গুজরাট প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত।

১৯৩৭ সালে প্রথম কংগ্রেস সরকার গঠিত হওয়ার পর শ্রী দেশাই শ্রী বি জি খেরের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় রাজস্ব, কৃষি, অরণ্য ও সমবায় দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। জনগণের রায় বা সম্মতি ছাড়াই বিশ্ব যুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসেন।

মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় শ্রী দেশাইকে আটক করা হয়। তিনি মুক্তি পান ১৯৪১-এর অক্টোবরে। কিন্তু পরের বছরেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় আগস্ট মাসে তাঁকে আবার কারারুদ্ধ করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৪৫ সালে। পরের বছর , অর্থাত্ ১৯৪৬ সালে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের পর তিনি বোম্বাইতে স্বরাষ্ট্র ও রাজস্ব দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই সময়কালে ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে শ্রী দেশাই কয়েকটি যুগান্তকারী সংস্কারের সূচনা করেন এবং ‘জমি কৃষকের’ এই নীতি প্রবর্তন করে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করেন। পুলিশ-প্রশাসনের ক্ষেত্রেও পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবধান তিনি কমিয়ে আনেন এবং জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় পুলিশ যাতে সাধারণ মানুষের ডাকে সাড়া দেয় তাও তিনি নিশ্চিত করেন। ১৯৫২ সালে তিনি বোম্বাইয়ের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হন।

শ্রী দেশাই মনে করতেন, গ্রাম ও শহরের দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষ যতদিন না একটি সুন্দর জীবনযাত্রার মানে উন্নীত হচ্ছেন, ততদিন সমাজবাদের কথা বলা অর্থহীন। সাধারণ কৃষক ও ভাড়াটিয়াদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের কয়েকটি বিধি চালু করেন মোরারজি দেশাই। এই কাজ ছিল নিঃসন্দেহে প্রগতি ও প্রগতিশীলতার একটি দিকচিহ্ন। এক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য যেকোন রাজ্যের তুলনায় বোম্বাই ছিল এগিয়ে। এই সমস্ত আইনের রূপায়ণে তিনি ছিলেন সত্ (সৎ) ও আন্তরিক| ফলে, বোম্বাইতে তাঁর প্রশাসনিক কাজকর্ম বিশেষ সুখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

বিভিন্ন রাজ্যের পুনর্গঠনের পর শ্রী দেশাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৬ সালের ১৪ নভেম্বর। পরে , ১৯৫৮ সালের ২২ মার্চ তিনি অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব লাভ করেন।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাভাবনাকেই কাজে রূপায়িত করতেন শ্রী মোরারজি দেশাই। প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের প্রয়োজনে তিনি একদিকে যেমন প্রভূত রাজস্ব আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন, অন্যদিকে তেমনই অনর্থক ব্যয়ের মাত্রা কমিয়ে এনে সরকারি ব্যয় ও প্রশাসনিক খরচের ক্ষেত্রে ব্যয় সঙ্কোচ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে ঘাটতি বাজেটকে তিনি একেবারেই নিচে নামিয়ে এনেছিলেন। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকজন যাতে অতিরিক্ত ব্যয়বাহুল্য না দেখাতে পারেন তারও ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।

১৯৬৩ সালে কামরাজ প্ল্যানের আওতায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে মোরারজি ইস্তফা দেন। পণ্ডিত নেহরুর পরে শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী দেশে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি শ্রী দেশাইকে প্রশাসনিক পদ্ধতি ঢেলে সাজানোর জন্য প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান। জনজীবনে শ্রী দেশাইয়ের দীর্ঘ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা এই কাজে তাঁকে আরও উপযুক্ত করে তুলেছিল।

১৯৬৭ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে শ্রী দেশাই যোগদান করেন। পরে ১৯৬৯-এর জুলাই মাসে শ্রীমতী গান্ধী তাঁর কাছ থেকে অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্বটি নিয়ে নেন। শ্রী দেশাই যদিও মনে করতেন যে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের দপ্তর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন শেষ কথা, তবুও তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র পরামর্শ করার মতো সৌজন্য না দেখানোয় তিনি মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। এরই পরিস্থিতিতে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর দ্বিতীয় কোন বিকল্প ছিল না।

১৯৬৯ সালে কংগ্রেস দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। শ্রী মোরারজি দেশাই সংগঠন কংগ্রেসের সঙ্গেই যুক্ত থাকেন। বিরোধী দলের তিনি ছিলেন একজন অগ্রণী নেতা। ১৯৭১ সালে তিনি সংসদে পুনর্নিবাচিত হন। ১৯৭৫ সালে গুজরাট বিধানসভা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের প্রশ্নে তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেন। তাঁর এই অনশনের ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালের জুন মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চারটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত জনতা পার্টি নির্দলদের সমর্থনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা লাভ করে। ইতিমধ্যে শ্রীমতী গান্ধীর নির্বাচন বাতিল বলে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ঘোষণা করায় শ্রী দেশাই ঘোষণা করেন যে গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি আস্থা জানিয়ে শ্রীমতী গান্ধীর পদত্যাগ করা উচিত।

দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে ১৯৭৫-এর ২৬ জুন শ্রী মোরারজি দেশাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে জেলবন্দী করে রাখা হয় ১৯৭৭-এর ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার কয়েকদিন আগেই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযান। ১৯৭৭ সালে ষষ্ঠ লোকসভা গঠনের জন্য যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জনতা পার্টির ব্যাপক জয়ের পেছনে ছিল শ্রী মোরারজি দেশাইয়ের এক বিশেষ ও অগ্রণী ভূমিকা। গুজরাটের সুরাট কেন্দ্র থেকে শ্রী দেশাই নিজে নির্বাচিত হন। সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে তাঁকে জনতা পার্টির নেতা নির্বাচন করা হয় এবং ১৯৭৭-এর ২৪ মার্চ তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে গুজরাবেনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে তিনি পাঁচ সন্তানের জন্ম দেন। বর্তমানে তাঁর এক কন্যা ও এক পুত্র জীবিত রয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রী দেশাই বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন যাতে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সর্বতোভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়া যায়। সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষও যদি কোনরকম ভুল বা অন্যায় করে সবচেয়ে নিরীহ মানুষটিও যাতে তার প্রতিবাদ করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সজাগ ও সতর্ক। তিনি বলতেন, “কোন মানুষ, এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও আইনের ঊর্ধ্বে নন।”

শ্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে সত্য ছিল এক বিশ্বাস, নিছক ধারণামাত্র নয়। পরিস্থিতির চাপে পড়েও কখনই তিনি তাঁর নীতিকে বিসর্জন দিতেন না। এমনকি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাসে অবিচল থাকতেন। তাঁর নীতিই ছিল – “নিজের সততা ও বিশ্বাসের বলেই প্রত্যেকের কাজ করে যাওয়া উচিত।”.

তথ্যসূত্র : পিএমইন্ডিয়া

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

তাৎক্ষণিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস

পশ্চিম বাংলার একাধিক জেলায় ঝড়-বৃষ্টি আসন্ন 📍 কলকাতা, ১৭ মার্চ: পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়ায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।…

2 weeks ago

স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী

আজ, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, আমরা উদযাপন করছি স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনটি কেবল তাঁর…

3 months ago

কবি এ কে সরকার শাওনের প্রথম উপন্যাস “অতল জলে জলাঞ্জলি” প্রকাশিত।

১০ জানুয়ারি ২০২৫ এর বই মেলা উপলক্ষে বাজারে এসেছে কবি এ কে সরকার শাওনের প্রথম…

3 months ago

উত্তরবঙ্গের আবহাওয়া আপডেট

আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল ও সিকিমের আবহাওয়া রইবে বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল। পার্বত্য অঞ্চল ও…

3 months ago

সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের উপর কড়া নির্দেশ জারি

রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে কর্মরত চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে কড়া নির্দেশিকা জারি করল…

3 months ago

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ আজ, অপেক্ষা ভোটের দিন ঘোষণার

জাতীয় নির্বাচন কমিশন আজ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করবে। দুপুর ২টায় এক সাংবাদিক সম্মেলনের…

3 months ago