চিকিৎসা কিভাবে “ডায়াবেটিস” এর জন্য চোখের ক্ষতি হয় , বিস্তারিত জানুন


সোমবার,০৮/০২/২০২১
669

শরীরের ইনসুলিন হরমোনের অভাব বা স্বল্পতাজনিত কারণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশী হওয়াকে ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে আক্রান্ত করে। চোখ তার মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের চারটি প্রধান কারণের মধ্যে ডায়াবেটিসজনিত চোখের রোগ একটি। অন্য কারণগুলো হলো-চোখের ছানি, কর্ণিয়ার রোগ ও গ্লুকোম।

১. প্রতিসরণজনিত দৃষ্টি স্বল্পতা বা রিফ্রাকটিভ:
(ক) মায়োপিয়া বা নিকট দৃষ্টিঃ দূরের জিনিস ঝাপসা দেখা যায়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে চোখের অ্যাকুয়াস হিউমারেও গ্লুকোজ বেড়ে যায়। তখন বেশী পরিমাণে গ্লুকোজ লেন্সের কর্টেক্সে ঢুকে। এতে লেন্সের কর্টেক্সেও পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। এজন্য লেন্সের নিউক্লিয়াসের প্রতিসরণ সূচক বেড়ে যায়। ফলে কোন বস্তুর প্রতিবিম্ব রেটিনাতে না পড়ে তার সামনে পড়ে।

(খ) হাইপারমেট্রোপিয়া বা দূরদৃষ্টি: কাছের জিনিস ঝাপসা দেখা যায়। চিকিত্সার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। লেন্সের কর্টেক্সে গ্লুকোজের পরিমাণও স্বাভাবিক হয়ে যায়। এতে লেন্সের কর্টেক্সের পানির পরিমাণ কমে যায়। সেজন্য লেন্সের নিউক্লিয়াসের প্রতিসরণ সূচক কমে যায়। ফলে কোন বস্তুুর প্রতিবিম্ব রেটিনাতে না পড়ে তার পিছনে পড়ে। চিকিত্সা দ্বারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত হওয়ার এক থেকে দেড় সপ্তাহ পরে চোখের চশমার পাওয়ার পরীক্ষা করা উচিত।

২. চোখের ছানি বা ক্যাটার্যাক্ট ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ডায়াবেটিক রোগীদের দ্রুত ছানি পড়তে দেখা যায়। এ ধরণের ছানি তরুণ বয়সেও পড়তে পারে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে চোখের লেন্সেও গ্লুকোরেজ মাত্রা বেড়ে যায়। এতে লেন্সে বেশী পরিমাণে পানি ঢুকে। ফলে লেন্স অস্বচ্ছ হয় ও ছানি পড়ে। বৃদ্ধ বয়সে অনেকের ছানি পড়ে। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ছানি পড়াকে ত্বরান্বিত করে।

চিকিৎসা:
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে ছানি অপারেশন করে চোখের ভিতর কৃত্রিম লেন্স লাগানো হয়। ডায়াবেটিক রোগীদের ছানি অপারেশনে কোন বাধা বা ভয় নেই।

৩. ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
ডায়াবেটিস চোখের ভিতরের স্নায়ুপর্দা বা রেটিনার ক্ষুদ্র রক্তনালীতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আনে যা শেষ পর্যন্ত চোখকে দৃষ্টিহীন করে দিতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদেও চোখের এই অবস্থাকেই বলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ঝুকি:
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সময়কাল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যাদের ৩০ বত্সর বয়সের আগে ডায়াবেটিস হয় তাদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি শতকরা ৫০ জনের ১০ বত্সরের মধ্যে এবং শতকরা ৯০ জনের ৩০ বত্সরের মধ্যে দেখা দেয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তাড়াতাড়ি দেখা দেয় এবং চোখ দ্রুত অন্ধ হয়ে যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বিলম্বিত হয়, রেটিনোপ্যাথির মাত্রা কম হয় এবং চোখ অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিছু বিষয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে-যেমন গর্ভধারণ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির অসুখ, রক্তশূণ্যতা, সূ্থ্থলতা, ধূমপান ইত্যাদি।

কিভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়ঃ
১. ক্ষুদ্র রক্তনালী বা ক্যাপিলারীর মাধ্যমে রক্তের অক্সিজেন শরীরের কোষে প্রবেশ করে ও কোষের কার্বন ডাই অক্সাইড রক্তে আসে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে ক্যাপিলারী বেজমেন্ট মেমব্রেন স্থূল হয়ে যায়, ক্যাপিলারী কোষ নষ্ট হয়ে যায়, লোহিত রক্ত কণিকার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার ফলে অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা কমে যায় এবং রক্তের অনুচক্রিকার জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে রেটিনাতে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এতে ক্যাপিলারী পর্যায়ে শিরা ও ধমনীতে অস্বাভাবিক রক্ত চলাচল ও শান্ট সৃষ্টি হয় এবং নতুন রক্তনালী সৃষ্টির প্রবণতা দেখা দেয়।

২. ক্ষুদ্র রক্তনালী ছিদ্র হয়ে যাওয়া- ক্যাপিলারী কোষগুলো দুই প্রকার এন্ডোথেলিয়াম ও পেরিসাইট। ক্যাপিলারীগুলো পেরিসাইট দ্বারা শক্ত বাঁধনের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সাধারণত প্রতিটি এন্ডোথেলিয়াম কোষে একটি করে পেরিসাইট থাকে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের রেটিনাতে পেরিসাইটের স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে ক্যাপিলারীর দেয়াল স্ফীত হয়ে যায় এবং রক্তের জলীয় অংশ বা প্লাজমা রেটিনাতে ঢুকে। ক্যাপিলারীর যে অংশ স্ফীত হয়ে ছোট থলের আকার ধারণ করে তাকে মাইক্রোঅ্যানিউরিজম বলে। এ থেকে রেটিনাতে রক্তপাত হয় এবং স্বল্প পরিসরে বা বিস্তৃতভাবে পানি জমে। রেটিনাতে স্বল্প পরিসরে পানি জমার ফলে হার্ড এক্সুডেট তৈরি হয়।

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির শ্রেণী বিন্যাস:

ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়।

(ক) ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি যেমন-মাইক্রোঅ্যানিউরিজম, রেটিনাতে বিন্দুর মত রক্তক্ষরণ (ডট হিমোরেজ), হার্ড এক্সুডেট ও রেটিনাতে পানি জমা।

চিকিৎসা :ব্যাকগ্রাউন্ড ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। তবে ম্যাকুলার
কেন্দ্র হতে ৫০০ মাইক্রোমিটারের মধ্যে পানি বা হার্ড এক্সুডেট জমলে লেজারের সাহায্যে চিকিত্সা করা হয়। রোগীকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রক্তশূণ্যতার চিকিৎসা করতে হবে। ধূমপান, মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে। বছরে অন্তত একবার চোখ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

(খ) প্রিপ্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, যথা-রক্তনালীর বিশেষতঃ শিরার পরিবর্তন- শিরার পুতির মালার মত হয়ে যাওয়া, বেঁকে যাওয়া ও মাংসের কাবাবে মত খন্ডাংশে পরিণত হওয়া, রেটিনাতে বিশেষ ধরণের রক্তক্ষরণ. তুলার আশের মত দাগ বা চিহ্ন এবং রেটিনার ভিতরের ক্ষুদ্র রক্তনালীর অস্বাভাবিকতা।

চিকিৎসা: এই স্তরেও সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই।তবে রোগীকে চক্ষু বিশেষজ্ঞ দ্বারা নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করাতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে লেজার চিকিত্সা লাগতে পারে। তবে তা ফান্ডাস ফ্লুরোসেন্স এনজিওগ্রাফির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।

(গ) প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি যেমন-

১. নতুন রক্তনালী সৃষ্টি হওয়া।

২. চোখের ভিতরের জেলীর মত জিনিস বা ভিট্রাসের রেটিনা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

৩. নতুন রক্তনালী থেকে রেটিনা,

রেটিনার সামনে ও ভিট্রাসে রক্তক্ষরণ। জটিলতা; ভিট্রাসে রক্তক্ষরণ, রেটিনার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, আইরিশে নতুন রক্তনালী সৃষ্টি হওয়া ও চোখের চাপ বেড়ে গ্লুকোমা হয়ে যাওয়া।

চিকিৎসা: প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে রেটিনাতে অনেক নতুন রক্তনালী সৃষ্টি হয়, যা থেকে যে কোন সময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। লেজারের সাহায্যে এসব নতুন রক্তনালীগুলো নষ্ট করে দেয়া হয়। যদি রেটিনা বা ভিট্রাসে রক্তক্ষরণ হয় তবে তা চিকিত্সার মাধ্যমে কমিয়ে পরে লেজারের সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়। আবার ভিট্রাসের রক্ত যদি দীর্ঘ সময় পরও পরিষ্কার না হয় তবে ভিট্রাস অপারেশনের মাধ্যমে বের করে ফেলা হয়, যা ভিট্রেক্টোমি নামে পরিচিত। ভিট্রেক্টোমির সাথে বা পরে লেজার চিকিৎসা দেয়া হয়।

ডায়াবেটিক রোগীদের চোখের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

ডায়াবেটিস ধরা পড়লে বত্সরে অন্তত একবার চক্ষু বিশেষজ্ঞ দ্ব্বারা চোখ পরীক্ষা করাতে হবে। ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। একবার ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়ে গেলে তার উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে হবে। তা না হলে জীবনে অন্ধত্বের অভিশাপ নেমে আসতে পারে।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট