সরস শব্দের অর্থ জল। তাই সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাৎ নদী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি বিদ্যাদেবী, জ্ঞানদায়িনী, বীণাপাণি প্রভৃতি নামে অভিহিতা। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন তো হাঁস। কিন্তু কখনো কখনো সরস্বতীর বিভিন্ন ছবিতে বাহন হিসাবে ময়ূর কে দেখা যায়। কিন্তু আমরা জানি ময়ূর তো কার্তিকের বাহন। তাহলে সরস্বতীর সঙ্গে ময়ূরের সম্পর্ক কি ? আসুন জেনে নিই..আগে সরস্বতীর পরিচয় ছিল উত্তর ভারতের সপ্তনদীর অন্যতমা সরস্বতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে।
পদ্মপুরাণে সরস্বতী দক্ষকন্যা এবং কশ্যপ-পত্নী হিসাবে স্বীকৃত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে সরস্বতী বিষ্ণু বা নারায়ণের পত্নী। শিবপুরাণ আর স্কন্ধপুরাণ মতে সরস্বতী আবার শিবেরও পত্নী। ঋগ্বেদ-পরবর্তী হিন্দু শাস্ত্র আলোচনায় সরস্বতী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেব-এর পত্নী রূপে ব্যখ্যাত হলেও, অধিক প্রচলিত মতে তিনি নারায়ণ-পত্নী। ‘মৎসপুরাণ’অনুসারে, পরমাত্মার মুখনিঃসৃত শক্তিগুলির মধ্যে সরস্বতী সর্বশ্রেষ্ঠা। কিন্তু জন্ম নেওয়ার পর তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা সরস্বতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ব্রহ্মার দৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরস্বতী অন্য দিকে সরে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি যে দিকে সরেন সে দিকেই ব্রহ্মার একটা করে মুখ তৈরি হয়।
এই ভাবে ব্রহ্মার পাঁচটা মাথা গজায়। শেষে সরস্বতী রাজহংসীর রূপ ধরে বনে পালিয়ে গিয়েও ব্রহ্মার কাম থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না। ব্রহ্মাও রাজহাঁসের রূপ ধরে তাঁর সঙ্গে মিলিত হলেন। সরস্বতীর ওই ছদ্মরূপই পরবর্তীকালে তাঁর বাহন হিসেবে পদতলে স্থান পেয়েছে বলে মনে করা হয়।বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, বৃহস্পতি পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। কালের বিবর্তনে সরস্বতী তাঁর অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে কেবল বিদ্যাদেবীতে পরিণত হলেন। সরস্বতী জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী।বর্তমানে সরস্বতীর বাহন হাঁস। তিনি এ বাহন ব্রহ্মার কাছ থেকে পেয়েছিলেন কিন্তু ব্রহ্মা বা সরস্বতী দেবীর বাহন কিন্তু পাখি নয়।
বেদে এবং উপনিষদে হংস শব্দের অর্থ সূর্য। বৈদিক সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় সিংহ ও মেষ সরস্বতী দেবীর আদি বাহন ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবী দুর্গা সরস্বতী দেবীর কাছ থেকে সিংহ কেড়ে নিলেন আর কার্ত্তিক কেড়ে নিলেন ময়ূর। পরবর্তী সময়ে সরস্বতী দেবী হংসকেই তাঁর চিরস্থায়ী বাহনের মর্যাদা দিলেন।আমরা সবাই জানি হাঁস এমন একটি প্রাণী, যাকে জল ও দুধ একসঙ্গে মিশিয়ে দিলেও জল ছেড়ে শুধু দুধটুকু পান করে নেয়। জ্ঞানের দেবীর বাহন নির্বাচনের মাধ্যমেও যেন এই কথাটিই বলা হয়েছে যে, অজ্ঞানকে ছেড়ে দিয়ে আমাদের সবার জ্ঞানকে আহরণ করা উচিত। সেই কারণেই দেবীর বাহন হিসেবে হাঁস অবস্থান করে। সে বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক।