ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা: মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার অরক্ষিত সীমান্ত অথবা সমুদ্রপথে বাংলাদেশে ঢুকে তারা নাশকতা চালাতে পারে– এমন আশঙ্কার মধ্যে সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকান আর্মি, আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) মতো গ্রুপগুলো বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের কাছে অস্ত্র পাচার করে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি মিয়ানমারের নতুন সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কাজ শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে আস্থা বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবেও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকার উদ্যোগী। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী হলেও তারা মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি রোহিঙ্গাদের বিরোধী। তাদের নেতার ভাষ্য– তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষাবলম্বন করে কোনো ফাঁদে পা দেবে না। তাই তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কঠোর। অন্যদিকে এএলপি মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করেছে। এখন তাদের মাঠপর্যায়ের অস্ত্রধারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে অস্ত্র পাচারের চেষ্টা করছে। তাই তাদের প্রতিরোধ করতে মিয়ানমার সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল জোরদার করছে। পাহাড়ে বিজিবির তিন ব্যাটালিয়ন বাড়ানো হচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্ত দুগর্ম হওয়ার কারণে অনেক স্থান অরক্ষিত। সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশ অংশে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।
এ সড়কে সীমান্তে টহল বাড়ানো যাবে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্ত খুবই অপরাধপ্রবণ। ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সীমান্তে টহল বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে এসব অপরাধ কমে আসবে বলে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলছেন। মিয়ানমারের দায়িত্বহীন আচরণে বাংলাদেশ খুবই অসন্তুষ্ট। সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে বেশ কিছু মাইন পাওয়া গেছে। গত ১৫ মার্চ বান্দরবান সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় মনিরুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হন। গত জুলাই মাসে বান্দরবান সীমান্তে দুটি তাজা মাইন পাওয়ার পর তা ধ্বংস করা হয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এসব মাইন পুঁতে রাখছে। কারণ যেসব মাইন উদ্ধার করা হচ্ছে তা এন্টি পার্সোনাল। সামরিক বাহিনী ছাড়া এসব মাইন কেউ তৈরি করতে পারবে না। এ বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যতবার বৈঠক করতে চেয়েছে; ততবার তারা বৈঠকে আসেননি। বৈঠক বাতিল করেছেন। এ ছাড়া ইয়াবা পাচারে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা বাধা দেয় না। এমনিতে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে চাইলে তাদের গুলি করা হয়। কিন্তু ইয়াবা পাচারকারী রোহিঙ্গারা রাজধানী নেইপিদো পর্যন্ত চলে যায়। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো কোনো সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য ধরা পড়ার পর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তারা মিয়ানমার ও ভারতের মিজোরামে আশ্রয় পেয়ে থাকেন। মিয়ানমানের সঙ্গে আস্থা বাড়াতে বাণিজ্য বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছেন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। মিয়ানমার সীমান্তে একটি স্থলবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ স্থলবন্দরটি হলে চোরাচালান কমবে। মিয়ানমার থেকে বার্মিস কাপড়, পেঁয়াজ, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু আমদানি হয়ে থাকে। চোরাচালান ছাড়া বৈধপথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এগুলো আমদানিতে খরচ বেশি হয়। স্থলবন্দর হলে মিয়ানমারের সঙ্গে বৈধ বাণিজ্য বাড়বে। এটি দুদেশের সম্পর্কে আস্থা বৃদ্ধি করবে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ফলে এখনই স্থলবন্দরের কাজ শুরু করা উচিত বলে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করছেন। মিয়ানমারে ভোটে সু চির এনএলডি জয়ী হয়েছে। অবশ্য রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে নয়টি টাউনশিপে এখনও ভোট হয়নি। আটটি টাউনশিপে ভোট হয়েছে। এতে আঞ্চলিক দলগুলো ভালো করেছে। আরাকান ন্যাশনালিস্ট পার্টি ৯ আসন পেয়েছে। সু চির এনএলডি পেয়েছে ৪ আসন। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থগিত ৯টি টাউনশিপে ভোট হবে। আরাকান আর্মিসহ বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো ভোট করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। ফলে রাখাইন রাজ্যে এখন পরিস্থিতি অনেক শান্ত। তাই ভোটের পর নতুন সরকার গঠন করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোচনা শুরু করতে হবে। এ লক্ষ্যে আস্থা বৃদ্ধির কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক জোরদার করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান একসঙ্গে মিয়ানমার সফর করেছেন। তার পর ভারত ও মিয়ানমার যৌথভাবে কাজ করছে। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় সড়ক নির্মাণ করছে। সড়কটি ইস্ট ওয়েস্ট করিডোরে যুক্ত হয়ে লাওস, ভিয়েতনাম পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করবে। মিয়ানমারের কালাদান নদী দিয়ে মিজোরামকে ভারতের অপর অংশে সংযোগ স্থাপন করছে। ভারত এত কিছু করলেও বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে পারছে না।