শ্রাবনী বোস : প্রায় প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে উত্তর কলকাতার বরানগরের বাস করছি কিন্তু কোনদিনই তাগিদ অনুভব করিনি এর ইতিহাস জানবার , মানুষ নাকি একটা বয়সের পরে নস্টালজিক হয়ে পরে,সেটা কিছুটা হলেও টের পাচ্ছি নিজেকে দিয়ে কেননা পুরনো জিনিস ,পুরনো মানুষ, পুরনো পাড়া কৈশোরকালে কাটানো বাড়ি ,গলি, পুকুর -সব যেন মাঝে মাঝে টানে এদের সঙ্গে দেখা হলে একটা ফুরফুরে ভালোলাগা আনন্দে মনটা ভরে যায় নিদেনপক্ষে যার সাথে শত্রুতা তাকে দেখলে একই অনুভূতি না হলে, খারাপ লাগেনা । এই লকডাউন এর সময় কালে বাড়িতে প্রায় ৮ মাস কাটিয়েছি। কোথাও বেড়াতে যাওয়া তো দূর অস্ত, একটু এসপ্ল্যনেড , গড়িয়াহাট কিংবা পাড়ার কোন বন্ধু র বাড়ী ও আড্ডা মারতে যেতে পারছিনা। শেষমেশ পাঁচ বন্ধু মিলে ঠিক করলাম ভোরবেলা করোনা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীকে দর্শন করে আসব এবং সেটা যানবাহন ছাড়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। যেই ভাবা সেই কাজ সফলভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পর আশার পারদ চড়তে লাগলো হঠাৎ মনে হলো ভবতারিণী মায়েরা তো তিন বোন দুই বোন থাকেন টালাব্রিজের এপারে ,তৃতীয়জন কোথায় থাকেন? খোঁজ খোঁজ– পেয়ে গেলাম বড় বোন নিস্তারিণী থাকেন গোয়া বাগানে গেহো বা গুহ দের বাড়িতে উত্তর কলকাতা স্টার থিয়েটার এর বিপরীতে বিখ্যাত লক্ষীনারায়ন সাউ এর নিরামিষ তেলেভাজা র দোকানের পাশের গলি দিয়ে যাওয়া যায় আর ছোট বোন ব্রহ্মময়ী থাকেন বরানগর প্রামানিক ঘাট এর কাছে প্রামানিক কালীবাড়িতে যাকে কিনা রামকৃষ্ণদেব “মাসি” বলে সম্বোধন করতেন।
ভবতারিণী মা মেজ বোন এরা এই সম্পর্কে বোন যে,এই মূর্তি গুলির কারিগর ছিলেন কাটোয়ার দাই হাটের নবীন ভাস্কর। বর্ধমানের মহারাজা তাকে একটি কষ্টি পাথরের পাহাড় থেকে কিছুটা পাথর উপহার দিয়েছিলেন আর সেই একটি পাথর খন্ড থেকেই এই তিন মূর্তি গুলি তৈরি করেন নবীন ভাস্কর । গর্ভগৃহ হিসেবে মানানসই মূর্তি মেজো মা ভবতারিণীকে রানী রাসমণির পছন্দ হয়ে যায় সেই থেকেই মা ভবতারিণী দক্ষিণেশ্বরে পূজিত হচ্ছেন।
প্রামানিক ঘাট রোডে প্রামানিক কালীবাড়িতে পূজিত হচ্ছেন ছোটমা ব্রহ্মময়ী।ভাবলাম জন্মসূত্রে পাওয়া এই সৌভাগ্যকে একটু আরো ভালো করে কাজে লাগাই পরের দিনই ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়লাম তিনজন মিলে বরানগর কে নতুন রূপে দেখবো বলে তা যাই হোক আগে একটু বরানগর সম্বন্ধে জানিয়ে রাখি যদিও আমার যতটুকু সীমিত জ্ঞান আছে সেটাই জানাচ্ছি, বরানগর বা বরাহনগর একটি উত্তর কলকাতার প্রাচীন জনপদ সপ্তদশ শতকে এখানে ডাচরা একটি কুঠি স্থাপন করেন।
এখনও এখানে একটি পাড়ার ও ঘাটের নাম হচ্ছে কুঠিঘাট। বরাহনগর নামের উৎপত্তির অনেক মত, প্রথমতঃ অনেকে বলেন এই গঙ্গার ধারে প্রচুর শুকরের উৎপাত ছিল তাই এর নাম বরাহনগর এবং “স্টেরনসাম মাস্টারের” লেখনি রোজনামচা থেকে জানা যায় ১৬৭৬–৭৭ সালে বরানগরে ডাচদের একটা শুয়োরের মাংস জারণ বা ম্যারিনেট করার কারখানা ছিলো। এই তথ্য আমরা হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের “কলিকাতার সেকাল ও একাল “এর বই থেকে পাই তার জন্য নাকি এইরকম নামকরণ। আরো এক মতে বহু আগে বরাহ নামে এক সিদ্ধ মুনি বাস করতেন তিনি ছিলেন বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার বরাহমিহির জ্যোতিষ বিজ্ঞানে বিখ্যাত “ক্ষণা”র শ্বশুর মশাই,ভিন্নমতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ এ “বরহা” বলে যে শব্দটি পাওয়া যায় তার অর্থ ময়ূরপুচ্ছ তিন চারশ বছর আগের থেকেই এই গ্রামে ময়ূর ও ময়ূর পুচ্ছ এর বাজার ছিল। অনুমান করা হয় যে পাশের অঞ্চলেরএই জন্যই বোধহয় নামকরণ হয়েছিল চিড়িয়ামোড় । তাই মনে করা হয় আদি গ্রামটির নাম ছিল বরাহনগর।
৩ অক্টোবর প্রথমেই আমাদের গন্তব্য স্থল ছিল কুটি ঘাটের গঙ্গার ধারে যেখানে আজ থেকে অন্তত 30 — 35 থেকে 40 বছর আগে আমাদের বরানগর থানা ছিল, এখন যেটা পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়েছে, তার পাশেই কৃপাময়ী কালিবাড়ি বা জয় মিত্র কালীবাড়ি কথিত আছে রানী রাসমণিএই স্থাপত্য দেখেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্থাপত্য অনুসরণ বা অনুকরণ করেছিলেন এখানেও দেখা যাবে নাট মন্দিরের সামনে মায়ের মন্দির মন্দিরের চারপাশে বারোটি শিবের মন্দির যদিও আজ অযত্নের ফলে চারিপাশে আগাছা ভর্তি সবচেয়ে খারাপ লাগলো মন্দিরের গা ঘেঁষে একটি নির্মীয়মান বহুতল, যেটা আমার চোখে বড্ড বেমানান। তারপর গঙ্গার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সতীদাহ ঘাটে এখন যেটা বয়স্কদের বসার ছোট্ট একটি পার্ক তাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম যে একসময় এইখানে আশেপাশের অঞ্চলের মেয়েদের সতী করা হত , ভাবতেই কেমন যেন সেলুলয়েডে দেখা সতীদাহের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো দাঁড়ালাম না এগিয়ে গিয়ে ছোট একটি ঘাট, ঠিক বিপরীতে বেলুড় মঠ এখান থেকে বেলুড় মঠ অতীব সুন্দর লাগলো একদম ঠিক যেন পোস্টকার্ড পিকচার।এরপর আমাদের গন্তব্য মা ভবতারিণীর ছোটবোন ব্রহ্মময়ী কালি বাড়ি বা প্রামানিক কালীবাড়ি ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় এই কালীবাড়ি।
এনাকেই নাকি রামকৃষ্ণদেব “মাসি “বলে ডাকতেন তবে মা আমার এখানে তালাবন্দি,প্রণাম সেরে আমরা চললাম রামকৃষ্ণ সংঘের প্রথম মঠ বরানগর মঠ।যেখানে সর্বপ্রথম স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে রামকৃষ্ণ সংঘের পথ চলা শুরু করেছিলেন এখনো পর্যন্ত রামকৃষ্ণ সংঘ সেখানে আর্তের সেবা কার্য চালিয়ে যাচ্ছে। পথমধ্যে পড়ল স্বামী বিবেকানন্দের সহপাঠীও প্রিয় বন্ধু দাশরথি সান্যাল মশাই এর বাড়ী যা কিনা স্বামিজি পদধূলি ধন্য যদিও এখন সেটা বহুতলে পরিণত। রাস্তায় পড়ল বাবা তারকভোলার মন্দির অষ্টধাতু অন্নপূর্ণা মন্দির এখানে নাকি মা অন্নপূর্ণা শাঁখারি র থেকে শাঁখা পরে এসে সেবায়েতের কাছে শাঁখার দাম নিতে শাঁখারিকে পাঠান এবং সেবাইত মন্দিরে গিয়ে দেখেন বন্ধ মন্দিরে মায়ের হাতে একজোড়া নতুন শাঁখা। শেষে বরানগর বাজারের কালী বাড়ির মা কে দর্শন করে বাড়ী ফিরলাম যেখান থেকে কিনা রামকৃষ্ণদেব যখন কাশীপুর উদ্যানবাটী যেতেন মাকে প্রণাম করে তবেই যেতেন এখনো অনেক ইতিহাস তুলে ধরার আছে বরাননগরের সবার কাছে আশা করছি আবার কিছুদিনের মধ্যেই সেই গুলো সম্বন্ধে জানাতে পারব।