পশ্চিম মেদিনীপুর:- বাঙালি বড্ড বেশি ভোজনরসিক । জামাই ষষ্ঠীর পর আষাঢ়ের বৃষ্টি শুরু হতেই বাঙালি ছোটে মাছের বাজারে ইলিশের খোঁজে। শারদ উৎসবের শুরু হতেই হেঁসেলে গিন্নি খোঁজেন শীতের সব্জী । ঠিক সেই সময় বিজয়ার নাড়ু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ঠাকুমা দিদিমারা । শারদ উৎসব পেরোলেই শীতের আমেজ । নতুন ধান ঘরে ওঠার পালা । এবার বাঙালির সন্ধানে আসে খেজুরের রস ও খেজুর গুড় । ইতিমধ্যেই নভেম্বরের শুরুতেই হালকা শীতের আমেজ অনুভুত হচ্ছে। ধীরে ধীরে শীত জাঁকিয়ে পড়তে শুরুও করেছে । এইসময় আপামর বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠে পুলির অনুষ্ঠান ।
সেই পিঠে পুলি তৈরিতে চাই নলেন গুড়। আর ভোজনরসিক বাঙালির জীভে জল আনা নলেন গুড় বানাতে খেজুর রসে জ্বাল দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন শিউলিরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী, গোয়ালতোড়ের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে তার প্রস্তুতি। কোথাও কোথাও আবার গাছে হাড়ি টেঙ্গে রস সংগ্রহের কাজ আরম্ভ হয়েছে৷ সকাল হলেই শালবনীর বেলবনী, গোয়ালতোড়ের পড়াকানালি প্রভৃতি গ্রামে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে বড় উনুনের জ্বালায় বড় ডেকচিতে খেজুর রস ফোটার টগবগ শব্দ। শালবনির বেলবনি গ্রামে দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর ধরে খেজুর রস থেকে গুড় তৈরি করেন বাকুড়ার তালডাঙরার গুলজার আলি খান৷ গোয়ালতোড়ের পড়াকানালির অনিল সরেনও প্রতি বছরই খেজুর গাছ থেকে রস বের করে নলেন গুড় তৈরি করছেন প্রায় ৮ বছর ধরে।
শীত হালকা হালকা অনুভুতি হওয়ার সাথে সাথেই গুলজার, অনিল দের ব্যাস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে উনুনে জ্বাল দিয়ে তাকে গুড়ে রুপান্তরিত করে টিনে টিনে মজুত করার কাজ। শিউলি গুলজার আলি খান জানান এবার তিনি প্রতি গাছ পিছু ৩ কেজি গুড় এর বিনিময়ে একশো ষাট টি গাছ নিয়েছেন৷ গাছ কিনে প্রথমে সেই গাছ গুলিকে কামিয়ে দেওয়া হয়। পরে প্রায় দশ দিন পরে সেই গাছে চাচ দিয়ে নল পেটা হলে সেই গাছ থেকে হাড়ি টাঙ্গিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। দুক্ষেপে ৮০ টি করে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। একটি গাছে থেকে রস সংগ্রহ করার পর কমপক্ষে চার দিন বিশ্রাম দিতে হয় , একে বলে জিরান। এই জিরান না দিলে খেজুর রসের স্বাদ থাকে না ফলে নলেন গুড়ের স্বাদও কমে যায় । এই নলেন গুড় কে বাজারজাত করার জন্য তিনি গোয়ালতোড়, গড়বেতা, শালবনীর বিভিন্ন এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি করেন। তিনি বলেন বর্তমানে দ্রব্যমূল্য এর দাম আকাশ ছোঁয়া কিন্তূ গুড়ের দাম সেভাবে পাওয়া যায় না । তবু পেটের দায়ে সংসার চালাতে করতেই হয়।
গুলজার বাবু এই গুড় তৈরিতে সাহায় করেন তার ছেলে জুলফিকার আর শ্যালক মত্তালেব। তারা জানান, জঙ্গল ঘেরা এলাকা, একদিকে হাতির ভয় আর অন্যদিকে পেটের টান৷ তাই ভ্য় কে জয় করেই আমাদের এই রস সংগ্রহ করতে হয়। তবে এলাকাবাসীরা জানান গুলজার, অনিল দের মতো লোকেরা আছে বলেই এই গুড় শিল্প টা এখনো টিকে আছে আর ভোজন রসিক বাঙালি নলেন গুড়ের পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে। কিন্তু এদের নেই কোনো সরকারী সুযোগ সুবিধা৷ শিউলিরা জানান যদি সরকারি সাহায্য পাওয়া যায় তাহলে তো খুবই উপকৃত হবো আর এই শিল্পটাকেও বাচিয়ে রাখবো।