|| ত্রিকোণ প্রেমের অমৃত-ফল সন্ধানে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমী-বিপ্লব ||
অনিন্দিতা মাইতি নন্দী: আষাঢ় মাস এলেই রথযাত্রা হয়। আমাদের বাড়ির সামনেই একটি বড় পুল রয়েছে সেখানে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই বসে অপেক্ষা করেন- কখন রথে জগন্নাথদেব মাসিবাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পুলটির সামনেই বড় পাকারাস্তা, সবাই সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ দর্শন করি, রথের পেছন পেছন মাসিবাড়ি অব্দি পৌঁছাই, মেলা দেখি। এটাই প্রতি বছরের রথযাত্রার গতানুগতিক নিয়ম। কিন্তু এই বছরটি সম্পূর্ণ আলাদা – সকলেই গৃহবন্দী, জগন্নাথদেবও তাই আর মাসি বাড়ি যাননি। বোধহয়, এই দুঃখেই রথযাত্রার দিন এবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির ধারায় রথযাত্রার কথা ভাবতে ভাবতে তলিয়ে যাই স্মৃতিপটে,- ভেসে ওঠে বৃষ্টিভেজা, এগারো বছর বয়সে, অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলা ছোট্ট ‘রাধারাণী’ কে, রথের মেলায় ফুলের মালা বেচতে গিয়ে ফেরার পথে রুক্কিনী কুমারের সাথে পথ চিনে সেই যে বাড়ী ফেরার গল্প।
মনে পড়ে যায় ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া ‘রাধারানী’ গল্পটির কথা; গল্পটি পড়ার পর কি ছটপট করেছিলাম, বাবার কাছে জেদ ধরা, ‘সাহিত্যসম্রাট সমগ্র’ আমার চাই। বৃষ্টি আজ বাঁধভাঙ্গা, সাথে বিজলী চমক চমকানিতে আমারও বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ঝিলিক মারে সেই শৈশবের প্রথম আলাপের মুহূর্ত ‘সাহিত্য সম্রাটের’ সাথে। আমি তখন সবে প্রথম শ্রেণীতে পড়ি, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক আগে ”জেলা আন্তঃচক্র ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা” হয়, ব্লক স্তরে আবৃত্তিতে প্রথম পুরস্কার স্বরূপ পাই ‘সূর্যমুখী’,- আজও মনে আছে গাঢ় হলুদ বর্ণের ডোরাকাটা বইটির মাঝখানে একটি পালকি আঁকা,– পালকির দুদিকে দুজন করে চারজন বেয়ারা, পালকিটির ঠিক একটু ওপরে লাল কালিতে লেখা ‘সূর্যমুখী’। বইটির একদম পেছন পাতায় বুকের ওপর দুহাত আবদ্ধ করা, লাল সাদা খুবই সুন্দর রঙ্গিন পাগড়ি পড়া এক সুপুরুষ। আমি দুচোখ ভরে অবাক হয়ে মুগ্ধ নয়নে সেই অপরূপ পুরুষকান্তিকে দেখছিলাম,- সৌন্দর্যের এমন বিজলী লীলা আর কখনো সেভাবে চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। তার চুল সামনের দিকে কিছুটা বেরিয়ে আসা বাবরীকাটা ও ঘন কালো বর্ণের। সুন্দর, সুশ্রী দেহগঠন, উন্নত নাক, উজ্জ্বল চোখ আর ঠোঁটের আশেপাশে সামান্য হাসি। সেই হাসিতে প্রবলভাবে উপস্থিত গরিমাজ্ঞান।
‘সূর্যমুখী’ ফুল হয় জানতাম- কিন্তু পালকি নিয়ে যাচ্ছে কাঁধে সেখানে সূর্যমুখী কে? —-এটাই ভাবতাম। ‘সূর্যমুখী’ কথাটির পাশে লেখা ছিল ‘বিষবৃক্ষ’ এর কাহিনী অবলম্বনে। সবে প্রথম শ্রেণীতে পড়ি, বইটি পুরস্কার পেয়ে রোজই একবার গন্ধ নিই নতুন বইয়ের।বইয়ের ভেতর এত শক্ত শক্ত শব্দ দেখে বেশিদূর এগোতে পারিনি, কিন্তু একটি গান ছিল, যার কয়েকটি লাইন আজও মনে আছে,
”কাঁটা বনে তুলতে গেলাম কলঙ্কের ফুল,
গো সখি কলঙ্কেরি ফুল।”
সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম ‘বঙ্কিম সমগ্র’ হাতে পাই। সূচিপত্রে গুনে দেখলাম মোট ১৪টি উপন্যাস রয়েছে।আমার সেই শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত গ্রন্থটি ‘সূর্যমুখী’ র লেখক ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর রচিত চতুর্থতম উপন্যাস হল ‘বিষবৃক্ষ’ যেখানে অন্যতম প্রধান চরিত্র সূর্যমুখী। বিষবৃক্ষ প্রথমে বঙ্গদর্শন পত্রিকাতে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। আমার মতে সাহিত্য সম্রাটের লেখা অন্যতম সেরা উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষ’, যা মূলত বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহ নিয়ে রচিত, নগেন্দ্রনাথ – সূর্যমুখী ও কুন্দনন্দিনীর আকর্ষণ বিকর্ষণ নিয়ে সামাজিক এক অনবদ্য গ্রন্থনা। ‘বিষবৃক্ষ’ একটি পূর্ণআখ্যান, এই উপন্যাসে শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টি নয়, একসাথে দেশ ও সকল মানুষের মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা ও যে তাঁর ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই বিষবৃক্ষ উপন্যাসে ‘বিষবৃক্ষ কি’ এবং এই বৃক্ষের বিষময় ফল কে খায়,– আর কে খায়না, তাও তিনি সঠিকভাবে নির্দেশ করে গেছেন।
তাঁর মতে, ”যে বিষবৃক্ষের বীজ বপন হইতে ফলোৎপত্তি এবং ফলভোগ পর্যন্ত ব্যাখানে আমরা প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহা সকলেরই গৃহ প্রাঙ্গনে রোপিত আছে। রিপুর প্রাবল্য ইহার বীজ, ঘটনাধীনে তাহা সকল ক্ষেত্রেই উপ্ত হইয়া থাকে। কেহই এমন মনুষ্য নাই যে, তাঁহার চিত্ত রাগ দোষ কাম ক্রোধাদির অস্পৃশ্য। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও ঘটনাধীনে সেই সকল রিপু কর্তৃক বিচলিত হইয়া থাকেন। কিন্তু মনুষ্যে মনুষ্যে প্রভেদ এই যে, কেহ আপন উচ্ছলিত মনোবৃত্তি সকল সংযত করিতে পারেন এবং সংযত করিয়া থাকেন। সেই ব্যক্তি মহাত্মা: কেহ বা আপন চিত্ত সংযত করেনা, তাহারই জন্য বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত হয়। চিত্তসংযমের অভাবই ইহার অঙ্কুর, তাহাতেই এ বৃক্ষের বৃদ্ধি। এই বৃক্ষ মহাতেজস্বী।একবার ইহার পুষ্টি হইলে আর নাশ নাই।এবং ইহার শোভা অতিশয় নয়ন প্রীতিকর;দূর হইতে ইহার বিবিধ বর্ণ পল্লব ও সমুৎফুল্ল মুকুলদাম দেখিতে অতি রমণীয়। কিন্তু ইহার ফল বিষময়; যে খায়, সেই মরে।”-
বিষবৃক্ষ ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ১লা জুন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর চিন্তার জগতের সঙ্গে পরিচিত হই, লেখকের আদর্শ চরিত্র, আদর্শ চিন্তা ভাবনা ফুটে উঠতে দেখি। সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে সাহিত্য সম্রাটের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল সমাজের ‘শিক্ষাদাতা’ -র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ”যদি মনে করিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।”
বিষবৃক্ষ উপন্যাসটিতে প্রধান চরিত্র নগেন্দ্রনাথ, সকল পূর্ণতা প্রাপ্তির মধ্যেও একটি চরিত্রে কিভাবে বিষবৃক্ষের বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয় এবং কি করে তা বৃক্ষের রূপ ধারণ করে, আবার কিভাবে সেই বৃক্ষের ফল উৎপন্ন হয় তা এই নগেন্দ্র চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে দেখতে চেষ্টা করেছেন।বিষবৃক্ষের দুটি চরিত্র ‘দেবেন্দ্র’ ও ‘নগেন্দ্র’ উভয়েই কুন্দনন্দিনীর প্রতি আকৃষ্ট। দেবেন্দ্র পাপপঙ্কে নিমগ্ন একটি চরিত্র তাই তার চরিত্রটি বঙ্কিমচন্দ্র সহানুভূতির সঙ্গে স্পষ্ট চিত্রাঙ্কন করে গেছেন, কিন্তু নগেন্দ্রের ধনসম্পদ, মান, ঐশ্বর্য, গৌরব, যশ ও সর্বপরি ‘সূর্যমুখী’ -র মতো স্ত্রী থাকা সত্বেও যে পদস্থলন তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে বিবেচিত হয়েছে।
নগেন্দ্র চরিত্রের যে স্বতন্ত্রতা, যে বিশেষত্ব, তা হল এই যে সে নিজের চিত্ত সংযমের জন্য যথেষ্ট সচেষ্ট হওয়া সত্বেও যে নিজ চিত্তসংযমে অসক্ষম ছিল। আবার দেবেন্দ্রের কোন প্রবৃত্তি ছিল না চিত্তসংযমে। তাই উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিষবৃক্ষ’ তে নগেন্দ্রের প্রতি যে কঠিন বাক্যগুলি ব্যবহার করেছেন তা অন্য কোনো চরিত্রের প্রতি করেননি। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে,— কোন উচ্চ শিক্ষিত মানুষও মহাপাপে কলুষিত হতে পারে আবার কোন খুবই সাধারণ মানুষ যে কখনো পাঠশালার পাঠ গ্রহণ করেনি সে মহৎ গুন্ সম্পন্ন হতে পারে। তাই তাঁর মতে চিত্তের সততা তথাকথিত একাডেমিক শিক্ষার ওপর নির্ভর করে না।
বিষবৃক্ষ উপন্যাসটির অধ্যায়গুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এখানে দুটি বিষবৃক্ষ রয়েছে, একটি হল উপন্যাসের শুরুতে নগেন্দ্রের কথা দিয়ে, অন্যটি উপন্যাসের ‘সমাপ্তি’ অধ্যায়ে যেখানে বলা হয়েছে, ”দেবেন্দ্রের রোপিত বিষবৃক্ষের ফল ফলিয়াছিল, সে অতি কদর্য রোগগ্রস্ত হইয়াছিল।” বিষবৃক্ষ উপন্যাসের শেষ ছত্রে তাই সাহিত্য সম্রাট ‘শিক্ষাদাতা’ -র ভূমিকায় মন্তব্য করেন, ”আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা করি, ইহাতে গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে।” ইনিই বঙ্কিমচন্দ্র!!! আমার শৈশবের পুরস্কার পাওয়া ‘সূর্যমুখী’ -র লেখক! বঙ্গদর্শনের বঙ্কিম, জাদুকর বঙ্কিম, দোর্দণ্ড প্রতাপ বঙ্কিম! দুর্গেশনন্দিনীর বঙ্কিম, ধর্মবিশ্লেষক বঙ্কিম, বিজ্ঞান চেতনায় বঙ্কিম !!! কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি- আস্তে আস্তে আমি ডুবদিই বঙ্কিম সাহিত্যে।
হুগলি কলেজের স্কুল বিভাগের পড়ার সময়েই বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্য রচনার সূত্রপাত। প্রথম লেখাটির নাম ‘পদ্য’ -একটি কবিতা। কবিতাটি স্ত্রী ও পতির কথোপকথন অবলম্বনে রচিত। মোট ১৪টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন তিনি। প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’।দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে ইতিহাসের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বিষয়বস্তু মোঘল পাঠান সংঘর্ষের ইতিহাস। এই কাহিনীর বিভিন্ন চরিত্র প্রেম-ঈর্ষা জড়ানো। এটি আদ্যন্ত একটি রোমান্টিক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রণয় ভাবনার সূত্রপাত এই দুর্গেশনন্দিনী থেকে। স্বয়ং তিনি এই উপন্যাসে বলেছেন, ”এ সংসারের প্রধান ঐন্দ্রজালিক স্নেহ। ব্যাধি প্রতিকারের প্রধান ঔষধ প্রণয়। নহিলে হৃদয় ব্যাধিকে উপশম করিতে পারে?” ১৮৬৫ খ্রী গোড়ার দিকে দুর্গেশনন্দিনী গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশ পায়।
এর পরের বছরই ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রী:।বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাস। ১৮৬০ সালের ২১শে জানুয়ারী বঙ্কিমচন্দ্র নেগুয়া মহকুমায় আসেন। যশোহর থেকে বদলি হয়ে যখন মেদিনীপুরের কাঁথিতে আসেন তখন কাঁথি সংলগ্ন নেগুয়া গ্রাম ছিল এই ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটির উৎসস্থল। এখানেই এক সন্ন্যাসী কাপালিককে দেখেই তাঁর মনে উপন্যাসটির বীজ বপন করেন।নেগুয়া (কাঁথি) তে সমুদ্রে এসেই বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সমুদ্র দর্শন ঘটেছিল।সমুদ্রের ডাক, বালিয়াড়ি, সংলগ্ন অরণ্য প্রকৃতির সৌন্দর্য, রসুলপুর নদী ও সর্বোপরি কাপালিক দর্শন স্মৃতি কপালকুণ্ডলা রচনা পরিকল্পনার উপাদান জোগায়। তাই ‘কপালকুণ্ডলা’ গ্রন্থের নায়ক নবকুমারের মুখ দিয়ে লেখক যেন নিজের উপলব্ধি বলেন, ”আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।”
কপালকুণ্ডলা ও নবকুমার দুজনেই ধৰ্ম বিশ্বাসী চরিত্র হিসেবে অঙ্কিত। নবকুমার এই উপন্যাসে পরোপকারী চরিত্র, সহযাত্রীদের অনুরোধে বনমধ্যে কাঠ সংগ্রহে গেলে সহযাত্রীরা তাকে ফেলে সমুদ্র তীরে নিজেরা স্বদেশে ফিরে আসেন। এখানে স্বয়ং ঔপন্যাসিক পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ”ইহা শুনিয়া যদি কেহ প্রতিজ্ঞা করেন, কখনো পরের উপবাস নিবারনার্থ কাষ্ঠাহরণে যাইবেন না, তবে তিনি উপহাসাস্পদ। আত্মপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা যাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবে- কিন্তু যতবার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠরোহন করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্বার পরের কাষ্ঠরোহনে যাইবে। তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?
বঙ্কিমচন্দ্রকে বহুবার নানা সময়ে নানাজনে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তাঁর রচিত কোন বইটি বা কোন চরিত্রটি শ্রেষ্ঠ বলে তিনি মনে করেন। একবার শ্রীশচন্দ্র মজুমদার প্রশ্ন করেছিলেন কপালকুন্ডলাই কি সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস? উত্তরে সাহিত্য সম্রাট বলেন, ”হ্যাঁ, কাব্যাংশে খুব উঁচু বটে।”
‘কপালকুণ্ডলা’ -র উপসংহার অংশটি একটি অনন্ত জিজ্ঞাসায় শেষ হয়েছে যার শেষে আর কোনো জিজ্ঞাসা থাকে না,- লেখক লিখেছেন, ”সেই অনন্ত গঙ্গাপ্রবাহ মধ্যে, বসন্তবায়ু বিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হইতে হইতে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমার কোথায় গেল ? – উপন্যাস লেখার সময়ই স্বয়ং ঔপন্যাসিক অনুভব করেছিলেন যে পাঠকবর্গ তাঁর এই উপন্যাসের পরিণতি তে হয়তো খুশি হবেন না। তাই তিনি বলেছিলেন, অদৃষ্টের গতি খণ্ডানো, ”গ্রন্থকারের সাধ্য নহে।”
‘পিতাপুত্র’ নামক একটি প্রবন্ধে অক্ষয়চন্দ্র সরকার ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে বলেন, ”আমাদের কলিকাতার কলেজ জীবনের শেষ অবস্থায় বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা প্রকাশিত হইল। এমন অছিদ্র, উজ্জ্বল, বাচালতাশুন্য অথচ রসপরিপূর্ণ, হিন্দুভাবে অস্থিমজ্জায় গঠিত, অদৃষ্টবাদের সূক্ষাতিসূক্ষ লেখায় ওতপ্রোত কাব্যগ্রন্থ, বাংলায় আর নাই।
বঙ্কিমচন্দ্রের তৃতীয় উপন্যাস ছিল ‘মৃণালিনী’। বাংলা ভাষাতে গদ্যে ‘মৃণালিনী’র মতো সুচারু গ্রন্থ বোধ হয় আজ অবধি আর দেখা যায় না। ‘মৃণালিনী’ তে প্রথম গানের ব্যাবহার করেন বঙ্কিমচন্দ্র। এই ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে সাহিত্যসম্রাট প্রীতি ও প্রণয়ের প্রকৃত রূপ তা সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন দুটি চরিত্র ‘হেমচন্দ্র’ ও ‘মনোরমা’র কথোপকথনের মাধ্যমে। ‘হেমচন্দ্র’ যখন জিজ্ঞেস করেন ‘মনোরমা’ কে- ”প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই? পাপাসক্তকে কি ভালোবাসিতে হইবে? মনোরমার প্রত্যুত্তরে যেন স্বয়ং লেখকের জীবনদর্শনের চেতনার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে,’মনোরমা’ বলে-”পাপাসক্ত কে ভালোবাসিতে হইবে, প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই, সকলকেই ভালোবাসিবে, প্রণয় জন্মিলেই তাহাকে যত্নে স্থান দিবে; কেন না প্রণয় অমূল্য। তাই, যে ভালো, তাকে কে না ভালোবাসে? যে মন্দ, তাকে যে আপনা ভুলিয়া ভালোবাসে আমি তাকে বড়ো ভালোবাসি।” ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসটিকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে ‘ঐতিহাসিক’ উপন্যাস আখ্যা দিয়েছিলেন।
এই উপন্যাসেই সর্বপ্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের স্বাদেশিকতা ফুটে ওঠে। কেবলমাত্র ১৭জন অশ্বারোহী সেনা বাংলাদেশের হিন্দু রাজশক্তিকে পরাস্ত করে ত্রয়োদশ শতকে-এটা বঙ্কিমচন্দ্র মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। এই উপন্যাসে ‘মনোরমা’ একটি জটিল চরিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জাতির শৌর্য বীর্যের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। বাংলার এই কলঙ্ক বিশ্বাস করতে না পেরে ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।
এই প্রথম তিনটি উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘মৃণালিনী’ লেখার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র যা পরবর্তীকালে তাঁকে সাহিত্যসম্রাটের মর্যাদা দেয়। শুধু ঔপন্যাসিক বা সাহিত্যসম্রাট হয়ে , নিজেকে ,সাহিত্য গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি বঙ্কিমচন্দ্র। একটি প্রথম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্যপত্রের যে প্রয়োজন তা তিনি অনুভব করেছিলেন ,তাই ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাস (১লা বৈশাখ) থেকেই প্রকাশ করেন তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘বঙ্গ দর্শন’ (মাসিক সাহিত্য পত্রিকা)। অনেক বিশিষ্ট কৃতী বাঙালী সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বঙ্গদর্শনের পাতা কিভাবে ভরিয়ে তোলেন তা দেখার জন্য সারা দেশে তোলপাড় পড়ে যায়। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র- সম্পাদক এই পত্রিকার (বঙ্গদর্শন) তাই সভাবতই উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা হবে এটাই আশা। বঙ্গদর্শনের নিয়মিত পাঠক রবীন্দ্রনাথ বলেন, ”পূর্বে কি ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। ………….বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।”
যাইহোক এই বঙ্গদর্শনেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম সেরা উপন্যাস বিষবৃক্ষ'(চতুর্থতম উপন্যাস),- রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শনে প্রথম বিষবৃক্ষ পড়ে বলেছিলেন, ”বঙ্গদর্শনে যে জিনিসটা সেদিন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সকলের মনকে নাড়া দিয়েছিল সে হচ্ছে বিষবৃক্ষ।” এরপরই বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয় ‘ইন্দিরা’। প্রথমে ‘ইন্দিরা’ গল্প হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছিল, পরে এটি ছোট উপন্যাস আকারে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশ পায়। মেদিনীপুরের সাথে সাহিত্যসম্রাটের ছেলেবেলা থেকেই নিবিড় যোগাযোগ। কাঁথি তে থাকাকালীন যেমন তিনি ‘কপালকুণ্ডলা’র পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেন তেমনি তাঁর আর একটি ছোট উপন্যাস ‘যুগালাঙ্গরীয়’ও মেদিনীপুরের ‘তমলুক’ বা প্রাচীন ‘তাম্রলিপ্ত’ তেই ছিল পরিকল্পনা কেন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা শ্যামাচরণ যখন তমলুকে ছিলেন ,তখন তিনি তমলুকে বেড়াতে আসেন। তমলুকের এক উদ্দ্যান বাড়ির (রাজবাড়ী) সৌন্দর্য বঙ্কিমচন্দ্রের ভালো লাগে। তমলুকের সেই গৌরবময় যুগের এক শ্রেষ্ঠীর পুত্র ও অন্য এক শ্রেষ্ঠীর কন্যার ভালোবাসা ও প্রণয় কাহিনী নিয়ে রচনা করলেন তাঁর উপন্যাস ‘যুগলাঙ্গরীয়’।এটি প্রথমে ছোট গল্প হিসেবে পরীক্ষামূলক ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশ পায়। বঙ্কিমচন্দ্র তমলুকের সেই রাজবাড়ী উদ্যান ও রুপনারায়ণ নদের সৌন্দর্য ভুলতে পারেন নি বলেই তমলুক আসার (১৮৬০ সাল) প্রায় ১৫ বছর পর ‘যুগলাঙ্গরীয়’ রচনা করেন।
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটি ১৮৭৫ খ্রি: গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি শুরু থেকে অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক। আমার মতে এটি একটি ব্যতিক্রমী উপন্যাস। ‘বিষবৃক্ষ’ বা পরবর্তীকালে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে যেভাবে বঙ্কিমচন্দ্র নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে অন্যরূপ আঁকতে চেয়েছিলেন, সমাজের নর-নারীর জটিল সম্পর্কে ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটিতে তিনি নর-নারীর শারীরিক সম্পর্কের উর্ধে ওঠে উপন্যাসটিকে একটি অন্য মাত্রা দেন। ‘চন্দ্রশেখর’ একটি ইতিবৃত্তমূলক উপন্যাস। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ‘প্রতাপ’ এখানে একটি আদর্শ চরিত্র। ‘শৈবালিনী’ এই প্রেমকাহিনীর এক অনবদ্য বলিষ্ঠ চরিত্র। এখানে চন্দ্রশেখর একটি বড় মাপের চরিত্র হয়েও গুরুত্ব একটু কম।বঙ্কিমচন্দ্রের মনে বাঙালিদের নিয়ে বীরত্ব ও মহত্বের প্রবল বাসনা ছিল, তারই পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে এই ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে। সজনীকান্ত দাসের মতে, ”আধ্যাত্বিক যোগবলের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের যে বিশ্বাস তার পরিচয় পাওয়া যায় চন্দ্রশেখর চরিত্রে। উপন্যাসের একদম শেষ অংশে লেখকের নিজস্ব উপলব্ধি যেন অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে কলমের ডগায় ফুটে ওঠে, ”তবে যাও, প্রতাপ, অনন্ত ধামে । যাও, সেখানে ইন্দ্রিয়জয়ে কষ্ট নাই, রূপে মোহো নাই, প্রণয়ে পাপ নাই, সেই খানে যাও।যেখানে, রূপ অনন্ত,প্রণয় অনন্ত, সুখ অনন্ত, সুখে অনন্ত পুণ্য , সেইখানে যাও। যেখানে পরের দুঃখ পরে জানে, পরের ধর্ম পরে রাখে, পরের জয় পরে গায়, পরের জন্য পরকে মরিতে হয় না, সেই মহৈশ্বর্যময় লোকে যাও।লক্ষ শৈবালিনী পদপ্রান্তে পাইলেও, ভালোবাসিতে চাহিবে না”।
বঙ্কিমচন্দ্র এই অনন্তধামের যে স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তারই বাস্তব রূপের প্রত্যাশা করেছিল মর্ত্যলোকে। ‘রাধারানী’ একটি উপন্যাস হলেও মূলত এটি একটি বড় গল্প। প্রথমে ‘রাধারানী’ বঙ্গদর্শন পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়, পরে ১৮৭৭ খ্রি: ক্ষুদ্র উপন্যাস হিসেবে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। রথের মেলায় ফুলের মালা বেচতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া একটি মেয়ের কাহিনী নিয়ে এই গল্প। এটি একটি অদ্ভুত মিষ্টি প্রেমের গল্প।
বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তীকালে ‘রজনী’ নামক একটি মনস্ত্বাত্বিক উপন্যাস রচনা করেন। এক জন্মান্ধ ফুলওয়ালী ও তার প্রণয়ের অনুভূতি নিয়ে রচিত এই উপন্যাস। শব্দ ও স্পৰ্শ অনুভূতির মধ্য দিয়ে প্রেমের প্রাণ সঞ্চার হয় উপন্যাসে।’রজনী’ ১৮৭৭ সালে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ পায়। ‘রজনী’ গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র উইলকি কলিন্সের ”A Woman in White” এবং বুলওয়ার লিটনের ”The Last Day of Pompeii” গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেন এবং তিনি জানান, ”অন্ধ ফুলওয়ালী ‘রজনী’ চরিত্র লিটনের উপন্যাসের অন্তর্গত নিদিয়া নাম কানা ফুলওয়ালী চরিত্রের স্মরণে রচিত।” উপন্যাসটিতে ‘রজনী’ একজন কর্তব্যপরায়ণা, যার প্রেম অতলস্পর্শী সমুদ্রের তলদেশের ন্যায় শান্ত ও নিস্তরঙ্গ।
‘বিষবৃক্ষ’ -এর মতো আর একটি জটিল গূঢ় মনস্তত্বের ত্রিকোণ প্রেমের উপন্যাস হল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। সম্ভবতঃ এটি বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা অন্যতম সেরা উপন্যাস। এখানে সাহিত্যসম্রাট তাঁর রোমাঞ্চ প্রবণতা বর্জন করে রূঢ় সমাজ পটভূমিতে আধুনিক সমস্যার রূপ বিশ্লেষণ করেছেন। ত্রিকোণ প্রেমের মর্মান্তিক পরিণতি, ‘বিষবৃক্ষের’ মতো এখানেও বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছেন তবে এখানে তিনটি মূল চরিত্রের অন্যতম এক চরিত্র ‘ভ্রমর’ তাঁর স্বামীকে শেষ অব্দি ক্ষমা করেনি, যা বিষবৃক্ষে সূর্যমুখী করেছিলেন। বঙ্গদর্শনে এই কাহিনী প্রথম প্রকাশ পায়, পরে ১৮৭৮ খ্রি: গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়।
‘রাজসিংহ’ উপন্যাসটিকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রকৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে মনে করতেন। স্বদেশের স্বার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে রাজপূত জাতির যে সংগ্রাম সেটাই এই উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। রাজসিংহের উপসংহারে ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’ -এ বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ”গ্রন্থকারের বিনীত নিবেদন এই যে, কোন পাঠক না মনে করেন যে হিন্দু মুসলমানের কোনো প্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। হিন্দু হইলেই মন্দ হয় না, মুসলিম হইলেই ভাল হয় না। ভাল মন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্য রূপে আছে।” বঙ্গদর্শন পত্রিকাতে প্রথম ধারাবাহিকভাবে রাজসিংহ প্রকাশিত হয়। ১৮৮২ তে প্রথম গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ‘রাজসিংহ’ -এর সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ”রাজসিংহ দ্বিতীয় বিষবৃক্ষ হয় নাই বলিয়া আক্ষেপ করা সাজে না। রাজসিংহ স্বতন্ত্র জাতীয় এবং ঐতিহাসিক উপন্যাস।“
বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম ঐতিহাসিক উপন্যাস হল ‘আনন্দমঠ’। দেশমাতা কে কেমন করে ভালোবাসতে হয় সে মন্ত্র শিখিয়েছেন সাহিত্য সম্রাট। স্বদেশ প্রেম কি, জাতীয়তা কি তা শিহরণ জাগানো ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতের মধ্যে দিয়ে শিখিয়ে গেছেন। জননী ও জন্মভূমির মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই তা বঙ্কিমচন্দ্র বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে গেছেন। আনন্দমঠের মূলমন্ত্র ‘বন্দেমাতরম’ -এর অন্তর্নিহিত তত্ব স্বদেশপ্রীতি। বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের পটভূমিতে ‘আনন্দমঠ’ রচনা করেছিলেন। এই উপন্যাসের মূল ঘটনা ছিল সন্যাসী বিদ্রোহ। যে সময়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, সেই সময়ে ‘আনন্দমঠের’ সন্যাসীরা সংগ্রাম করেছিলেন দেশের বহিঃশত্রুর সঙ্গে। বঙ্কিমচন্দ্রের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ অত্যাচারী অক্ষম শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। বাঙালির জাতীয় জীবনে আনন্দমঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একসময় গীতার মতো ‘আনন্দমঠ’ আমাদের দেশের লোকের হাতে ঘুরে বেড়াত। ভরতের রাজনৈতিক আন্দোলনের নেপথ্যে এই ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটির ভূমিকা গুরুত্ব পূর্ণ। বঙ্কিমচন্দের ধৰ্ম চিন্তাধারার ও স্বদেশ প্রেমের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে এই গ্রন্থে। ১৮৮২ খ্রি আনন্দমঠ গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়।
‘আনন্দমঠে’ বঙ্কিমচন্দ্র অতি অত্যাচারী মুসলিম রাজশক্তির বিরোধিতা ও বিরুদ্বাচারণ করেছেন – এই রাজশক্তি আসলে না ছিল মুসলিমদের সহায়, না ছিল হিন্দুদের সহায় ,সেইসাথে তিনি আনন্দমঠে তৎকালীন অপকৃষ্ট হিন্দুধর্মের ও তৎকালীন জ্ঞানহীন, বলহীন, গুণহীন হিন্দুজাতির প্রতি তীব্র সমালোচনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের এই নিজস্ববোধ, বিশ্বাস ও চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে আনন্দমঠে কেন তিনি দেশ শাসনের রাজদণ্ডটি হিন্দুদের হাতে তুলে দেন নি। লেখকের মতে দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা নির্ভর করে অধিকাংশ সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের পরিমানের উপর তাই তিনি অক্লেশে বলতে পারেন, ”যে পীড়িত হয়, তাহার পক্ষে স্বজাতির পীড়ন ও ভিন্ন জাতির পীড়ন, উভয়ই সমান।”
বঙ্কিমচন্দের আর একটি অনবদ্য উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’ ১৮৮৪ খ্রি: ২০মে উপন্যাস হিসাবে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে তিনি এক সাধারণ ঘরের বাঙালি মেয়েকে চারিত্রিক দৃঢ়তা, কাঠিন্যতা, অপূর্ব বুদ্ধিমত্বা দিয়ে অসাধারণ গড়ে তুলে ছিলেন ভবানী পাঠকের শিক্ষায়। এই গ্রন্থখানি তিনি তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন।এই ‘দেবী চৌধুরানী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার সময় তিনি যে বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন তা হলো—“আনন্দমঠ” প্রকাশিত হইলে পর, অনেকে জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, ওই গ্রন্থের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কিনা। সন্ন্যাসি-বিদ্রোহ ঐতিহাসিক বটে, কিন্তু পাঠককে সেকথা জানাইবার বিশেষ প্রয়েজনের অভাব। এই বিবেচনায় আমি সে পরিচয় কিছুই দিই নাই। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্যেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভান করি নাই। এক্ষণে দেখিয়া শুনিয়া ইচ্ছা হইয়াছে, আনন্দমঠের ভবিষ্যত সংস্করণে সন্ন্যাসি বিদ্রোহের কিঞ্চিৎ ঐতিহাসিক পরিচয় দিব। দেবী চৌধুরানীর ঐরূপ একটু ঐতিহাসিক মূল আছে। যিনি বৃত্তান্ত অবগত হইতে ইচ্ছা করেন, তিনি হন্টর সাহেব কর্তৃক সংকলিত এবং গভর্ণমেন্ট কর্তৃক প্রচারিত বাংলার ‘Statistical Account’ মধ্যে রঙ্গপুর জিলার ঐতিহাসিক বৃত্যন্ত পাঠ করিলে জানিতে পারিবেন। সেকথা বড় বেশি নয় এবং ‘দেবী চৌধুরানী’ গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক, গুডলাক সাহেব, লেফটেনান্ট ব্রেনান এই নামগুলি ঐতিহাসিক, আর দেবীর নৌকায় বাস, বরকন্দাজ, সেনা প্রভৃতি কয়টা কথা ইতিহাসে আছে বটে, এই পর্যন্ত। পাঠক মহাশয় অনুগ্রহ পূর্বক আনন্দমঠকে বা দেবী চৌধুরানীকে ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বিবেচনা না করিলে বড় বাধিত হব।”
বঙ্কিমচন্দ্র অতি সাধারণ মেয়ে ‘প্রফুল্ল’ কে অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ডাকাতরানী ‘দেবী চৌধুরানী’ হিসেবে গড়ে তোলেন ‘ভবানী পাঠক’ -এর সহায়তায়। এখানে লেখক আপন মনের মাধুরী মিশায়ে এক দৃঢ়চেতা সর্বগুনসম্পন্ন ‘ডাকাতরানী’ হিসেবে প্রতিপন্ন করেন। ‘দেবী চৌধুরানী’ -র মূল ঐতিহাসিক ভিত্তি হল সম্ভবতঃ প্রজাবিদ্রোহ। এই উপন্যাসটিতে বঙ্কিমচন্দ্র দেখাতে চেয়েছেন- শিক্ষার দ্বারা লব্ধ জ্ঞান। প্রকৃত শিক্ষা হল চিত্তসংযম শিক্ষা। এই চিত্ত সংযম শিক্ষা মূলত অভ্যাস ও উপদেশ দ্বারা লব্ধ শিক্ষার ফল। লেখক শেষ পর্বে উপন্যাসটিতে দেখালেন যে সর্বগুণ সম্পন্না ‘দেবী চৌধুরানী’ আবার প্রফুল্ল হয়ে সর্বস্ব শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পনের মাধ্যমে সংসারে প্রবেশ করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র অসংখ্য রমণীয়, ব্যাক্তিত্বসম্পন্না ,চরিত্র রচনা করেছিলেন,- কিন্তু ‘প্রফুল্ল’ অনবদ্য অদ্বিতীয়।
‘সীতারাম’ হল বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উপন্যাস। লেখকের শেষবারের মতো উপন্যাসিক স্বত্তা, বুদ্ধিদীপ্ত প্রজ্ঞা, ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা এই উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়। এই উপন্যাসটি ‘প্রচার’ পত্রিকাতে প্রথম প্রকাশিত হয়। কারণ তখন বঙ্গদর্শন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সীতারাম চরিত্রের ট্রাজিডি অপূর্ব নিপুণতার সাথে বঙ্কিমচন্দ্র তুলে ধরেছিলেন- যখন সীতারামের হিন্দু সাম্রাজ্যের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়। ১৮৮৭-৮৮ সালে বঙ্কিমচন্দ্র মেদিনীপুরে ছিলেন। এই সময়েই তাঁর ‘সীতারাম’ প্রথম পুস্তাকারে প্রকাশিত হয়। ‘সীতারাম’ হল তাঁর অমর লেখনী প্রস্তুত, শেষ ধর্মতাত্বিক উপন্যাস। গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন যে, ”সীতারাম ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এই গ্রন্থে সীতারাম ঐতিহাসিকতা কিছুই রক্ষা করা যায় নাই। গ্রন্থের উদ্দেশ্য ঐতিহাসিকতা নহে। যাঁহারা সীতারামের প্রকৃত ইতিহাস জানিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা Westland সাহেবের কৃত যশোহরের বৃন্তান্ত এবং Stewart সাহেবের কৃত বাংলার ইতিহাস পাঠ করিবেন।“
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম একজন অসামান্য সত্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষ স্বদেশ প্রেমিক যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ ঘটে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে। প্রচার পত্রিকায় ১২৯২ খ্রি: বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর জীবনের শেষ উপন্যাসে মুসলমান ফকির চাঁদ সাহেবের জবাবে সীতারামের উদ্দেশ্যে যে কথাগুলি বলেছিলেন সেগুলি আসলে তাঁর নিজের অন্তরের উপলব্ধি, তাঁর একান্ত নিজস্ব চেতনা, তাঁর জাতীয়তাবোধের সঠিক উপলব্ধি মাত্র, সেই কতগুলি যেন আমরা কখনো ভুলে না যাই- ”ফকির বলিল, বাবা! শুনিতে পাই তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু এত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না, তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না, তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে।সেই একজনই হিন্দু মুসলমানকে সৃষ্টি করিয়াছেন; যাহাকে হিন্দু করিয়াছেন, তিনিই করিয়াছেন, যাহাকে মুসলমান করিয়াছেন, সেও তিনি করিয়াছেন। উভয়েই তাঁহার সন্তান; উভয়েই তোমার প্রজা হইবে। অতএব দেশাচারের বশীভূত হইয়া প্রভেদ করিও না। প্রজায় প্রজায় প্রভেদ পাপ, পাপের রাজ্য থাকে না।” ১৮৩৮ খ্রি: ২৬শে জুন, চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত কাঁটালপাড়ায় যে মঙ্গলশঙ্খ জন্মমুহূর্তে বেজে উঠেছিল, তা যেন সংখ্যানিনাদ হয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে পৌঁছে দেবার জয়যাত্রা শুরু করেছিল এই বিশিষ্ট সাহিত্যিকের জন্মমুহূর্তে। -বঙ্কিমচন্দ্র যে অসাধারণ সৃজনী ক্ষমতা সম্পন্ন বিশ্লেষক তা যেন তার সমগ্র মুখমণ্ডলে প্রতিফলিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মুখচেনা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে অসাধারণ এক বিশ্লেষণ করেন-
”বঙ্কিমবাবুর উপরিভাগের কপাল উচ্চ ও প্রশস্ত। ইহাতে বিশ্লেষণ শক্তি ও হাস্যরস প্রকাশ পায়। আবার ইহার নিচের দিককার কপাল বেশ উঁচু ইহাতে ছোট খাটো জিনিস খুব ইঁহার নজরে পড়ে। তত্ত্বজ্ঞান অপেক্ষা বিজ্ঞানের দিকে ইঁহার বেশী ঝোঁক প্রকাশ পায়। তত্ত্বজ্ঞানের বিষয় লিখতে গেলেও ইনি বিজ্ঞানের প্রণালী অবলম্বন করিয়া লিখিতে ইচ্ছা করিবেন। বিশ্লেষণ শক্তি, পর্যবেক্ষণ শক্তি অধিক পরিমানে থাকায় তাঁহার উপন্যাসে মানব চরিত্রের ও বাহ্য প্রকৃতির বর্ণনায় এরূপ অসাধারণ ক্ষমতা প্রকাশ পাইতেছে। ………… বঙ্কিমবাবুর অসাধারণ নাক। এই নাকে সুরুচি, অভিনিবেশ, মানব–চরিত্রজ্ঞান ও অসাধারণ উদ্যম প্রকাশ পায়। তাঁহার এজলাসি কাজ সত্ত্বেও উপর্যুপরি এতো উৎকৃষ্ট গ্রন্থ যে তিনি লিখতে পারিয়াছেন সে সকল তাঁর নাকের জোরে। বঙ্কিমবাবুর ঠোঁট খুব সরু ইহাতে কার্যকরী বুদ্ধি– সুক্ষ রুচি ও অসাধারণ দৃঢ়তা প্রকাশ পায়। বঙ্কিমবাবুর চোখে বহিঃদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণতা প্রকাশ পায়, …….. বঙ্কিমবাবুর চেহারায় নেপোলিয়ানের মুখের কিছু আভাস পাওয়া যায়। নেতার লক্ষণ ইঁহার মুখে জাজ্বল্যমান। ইঁহার খড়্গ–নাসা, চাপা ঠোঁট, তীক্ষ্ণ চোখ লইয়া ইনি যদি কাহারও ওপরে গিয়া পড়েন তবে যে হতভাগ্য বজ্রাঘাতের মর্ম বুঝিতে পারিবে। বঙ্কিমবাবু নাকের নিম্নদেশ যেরূপ ঝুঁকিয়া আসিয়াছে এবং তাঁহার চিবুকের নিচে যেরূপ ফুল দেখা যাইতেছে ইহাতে তাঁহার অর্থোপার্জন স্পৃহা ও মিতব্যয়িতা প্রকাশ পাইতেছে।” বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এমন প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লেখককে শুধুমাত্র কয়েকটি উপন্যাস বা প্রবন্ধের মাধ্যমে জানা বা চেনা সম্ভব নয়। বঙ্কিমচন্দ্রকে সামগ্রিক জানার প্রয়াস তাই আমার আজীবন চলবে।বাংলার সাহিত্যাকাশে অমর ঔপন্যাসিক বিশ্লেষক স্বদেশপ্রেমিক হয়ে আমাদের হৃদয়ে তুমি বিরাজ করবে।
রচনা সূত্র:
১)বঙ্কিমজীবনী, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
২)বঙ্কিম রচনাবলী
৩)বঙ্গে বিজ্ঞান (উন্মেষ পর্ব)-আশীষ লাহিড়ী
৪)প্রতিভার অবতার বঙ্কিমচন্দ্র, নব্য ভারত ১৩০১ বৈশাখ
৫)বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভারতী ১৩০১ আঃ