পশ্চিম মেদিনীপুর:- এখনও স্বাধীনতা দিবসের দিন সর্বত্র উত্তোলিত হয় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তিরঙ্গা।স্বাধীন ভারতের এই জাতীয় পতাকার রূপকার হিসেবে পিঙ্গালী বেঙ্কাইয়াকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতবর্ষ।কিন্তু জাতীয় পতাকা তৈরি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আজও উপেক্ষিত হেমচন্দ্র কানুনগো।আসল নাম হেমচন্দ্র দাস কানুনগো।স্বদেশ প্রেমী এই বীর বিপ্লবীই ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয় পতাকার স্কেচ তৈরি করেন বিদেশের মাটি থেকে।সালটা ১৯০৭।জার্মানির স্টুয়ার্টগার্টে সেই পতাকা তুলে ধরেছিলেন ভিকাজী রুস্তম মাদাম কামা,একজন ভারতপ্রেমী স্বাধীনতা সংগ্রামী পার্সি মহিলা।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আলিপুর বোমা মামলার অন্যতম রূপকার, হেমচন্দ্র কানুনগোকে ” অগ্নিযুগের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য ” বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব এই উপমহাদেশের ইতিহাস।
১৮৭১ সালে তদানীন্তন নারায়ণগড় থানার রাধানগর গ্রামে তাঁর জন্ম। জন্মতারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।কোথাও উল্লিখিত ৪ আগষ্ট আবার কোথাও ১২ জুন।বাবা ক্ষেত্রমোহন, মা কমলেকামিনী দাস কানুনগো। কমলেকামিনী ছিলেন দাঁতন থানার খন্ডরুই গড়ের রাজা( জমিদার) কালীপ্রসন্ন সিংহ গজেন্দ্র মহাপাত্রের বোন।শৈশবে বড়মোহনপুর হাইস্কুল ( তদানীন্তন নাম বড়মোহনপুর মধ্য ইংরেজী স্কুল) এ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই মেদিনীপুর টাউন স্কুলে ভর্তি হন। এরপর মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হন। যদিও পরে ডাক্তারি পড়তে প্রভাবশালী মামার ইচ্ছা পূরণ করতে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিহন। না, সম্পূর্ণ হয়নি। তিনবছর পর তিনি কলকাতার সরকারী আর্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানেও মাত্র ছ’ মাস। কলকাতা ছেড়ে মেদিনীপুরে ফিরে আসেন।কারন ততদিনে তাঁর বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের কাছে তাঁর স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষা হয়েগেছে। মেদিনীপুরে কলিজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা,কলেজে রসায়নের ইনষ্ট্রাক্টার, জেলাবোর্ড এর চাকরি কিছুদিন করেই ছেড়েদেন। মেদিনীপুরের আর এক দিকপাল ঋষি রাজনারায়ণ বসুর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথ এবং সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক তৈরী হয়। হেমচন্দ্র নাম লেখান অনুশীলন সমিতিতে।
১৯০৩ সালে মেদিনীপুরে আসেন ভগীনি নিবেদিতা। মিঞাবাজার এলাকায় তিনি একটি আখড়ার উদ্বোধন করেন। এদিকে হেমচন্দ্রের পরিবার পরিজনেরা তাঁর বিয়ে দিয়ে ঘরপালানো মনকে বাঁধবার চেষ্টা করেন। তমলুকের পাঁচবেড়িয়ার শরৎকুমারী দেবীর সঙ্গে হেমচন্দ্রের বিয়ে হয়। দুইকন্যা ও এক পুত্রের জন্ম হয়। কন্যাদ্বয়ের মৃত্যু হয়। তবুও ভেঙে পড়েননি এবং বাঁধা ওপড়েননি সংসারে।
ভগিনী নিবেদিতার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি এবং তাঁর দুই বন্ধু জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু বদ্ধপরিকর হন ইংরেজকে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়েই ভারতছাড়া করবেন।
১৯০৫ এ ভারতছাড়ো আন্দলোনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর তর সইল না। ১৯০৬ সালেই তিনি ইউরোপ যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড এর বিপ্লবীদের কাছ থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের তথ্য সংগ্রহ এবং প্যারিসে বোমাতৈরির কৌশল শেখা। তারপর তিনি দেশেই জাতীয় পতাকা বানান বিদেশে বসেই।পতাকার মধ্যেও ছিল বিভিন্ন বার্তা ও তথ্য। তবে বেঙ্কাইয়া জাতীয় পতাকার রূপ দিয়ে পরিবর্তন করে মাঝে সাদা রঙে চরকার জায়গায় অশোক চক্র আঁকেন। তা গৃহীত হয় ১৯৪৭ এর ২২ জুলাই।হেমচন্দ্র অনেক আগে সেই পথ প্রশস্ত করলেও জাতীয় পতাকার ইতিহাসে হেমচন্দ্র উপেক্ষিত।
বিদেশ থেকে বোমা তৈরি শিখে এসে তিনি কলকাতা ও চন্দন নগরে বোমা তৈরির শিবির করেন। ১৯০৯ সালে আলিপুর বোমা মামলা তারই অন্যতম ফল। তিনি তাঁর শিষ্য ক্ষুদিরাম বসুর হাতেও বোমা তুলে দিয়েছিলেন। আলিপুর বোমা মামলায় তাঁর দ্বীপান্তর হয়। ১৯২০ সালে দীর্ঘ ১১ বছর পর আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পেয়ে রাধানগর গ্রামে নিজের তৈরি বাড়িতেই শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৫১ সালে ভারতমাতার এই কৃতি সন্তানের মৃত্যু হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন হেমচন্দ্র আজ উপেক্ষিত, তেমনি রাধানগর গ্রামে উপেক্ষিত তাঁর ভিটেও। চলতি বছরে উক্ত গ্রামের অঞ্চল থেকে দু লক্ষ টাকা প্রোজেক্টের একটি বাউন্ডারি এবং তর বসত বাড়ির সামনে যে আবক্ষ মূর্তিটি রয়েছে তাকে ঘিরে একটি পাকারের সেট তৈরি করা হয়েছে । গ্রামের মানুষের অভিযোগ হেমচন্দ্রের দেখানো পথে দেশ স্বাধীন হলেও তাঁকে মর্যাদা দিতে ভুলে গেছে আমাদের দেশ। এটাই স্বাধীনতার অন্যতম যন্ত্রণা এলাকাবাসীর।