করোনা-উত্তর পৃথিবীটা আরো নতুন হবে: বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর

ডেস্ক রিপোর্ট ঢাকা: করোনাকালের এই দুঃসময়কে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছেন দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। চার মাস ধরে বাসায় স্বেচ্ছাবন্দি তিনি। এক দিনের জন্যও বের হননি। এই সময়টায় নিজেকে গবেষণা কাজে ব্যস্ত রাখা ড. আতিউর একান্ত আলাপচারিতায় জানালেন সময়টা একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং। আবার নিজস্ব চিন্তাভাবনা করারও। জীবনে আর কখনো এত একান্ত দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়নি।

সময়টাকে যেভাবে কাজে লাগাচ্ছেন সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘এই সুযোগে অনেক কাজ, যেগুলো আগে করার সুযোগ মেলেনি, তা করছি। কয়েকটি বই লিখছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লেখালেখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার হিসেবে তাঁকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে দুটি লেখা লিখছি। অনলাইনে বিভিন্ন লাইভে যোগ দিচ্ছি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং বিষয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্সও অনলাইনে পড়ালাম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ বক্তৃতা দিচ্ছি। দেশেবিদেশে সেমিনারে অংশ নিচ্ছি। তরুণদের উদ্দীপনা দিতে নেতৃত্ব বিষয়ে কথা বলছি। এনডিসিসহ নানা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণধর্মী অধিবেশনে অংশগ্রহণ করছি। কাজ করার আরেকটা সুবিধা হলো এই সময়টায় দর্শনার্থীরা কেউ আসছেন না।

দিনের সূচিটা জানতে চাইলে দেশবরেণ্য মানুষটি হাসতে হাসতে বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে গরম পানির সঙ্গে লেবুর রস, মধু, আদা, লবঙ্গ, নিমপাতা মিশিয়ে খাই। সঙ্গে একটু কালিজিরা আর রসুন। এভাবে দিন শুরুর পর চিঁড়া দই কলা কিংবা আম দিয়ে সকালের নাশতা সারি। পরে দরজার লক থেকে শুরু করে পুরো ঘর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করি। এরপর ট্রেডমিলে আধাঘণ্টা হাঁটি। গোসলের সময় গরম পানিতে নিমপাতা মিশিয়ে ভাপ নিই, গার্গল করি। তারপর পড়ার টেবিলে বসি।

কথা বলতে বলতে একটু থামেন। রেশ কাটার আগেই ড. আতিউর ফের যোগ করেন, ‘আমি দুটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য। এর একটি অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট। এখানে বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, কী প্রকাশিত হচ্ছে, তা জানারপড়ার সুযোগ রয়েছে। কখনো কখনো লিখিও। এর বাইরে বই পড়াও চলছে সমান তালে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প, সিনেমা দেখা, টেলিভিশন দেখাএসব করতে করতে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি।

বাইরে নানা কাজে ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব হতো না। করোনার এই সময়টা সে সুযোগ করে দিয়েছে। পরিবার বলতে বাসায় আছে আমার স্ত্রী আর ছোট মেয়ে। মেয়েটি বিদেশে গ্র্যাজুয়েশন করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছে। বড় দুই মেয়ে বসবাস করে বিদেশে। স্ত্রী ডাক্তার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কর্মস্থল। অনেক দিন পর পরিবারের সঙ্গে সময় দেওয়ার অবারিত এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের সঙ্গে গল্প করা, সিনেমা দেখা, এমনকি রান্নাও করছি। দেশের বাইরে যে দুই মেয়ে রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলছি। প্রচুর শুভাকাঙ্ক্ষী ফোন করেন, ছাত্রছাত্রীরাও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা ফোন করেন। কথা বলে ভালোই সময় পার হচ্ছে।

আবার এই সময়টায় অনেক কষ্টের ঘটনাও ঘটছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড. আতিউর বলতে থাকেন, ‘ছোট বোনের স্বামী করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেলেন। আর চারজন খুব প্রিয় মানুষকে হারিয়েছি এই সময়। জামিলুর রেজা চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী, আল্লাহ মালিক কাজেমী। ভীষণ মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের জন্য স্মরণকথা লিখেছি। স্মৃতিকথা লেখা খুব কষ্টের। মনের ভেতর উথালপাথাল ঘটে যায়। এভাবে ভালোমন্দ মিলিয়ে পার হচ্ছে সময়।

করোনা পরিস্থিতিতে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভোলেননি ড. আতিউর। তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের নির্বাহী সভাপতি। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশজুড়ে যেসব শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী সমস্যায় রয়েছেন তাঁদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।প্রথমে নিজেরা টাকা দিয়ে ফান্ড করলাম। এটা করতে গিয়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। বিদেশে অনুষ্ঠান করে কয়েকজন সহায়তা পাঠিয়েছেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। সব মিলে প্রায় ৩০৩৫ লাখ টাকার ফান্ড সংগ্রহ হয়। এই দুঃসময়ে দেশজুড়ে প্রায় এক হাজার ২০০ শিল্পীকে সে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

এ সময় কিছু কাজের পরিকল্পনা বিষয়ে বলতে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টান ড. আতিউর।একটা স্বপ্ন তাড়া করছে। রবীন্দ্রনাথের টেকসই উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে একটা বই লেখা। কিছুটা কাজ এগিয়েছি। আরেকটি পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা নিয়ে পৃথক আরেকটি বই লেখা।

একান্ত আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদ জানালেন, করোনা এখন যেমন অভিশাপ, পরে সেটা আশীর্বাদও হয়ে উঠতে পারে।করোনাউত্তর পৃথিবীটা অনেক বেশি নতুন হবে। একেবারে অন্য এক পৃথিবী। প্রকৃতির যে দান, সেটা আমরা বুঝতে পারব। মানুষের জ্ঞান আর প্রকৃতির দান মিলে সভ্যতা। প্রকৃতির ওপর আমরা যে অবিচার করেছি, তা বোঝা যাচ্ছে। এই শিক্ষাটা নিয়ে প্রকৃতিবান্ধব উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে। ভোগবিলাস কমাতে হবে।

একটু ভেবে নিয়ে ফের যোগ করেন, ‘জীবনযাপনও হয়তো পাল্টে যাবে। হয়তো সাত দিন আর অফিস করা হবে না। ক্লাসও হয়তো গিয়ে আর করা হবে না। অনলাইনে হবে। যদি চারছয় মাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্জাগরণ ঘটবে। কারণ আমাদের কৃষি আমাদের রক্ষাকবচ। এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতোই কৃষকবান্ধব বাজেটে জোর দিয়েছেন। আমার ধারণা, আর দশটি দেশের চেয়ে অনেক দ্রুত আমরা অর্থনৈতিক পুনরুত্থান ঘটাতে পারব।

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

রবীন্দ্র সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শনিবার রাতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে

কলকাতা, ১৬ নভেম্বর ২০২৪:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে আগামী শনিবার রাত থেকে রবীন্দ্র সেতু…

1 day ago

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

2 days ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

2 days ago

বিহারের জামুইতে ভগবান বীরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনজাতীয় গৌরব দিবসে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের জামুই জেলায় জনজাতীয় গৌরব দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে…

2 days ago

২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আগামী ২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। ঐ একই দিনে নান্দেথ…

3 days ago

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তায় ‘সরস মেলা’র উদ্বোধন করবেন ।আগামীকাল তিনি যাবেন…

3 days ago