“অজানা এক শঙ্কায়, ভয়ে, চিন্তায় থাকতাম। যদি কিছু হয়ে যায় !” – আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প ও উপলব্ধি


সোমবার,১৫/০৬/২০২০
709

ঢাকা – বাংলাদেশ : মানুষ উদ্যোক্তা হয় কখন? যখন সে তার নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাজ কে পেশায় পরিণত করতে চায় তখনই সে সেই প্রিয় কাজ থেকে একজন উদ্যোক্তা হয়। আমি অনেক আপুদের চিনি যেমন Kakoly’s Attire 🍁  এর কাকলী আপুর জামদানীতেই শান্তি, Layla Sarmeen আপুর তাঁত, Samia Farah আপুর মত ইউনিক ডিজাইনার কম দেখেছি, Roji Rose আপু চা কেই ভালোবেসেছে, Samroj Sultana আপুর মাংসের আচার, Afroza Quader আপুর রুটি কিংবা বিফ ভুনা, Sultana Bhuiyan আপুর বেতের অসাধারণ কাজ, Bristy Raj Retu আপুর সন্দেশেই তৃপ্তি, @জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া আপুর একেবারেই দেশীয় হাতের কাজের জামা, Aditi Roy Chowdhury আপুর কাঠের গহনা , @kamrun nahar shima আপুর আর্টিফিশিয়াল ক্লে দিয়ে গহনা, আফসানা সুমী আপু রঙ তুলির রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারে, Rajia Sultana আপুর মজাদার Musammath Ummee Haniআপুর নবনীতাই যেমন তার ভালোবাসা Raihana Akther আপুর মাশরুম, সবারই উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে তাদের যে বিষয় গুলিতে ভালোলাগা ও ভালোবাসা তারা সেটকেই নিজের উদ্যোগ বানিয়েছেন।

আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প একেবারেই ভিন্ন। হানি আপু মাত্র ১৯ বছর বয়সেই একজন লাখপতি উদ্যোক্তা হয়েছেন। কি যে ভালো লাগলো দেখে। কিন্তু আমি আমার ৪০ বছর বয়সে এসে সাহস করেছি একজন উদ্যোক্তা হবার। সুতরাং, একজন উদ্যোক্তা হতে সবচেয়ে যেটা প্রয়োজন তা হলো সাহস করে কাজে নেমে পড়া। যার সাহস নাই, তার উদ্যোক্তা হওয়া মানায় না।

আমি ১৯৯৭ সালে প্রথম আয় করা শুরু করি যখন ইন্টারমিডিয়েট এ পড়ি। একটা স্টুডেন্ট এর যা কাজ আর কী, স্টুডেন্ট পড়ানো। তখনই এক হাজার টাকা পেতাম। ১৯৯৯ সালে প্রথম কম্পিউটার শিখি, যারা অনেক পুরাতন তারা নিশ্চয়ই জানেন ডস মোডে কাজ করা, ওয়ার্ড প্রেস এ কাজ কিংবা ফক্স প্র তে কাজ। ওই সময় এম.এস ওয়ার্ড, এক্সসেল, পাওয়ার পয়েন্টে এত সুন্দর কাজ পারতাম! তখন মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। এর পর বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জনাব মোস্তাফা জব্বার স্যার এর সরাসরি স্টুডেন্ট হিসেবে আনন্দ মাল্টিমিডিয়ায় গ্রাফিক্স এর কাজ শিখলাম। সত্যি বলতে তখন থেকে মাথায় ঘুরতে থাকলো একটা আইটি ও কোচিং সেন্টারের। কিন্তু ছিল না কোন ইনভেস্টমেন্ট। আমি জানলাম, ইনভেস্টমেন্ট ছাড়া কোন উদ্যোগ শুরুই করা যায় না। যার টাকা নেই, সে কোন কিছু করতে পারেনা।

২০০৬ সালে আইডিবি থেকে একটা স্কলারশিপ পেলাম, নেটওয়ার্কিং এর উপর। মেয়েরা তখন খুব কম কাজ করে নেটওয়ার্কিং এ। টাওয়ার এ যখন তখন যাওয়া, রাউটিং করা, সে এক অন্যরকম ব্যাপার! সবাই বলতে থাকল, তুমি মেয়ে, এই নেটওয়ার্কিং এ কেন? কীভাবে কাজ করবে? রাতে যখন তখন কাজ করতে হবে। বন্ধু বান্ধবী মিলে ঠিক করলাম আমরা সার্ভিস দিব। কিন্তু বিধি বাম। শুরু করতেই পারলাম না।

আমি সাবরিনা খান, ৪০ বছর বয়সে এসে উদ্যোক্তা হয়েছি। আমার গল্প আমি শোনাতে চাই। অনেক অনেক ঘটনা, দুর্ঘটনার পর আজকে আমি একজন উদ্যোক্তা।

আমি ভীষণ স্বাধীনচেতা একটা মেয়ে। যেহেতু তিন বোন, কোন ভাই নেই। আব্বু যখন আমার সাড়ে চার বছর বয়স তখন থেকেই বিদেশে। তখন আমরা দুই বোন। আম্মুই সব করেছেন আমাদের জন্য। আমি বড় মেয়ে বলে বাড়ির অনেক কাজ যেটা আব্বু কিংবা ভাইদের করার কথা, আম্মুর পরেই আমি করতাম। ফলে ভেতরে ভেতরে একজন নেত্রীর জন্ম হচ্ছিল, তেমনই একটা মানসিকতা গড়ে উঠেছে ছোট থেকেই। যথেষ্ট পরিমাণ সচ্ছলতা ছিল বাড়িতে।

সেই ৮৪ সালেই বাড়িতে সনির রঙ্গীন টিভি, ডায়াল করা টেলিফোন, জাপানী হিটাচী ফ্রিজ, ইলেকট্রিক ওভেন (আম্মু তখনই ওভেনে কেক বানাতেন) আলহামদুলিল্লাহ। তবে আম্মু ভীষণ বুদ্ধি করে সব কিছু ম্যানেজ করতেন। বেশ সম্পত্তি করে ফেললেন। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আমার নিজের আয়ের দিকে ভীষন ঝোঁক ছিল। সব সময় ভাবতাম কি করি, কি করি!! ছোট থেকেই ভেতরে কাজ করত নিজের কিছু হবে, আমার একটা অনেক বড় কোম্পানি হবে।

আব্বু বিদেশ থেকে চলে এলেন ৯০ এর দিকে। ঘরে নতুন আরো একটা বোন এলো বছর দুয়েক পর। আম্মু তখনো সংসারের মূল চালিকা। আব্বু একটু শান্ত এবং ভীতু প্রকৃতির। আম্মু ভীষন সাহসী, নির্ভীক এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। এই সময়ে আগের মত রাজকীয় পরিস্থিতি আর নাই। আম্মুকে ততদিনে বাধ্য করে দিয়েছে অনেক পরিবর্তন হতে। ৯৯ সালের দিকে আব্বু ব্রেইন স্ট্রোক এ পুরোই বিছানায়। আম্মু হাল ধরলেন, আব্বুর সেবা যত্ন করা, সংসার, তিন মেয়েকে ভীষন ভালো ও নৈতিকতার সাথে লালনপালন করা, সব কিছু। আম্মু ৭৮ এর সময়ের বিয়ে পাশ হওয়া সত্ত্বেও শশুর বাড়ী থেকে জব করতে দেয়া হয়নি। সব পরিবারেই যা হয় আর কি। এত গুলি বছর পর আম্মু কিভাবে সংসার চালাবেন! কি করবেন?? সেই সময় আম্মু কিছু মেয়েদের নিয়ে একটা হস্তশিল্প গড়ে তুললেন। নকশি কাঁথা, বিছানায় চাদর, থ্রি-পিস করে সেল করতে লাগলেন। আম্মু একজন সফল উদ্যোক্তা।

কিন্তু আমি পারিনি !

আগেই বলেছি, ১৯৯৭ সাল থেকেই আমি স্টুডেন্ট পড়াতাম, তখন যশোরে ছিলাম। নিজের সেন্টারের স্বপ্ন পূরণ না হলেও ২০০০ সালে একটা কম্পিউটার সেন্টারে প্রশিক্ষক কাম সেলস এ কাজ শুরু করলাম। আমি জানি সকল মেয়েই নিজের টাকা দিয়ে নিজের শখের জিনিস কেনে, গয়না কেনে, জামা কেনে, শাড়ি কেনে, আরো কত কি কেনে! কিন্তু এই একটা ব্যাপার সেই ছোট থেকে আজ অবধি রপ্ত করতে পারলাম না, নিজের জন্য খরচ করা আজও শিখলাম না। সেই ৯৭ সালে ১৭ বছর বয়সেও বাড়ির জন্য, ছোট বোনদের জন্য কিছু না কিছু কিনতাম। অনার্স মাস্টার্স এর সকল বই নিজের টাকায় কিনতাম। আর স্বপ্ন দেখতাম আমি নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজের মত কাজ করছি।

ডিসেম্বরে জন্ম আমার, ধনু রাশি ভীষণ রকম নারীবাদী। শ্রদ্ধেয় বেগম রোকেয়া আদর্শ। ভীষণ ইচ্ছে আমার প্রতিষ্ঠানে সব নারীরা কাজ করবে। আহা ২০ বছরের মেয়ের একজন উদ্যোক্তা হওয়া আর হয় না!

২০০৩ সালে বিয়ের আগেই বরের সাথে শর্ত থাকে, আমার কাজ আমি করে যাব এবং আমার আব্বু আম্মু বোনদের সব দায়িত্ব আমার। আমি তাদের সন্তান, মেয়ে নই। দুই বছরের বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা এবং এক বছরের মধ্যে উভয় পরিবারে সম্মতিতে বিয়ে। প্রতিটি মেয়েরই নতুন জীবনে নতুন পরিবারে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদিও আমি কেবল দুইদিনের জন্য সে বাড়িতে ঠাঁই পেয়েছি। সে সব কথা না বলি। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়া তো দূরের কথা, চাকরিজীবী একটা মেয়ে বিয়ের পর বরের সাথে ঢাকা আসার জন্যও বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমার বাড়ির প্রতিটি মানুষ বিশেষ করে আমার আম্মু হিমালয়ের মত আমার পাশে প্রতিটি মুহুর্তে থেকেছেন বলেই আমি ঢাকা এলাম।

২০০৪ সালে ঢাকা এলাম। কি করব! চাকরী তখনো পাইনি, সবে মাস্টার্স পাশ করেছি। এত টা দিন নিজের টাকায় চলেছি। কি করি কি করি! এই সময় আম্মুর হস্ত শিল্পের বেশ কিছু সেল করলাম একেবারেই আত্মীয়দের মধ্যে। কিন্তু তখনও ভেতরে সেই সাহস বা মনোবল ছিল না কিভাবে এগিয়ে যাব??? বোকা ছিলাম, কত বড় বোকা, আর ছিল না এমন উই। কেউ ছিল না পাশে। কোথায় যাব কি করব বুঝতাম না। মফস্বলের একটা মেয়ে, বাইরের জগতে মিশিনি কখনো। আমি বরাবরই পল্লবী থাকি। ধানমন্ডি আট নাম্বারে একটা চার তলা বিল্ডিং এ পুরোটা জুড়ে সুপার শপ ছিল, shop n save. ওদের ওখানে একদিন গিয়ে কথা বললাম। আমার প্রায় পনের হাজার টাকার কাপড় দিয়ে এলাম। ওরা বলল, কাপড় বিক্রি হলে টাকা পাব। অজানা এক শঙ্কায়, ভয়ে, চিন্তায় থাকতাম। যদি কিছু হয়ে যায়। এত গুলি টাকার জিনিস! কি মনে করে ৭ দিন পর নিয়ে এলাম কাপড় গুলি, এক প্রকার জোর করেই। আল্লাহর কি রহমত, আট দশ দিন পর যেয়ে দেখি পুরা শপটাই উধাও। কি কারনে বন্ধ হয়েছিল জানি না।!!!

কিভাবে হব উদ্যোক্তা!!!! চারিদিকে এত অসৎ মানুষ, কার কাছে যাব? কোথায় সেল করব? সবাই দাম কমাতে চায় ?

হেরে গেলাম আমি, হেরে গেলাম। আম্মুর হস্তশিল্প থেকে দেশীয় একটা পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি আমাকে হতে দেয়নি একজন প্রকৃত উদ্যোক্তা!!!!

আমি সাবরিনা খান, ৪০ বছর বয়সে এসে আমি একজন উদ্যোক্তা হয়েছি। বহু ঘটনা, দুর্ঘটনার পর আজ আমি আমার ডোরা কে প্রতিষ্ঠা করেছি

ঘুরে আসুন ডোরার অফিসিয়াল ফেসবুক থেকে : https://www.facebook.com/pg/DORAsFoodsCatering

সাবরিনা খান
(বাংলাদেশ)

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট