ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা: দেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবরে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য বলা হলেও রাজধানীসহ সারাদেশের বাজার, শপিং মলসহ জনবহুল এলাকাগুলোতে মানুষের সমাগম কমে গেছে। মাস্ক, স্যানিটাইজারসহ কিছু পণ্য উধাও হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর প্রকাশের পর ৯ মার্চ সোমবার দেশের পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধস নেমেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও আগে থেকেই উদ্বেগ ও শঙ্কার পূর্বাভাস দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান পরিবহন বন্ধ হওয়ায় এ শঙ্কা আরও জোরালো হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য স্থবিরতা বিরাজ করছে। অন্য দেশের সঙ্গেও বাণিজ্য স্থবির হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অবশ্য দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হচ্ছে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করলেও এখন পরিস্থিতে ভিন্ন দিকেই গড়াচ্ছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, করোনাভাইরাস খারাপ অবস্থায় গেলে ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সবচেয়ে খারাপ দিকে গেলে বাংলাদেশ ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। প্রায় ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে বলেও এডিবি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। এক বছরে জিডিপির ১ শতাংশের বেশি ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ রোববার প্রথম তিনজনের দেহে এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। এ কারণে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মসূচি শিথিল করা হয়েছে। মুজিববর্ষের মূল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। বড় ধরনের জনসমাগম এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে আক্রান্তদের চিকিৎসাসহ ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা জারি করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালনায় আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরসমূহ, সমুদ্র বন্দরমূহ, স্থলবন্দরসমূহে বিদেশ থেকে আগত সব যাত্রীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভাইরাস শনাক্তকরণ সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা সরঞ্জামসহ যাবতীয় সরঞ্জাম বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাবান–পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, হাত না ধুয়ে (মুখ, চোখ, নাক) স্পর্শ না করা, হাঁচি–কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখা, ঠা–া বা ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা না করাসহ মুখে জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে সেই জন্য মাস্কের ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তাররা। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আতঙ্ক না হওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ডাক্তারদের সচেতনামূলক পরামর্শে অনেককেই ফার্মেসি বা ফুটপাতে মাস্ক কেনার জন্য ভিড় করতে দেখা গিয়েছে। আতঙ্ক পুঁজি করে পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি দামে মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। রাস্তাঘাটে অধিকাশ মানুষদের মাস্ক পড়ে বের হতে দেখা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভাইরাসে আক্রান্তের খবর ছাড়ানোর পর প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের কম–বেশি দাম বেড়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, যেখানে অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাস একটি মহামারী আকার ধারণ করেছে।
কয়েক হাজার লোক চীনসহ বিভিন্ন দেশে মারা গিয়েছে। সেই ভাইরাসের সংক্রমণে আমাদের দেশে পাওয়ায় এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা আর্থিক সুবিধা নিচ্ছে। গতবছর ডিসেম্বরে চীন থেকে সংক্রমিত হওয়া করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগকে ‘কভিড–১৯’ নাম দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়া করোনাভাইরাসে এক লাখের বেশি মানুষের শরীরের শনাক্ত হয়েছে। সারাবিশ্বে মারা গেছেন সাত হাজারের বেশি মানুষ। এরমধ্যে শুধু চীনেই মারা গেছেন তিন সহস্রাধিক মানুষ। ইরানে গত ৬ মার্চ শুক্রবার পর্যন্ত মারা গেছেন ১২৪ জন। ফ্রান্সে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে দুই শতাধিক ব্যক্তির শরীরে। এছাড়া ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ায়ও বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৬ জন এবং দেশটিতে সর্বশেষ শুক্রবার একজনের মারা যাওয়ার খবর দেয়া হয়েছে। এছাড়া জার্মানি, স্পেন, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, বাহরাইন, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ডসহ ৯০টির মতো দেশ ও অঞ্চলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশ্বজুড়ে দাপট ছাড়ানো করোনাভাইরাসে শুরু থেকেই বাংলাদেশেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। রোববার করোনাভাইরাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ৩ জন রোগী শনাক্ত হয়।
সম্প্রতি ইতালি থেকে দু’জন প্রবাসী দেশে ফেরার পর তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে পরীক্ষা–নিরীক্ষায় তাদের শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইসিডিআর)। তাদের সংস্পর্শে থেকে আক্রান্ত হয় পরিবারের আরেক সদস্য। আক্রান্ত ওই ৩ জনকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের বয়স ২০–৩৫ বছরের মধ্যে। এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত মানুষ আইসোলেশনে রাখা হয়েছে । সার্বিক পরিস্থিতিতে হিসাব–নিকাশ চলছে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য ও সেবা খাত এই ভাইরাসের প্রভাবে কেমন ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আগাম পূর্বাভাস পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিশ্ব সবচেয়ে ভালোভাবে এই ভাইরাস সংক্রমণ সামাল দিতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ৮০ লাখ ডলার। আর মোটামুটি ভালোভাবে অর্থাৎ সংক্রমণ তীব্র হওয়ার তিন মাসের মাথায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা গেলে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে এক কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা জিডিপির দশমিক ০১ শতাংশ। এডিবি বলছে, করোনাভাইরাসের বিস্তার এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পর্যটন, ভ্রমণ, বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থায় ধাক্কা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস, সরবরাহ ব্যাহত ও স্বাস্থ্যগত প্রভাবে এই ক্ষতি হবে। অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা কী হবে তা নির্ভর করছে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কতটা বিস্তৃত হবে তার ওপর, যা এখনও খুবই অনিশ্চিত। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে পাঁচটি খাতে করোনার প্রভাব বাংলাদেশে বেশি পড়তে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ব্যবসা–বাণিজ্য ও সেবা খাতে। এই খাতে ১১৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া কৃষি খাতে ৬৩ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে। এছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ ও এসংক্রান্ত সেবা খাতে প্রায় ৫১ কোটি ডলার; উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৪০ কোটি ডলার এবং পরিবহন খাতে সাড়ে ৩৩ কোটি ডলার ক্ষতি হবে। এডিবির পর্যালোচনায় নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ ৭৭ বিলিয়ন থেকে ৩৪৭ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত, যা জিডিপির দশমিক ১ থেকে দশমিক ৪ শতাংশ হবে। পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ না হলে ভাইরাস সংক্রমণ তীব্র মাত্রায় পৌঁছার তিন মাসের মাথায় পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মতো বিধি–নিষেধ কাটতে শুরু করলে বৈশ্বিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির দশমিক ২ শতাংশ। সংস্থার প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়াসুউকি সয়াডা বলেন, করোনা নিয়ে অর্থনৈতিক প্রভাবসহ অনেক দিক দিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ক্ষতির স্পষ্ট চিত্রের জন্য নানা দিক দেখতে হবে।