সাহিত্য ।। স্মৃতির আলোকে।। বাবা – পিয়ালী গাঙ্গুলি

জানো বাবা, সেদিন এস,আর,এ- তে গিয়েছিলাম। তোমার ঘরের সামনে গিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ । বেশ কিছু পরিবর্তন দেখলাম জানো। নতুন করে রঙ করা হয়েছে তোমার বাড়ি। ঘরের সামনের উঠোনটা খালি, যেন খাঁ খাঁ করছে। তোমার হুইল চেয়ার আর ক্যাম্পখাটটা নেই, জানো বাবা। ওই খাটিয়াটাতে বিকেলবেলা তামাক নিতে নিতে কতরকমের গল্প শোনাতে, কখনও আবার বন্দীশও শিখিয়েছ আমাদের। বাগানটায় পাতা-বাহার গুলো সংখ্যায় বেশ কিছু বেড়েছে। বড় গাছগুলো কিরকম যেন থমকে রয়েছে। উঠোনের বাঁ পাশে একটা ট্যাপ-ওয়াটার কল ছিল না? যেটার মাথাটা ভাঙা ছিলো, সেটা আর ভাঙা নেই জানো, নতুন করে লাগানো হয়েছে। ডানপাশের মাঠটা, যার সবুজ কার্পেটে খালি পায়ে হাঁটতাম, দেখলে কষ্ট হবে জানো, বিবর্ণ আগাছায় ভরে গেছে। পাঁচিলের ধারের কিছু গাছ কেটে মাঠটাতেই ফেলে রাখা আছে। তবে আমগাছটা একইরকম আছে, যেটাতে বিলাল-মুন্নি ঢিল মেরে মেরে কাঁচা আমগুলোকে পারতো। মুন্নিটা চলে গেলো বাবা, আচ্ছা, ও কি তোমার কাছে গেছে? সবথেকে বেশি ভালো যে, তুমিই ওকে বাসতে। সামনের ঘরের খোলা জানলাটা দিয়ে আলগা তাকালাম ভিতরে, কাউকে দেখতে পেলাম না, পরে শুনলাম ওখানে এখন স্কলার-রা থাকে। একটু সুর চাইছিলাম বাবা জানো, কিন্তু, কোথা থেকেও একটা সুর এলো না কানে।

হঠাৎই একটু একটু বৃষ্টি নামলো, সকাল থেকেই সেদিন মেঘলা ছিলো, তাই মনটাও খারাপ ছিলো। তূমি তো জানতে বলো বাবা? মেঘলা-দিনে বৃষ্টি না হলে আমিও আকাশটার মতোই গুমোট হয়ে থাকি। তুমি বলতে আমায়, ‘আশমানকে সাথ সাথ আশমানি হো যাতি হ্যায় তু’, মনে আছে তোমার বাবা?
যেদিনই বৃষ্টি পড়ে, সেদিন একটা বিশেষ ক্ষণ মনে পড়বেই আমার। তেরো বছর আগে, সেদিনও, বর্ষা ঝরছিলো, “মিয়া কি মলহার” শেখাচ্ছিলে আমায়। কিছুতেই “অতি-কোমল-গান্ধার’-টা লাগাতে পারছিলাম না। তুমি অনেক চেষ্টা করলে, নানাভাবে দেখালে, তবুও গান্ধারটা লাগলো না আমার ঠিকঠাক। বেশ কিছুক্ষণ পর, তুমি ভীষণ রেগে গিয়ে, সামনে রাখা তোমার খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে। আগুন-চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘আজ, তু জরুর মেরে বারে মে কুছ বুড়া সোচে হ্যায়, ইসি লিয়ে তেরেকো নেহি হো রহে হ্যায়, ফেক দে তাম্বুরা’ ।

প্রবল ভূমিকম্প হলেও বোধহয়, এতটা নড়িয়ে দিতো না আমায়। ঘরেতে তখন যেন বাজ পড়েছে, সবাই কি এক সাংঘাতিক নিস্তব্ধতায়।কথাটা শুনে, প্রথমে কিরকম একটা স্ট্যাচু হয়ে গেলাম, কিছুক্ষণ পর, ভিতর থেকে দলা-পাকানো কান্নাটা এলো। তুমি আমায় কাঁদতে দিলে। তারপর, তোমার সেই মৃদু হাসিটা হেসে কাছে ডেকে আদর করলে জড়িয়ে, তাতে আমার বাঁধ যেন ভেঙে গেলো আরও। একটু পরে বললে, ‘তাম্বুরা উঠা’। তানপুরাটা তুলে নিলাম। কি অদ্ভুতভাবে লাগলো এবার গলায়, ‘অতি-কোমল-গান্ধার’।

সুর চেয়ে পেলাম না, কিন্তু, সেইদিনকার স্মৃতির সুরেতেই জাগিয়ে দিলে তুমি আমায় আবার।
মিরাকল্ শব্দটা শুনতাম, সেদিন বুঝলাম, ভিতর থেকে কিভাবে শিল্পকে টেনে বের করতে হয়, তা তুমি জানতে,,,,,,,,,,

পিয়ালী গাঙ্গুলি

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

এ কে সরকার শাওনের কবিতা – “প্রমি-শান্ত’র পথচলা”

বাবা-মা'র স্বপ্ন, স্বজনের রত্ন,স্বর্গীয় অনন্য উপহার!ভাইয়ের আদরের বোনের স্নেহেরপ্রমি সবার অহংকার! ক'দিন আগের ফুটফুটে শিশুআজ…

16 hours ago

বেপরোয়া গতির বলি, দায় কার?

প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে শহরজুড়ে যে শব্দটা প্রায়ই আমাদের কানে বাজে, তা হলো “দুর্ঘটনা”। চারপাশে যখনই…

3 days ago

বাচ্চাদের ডাব খাওয়া – সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস

বাচ্চাদের ডাব খাওয়া: স্বাস্থ্য ও সতেজতার প্রাকৃতিক উপায় বাংলার গ্রীষ্ম মানেই রোদের তেজ, ঘাম আর…

4 days ago

রিঙ্কু সিং: মাঠের কোণ থেকে তারকার যাত্রা

২০১৮ সালে কেকেআর দলে যখন রিঙ্কু সিং যোগ দিলেন, তাঁর জন্য ৮০ লক্ষ টাকা খরচ…

1 week ago

তাৎক্ষণিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস

পশ্চিম বাংলার একাধিক জেলায় ঝড়-বৃষ্টি আসন্ন 📍 কলকাতা, ১৭ মার্চ: পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়ায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।…

4 weeks ago

স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী

আজ, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, আমরা উদযাপন করছি স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনটি কেবল তাঁর…

3 months ago