জানো বাবা, সেদিন এস,আর,এ- তে গিয়েছিলাম। তোমার ঘরের সামনে গিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ । বেশ কিছু পরিবর্তন দেখলাম জানো। নতুন করে রঙ করা হয়েছে তোমার বাড়ি। ঘরের সামনের উঠোনটা খালি, যেন খাঁ খাঁ করছে। তোমার হুইল চেয়ার আর ক্যাম্পখাটটা নেই, জানো বাবা। ওই খাটিয়াটাতে বিকেলবেলা তামাক নিতে নিতে কতরকমের গল্প শোনাতে, কখনও আবার বন্দীশও শিখিয়েছ আমাদের। বাগানটায় পাতা-বাহার গুলো সংখ্যায় বেশ কিছু বেড়েছে। বড় গাছগুলো কিরকম যেন থমকে রয়েছে। উঠোনের বাঁ পাশে একটা ট্যাপ-ওয়াটার কল ছিল না? যেটার মাথাটা ভাঙা ছিলো, সেটা আর ভাঙা নেই জানো, নতুন করে লাগানো হয়েছে। ডানপাশের মাঠটা, যার সবুজ কার্পেটে খালি পায়ে হাঁটতাম, দেখলে কষ্ট হবে জানো, বিবর্ণ আগাছায় ভরে গেছে। পাঁচিলের ধারের কিছু গাছ কেটে মাঠটাতেই ফেলে রাখা আছে। তবে আমগাছটা একইরকম আছে, যেটাতে বিলাল-মুন্নি ঢিল মেরে মেরে কাঁচা আমগুলোকে পারতো। মুন্নিটা চলে গেলো বাবা, আচ্ছা, ও কি তোমার কাছে গেছে? সবথেকে বেশি ভালো যে, তুমিই ওকে বাসতে। সামনের ঘরের খোলা জানলাটা দিয়ে আলগা তাকালাম ভিতরে, কাউকে দেখতে পেলাম না, পরে শুনলাম ওখানে এখন স্কলার-রা থাকে। একটু সুর চাইছিলাম বাবা জানো, কিন্তু, কোথা থেকেও একটা সুর এলো না কানে।
হঠাৎই একটু একটু বৃষ্টি নামলো, সকাল থেকেই সেদিন মেঘলা ছিলো, তাই মনটাও খারাপ ছিলো। তূমি তো জানতে বলো বাবা? মেঘলা-দিনে বৃষ্টি না হলে আমিও আকাশটার মতোই গুমোট হয়ে থাকি। তুমি বলতে আমায়, ‘আশমানকে সাথ সাথ আশমানি হো যাতি হ্যায় তু’, মনে আছে তোমার বাবা?
যেদিনই বৃষ্টি পড়ে, সেদিন একটা বিশেষ ক্ষণ মনে পড়বেই আমার। তেরো বছর আগে, সেদিনও, বর্ষা ঝরছিলো, “মিয়া কি মলহার” শেখাচ্ছিলে আমায়। কিছুতেই “অতি-কোমল-গান্ধার’-টা লাগাতে পারছিলাম না। তুমি অনেক চেষ্টা করলে, নানাভাবে দেখালে, তবুও গান্ধারটা লাগলো না আমার ঠিকঠাক। বেশ কিছুক্ষণ পর, তুমি ভীষণ রেগে গিয়ে, সামনে রাখা তোমার খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে। আগুন-চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘আজ, তু জরুর মেরে বারে মে কুছ বুড়া সোচে হ্যায়, ইসি লিয়ে তেরেকো নেহি হো রহে হ্যায়, ফেক দে তাম্বুরা’ ।
প্রবল ভূমিকম্প হলেও বোধহয়, এতটা নড়িয়ে দিতো না আমায়। ঘরেতে তখন যেন বাজ পড়েছে, সবাই কি এক সাংঘাতিক নিস্তব্ধতায়।কথাটা শুনে, প্রথমে কিরকম একটা স্ট্যাচু হয়ে গেলাম, কিছুক্ষণ পর, ভিতর থেকে দলা-পাকানো কান্নাটা এলো। তুমি আমায় কাঁদতে দিলে। তারপর, তোমার সেই মৃদু হাসিটা হেসে কাছে ডেকে আদর করলে জড়িয়ে, তাতে আমার বাঁধ যেন ভেঙে গেলো আরও। একটু পরে বললে, ‘তাম্বুরা উঠা’। তানপুরাটা তুলে নিলাম। কি অদ্ভুতভাবে লাগলো এবার গলায়, ‘অতি-কোমল-গান্ধার’।
সুর চেয়ে পেলাম না, কিন্তু, সেইদিনকার স্মৃতির সুরেতেই জাগিয়ে দিলে তুমি আমায় আবার।
মিরাকল্ শব্দটা শুনতাম, সেদিন বুঝলাম, ভিতর থেকে কিভাবে শিল্পকে টেনে বের করতে হয়, তা তুমি জানতে,,,,,,,,,,
পিয়ালী গাঙ্গুলি