মিজান রহমান, ঢাকা: চারিদিকে মানুষের ঢল। সবগুলো গেটে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন। শিশু–কিশোর, তরুণ–যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সি নারী–পুরুষ ছুটছে প্রাণের মেলার দিকে। লোক সমাগম সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে স্টলের বিক্রয়কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। গত পাঁচ দিনের দর্শনার্থী খরা কাটিয়ে ৮ ফেব্রæয়ারি শনিবার দুপুরের পর থেকে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সকাল ১১টায় খুলে দেয়া হয় মেলার দ্বার। তখন তেমন লোক–সমাগম না হলেও অনেকেই প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় ঘুরেছেন। কিনে দিয়েছেন পছন্দের বই। বইমেলা শুরু হওয়ার প্রথম ছুটির দিন আর বাণিজ্য মেলা শেষ হওয়ায় গত শুক্রবার লোক–সমাগম বেড়েছে বলে মনে করছেন প্রকাশকরা। আশানুরূপ বিক্রি হওয়ায় খুশি তারা। তাদের ভাষ্য ৮ ফেব্রুয়ারি শনিবারও লোক–সমাগম ভালো হবে। দিন দিন লোক–সমাগম বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের বিক্রিও বাড়ার প্রত্যাশা করছেন প্রকাশক–লেখকরা। উৎস প্রকাশনের প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বলেন, বাণিজ্যমেলার কারণে প্রথম কয়েকদিন মেলায় উপস্থিতি ছিল কম। তাই বেচাকেনাও কম ছিল। তবে ছুটির দিন সকাল থেকেই অনেক লোক মেলায় এসেছে।
প্রচুর বই বিক্রি হয়েছে। আমরা এমন দিনের অপেক্ষাতেই থাকি। আশা করছি মেলার বাকিটা সময়জুড়ে পাঠকের এমন স্রোত অব্যাহত থাকবে। অন্যদিন বিকাল ৩টা থেকে মেলা শুরু হলেও শুক্রবার ছুটির দিনে তা শুরু হয় সকাল ১১টায়। মূলত শিশু প্রহরের কল্যাণে শুক্র–শনি আগেভাগেই মেলার দ্বার খোলে। সকাল থেকেই ছিল লোক–সমাগম। তবে তা জমে ওঠে পশ্চিমে সূর্য হেলে পড়ার পর। বিকাল ৪টার আগেই পুরো মেলাপ্রাঙ্গণ জুড়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। শাহবাগ এবং দোয়েল চত্বর– দু‘পাশ থেকেই সারিবদ্ধভাবে বইপ্রেমীরা মেলায় প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো সড়কও মানুষের ভিড়েউপচে পড়তে থাকে। সকলেরই গন্তব্য একটিই। আর তা হলো প্রাণের গ্রন্থমেলা। সন্ধ্যা নাগাদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমিতে মানুষের এতটাই ভিড় ছিল যে সেখানে হাঁটাচলা করাটাই দায় হয়ে পড়ে। নিজের বইয়ের প্রচার ও প্রসার বাড়াতে এসেছেন বইয়ের অনেক লেখকও। নিজ বইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠকের সঙ্গে কথা বলেন, অটোগ্রাফ আর ছবি তুলেন নন্দিত লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, ড. মুহিত কামালসহ অনেকে। শিশু প্রহরে উচ্ছ্বাস : লাল টুকটুকে জামা পরে আম্মুর হাত ধরে হাটি হাটি পা পা করে বইমেলা এসেছে ফয়সাল আর রুপা। তাদের একজনের বয়স তিন বছর, আরেকজনের পাঁচ। তবে দু‘জনের হাতেই যখন বই উঠেছে, তখন তারা বেশ বিজ্ঞজন! অক্ষর না চিনলেও বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে তবেই পড়া! আর ছবি তুলতে চাইলে তো লজ্জারাঙা খুনসুটিতে তাকানো একজন আরেকজনের দিকে। সকাল থেকে সচেতন অভিভাবকদের সঙ্গেই ছোট ছোট শিশুদের হাসি, উলস্নাস, দৌড়াদৌড়ি, খুনসুটি, মান–অভিমান, বড়দের সঙ্গে আঁড়ি, ঝগড়া, কান্না, লাফালাফি আর আবদারের মধ্য দিয়ে জমে উঠে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ৬ষ্ঠ দিন ও প্রথম শিশুপ্রহর।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই গ্রন্থমেলার মাঠে নতুন বই আর প্রিয় চরিত্র ‘হালুম–ইকরি–শিকু–টুকটুকি‘কে দেখার জন্য শিশুরা অপেক্ষা করছিল বাবা–মায়ের হাত ধরে। এক একটি স্টলে ঢুকে রঙবেরঙের বই নেড়ে চেড়ে দেখছে তারা। কিনে নিচ্ছে পছন্দের বইটি। অক্ষর চেনে না, বই কি বোঝে না– এমন শিশুদেরও বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাদের বই মেলায় নিয়ে আসতে ভুল করেননি অনেক অভিভাবক। বলা যায়, হাজারো বইয়ের সঙ্গে নিজের সন্তানকে পরিচয় করিয়ে দিতে শিশু প্রহরের সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন সচেতন অভিভাবকরা। বাচ্চাদের নিয়ে মেলায় এসেছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সহকারী পরিচালক মো. তারেক খান। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন আমরা গ্রামে উঠানে বসে সকলে একসঙ্গে বই পড়তাম। এখন কিন্তু সেটি নেই। বরং এখন সবাই একসঙ্গে বসে মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। এতে করে আমাদের সন্তানের বিকাশটা বাধাগ্রস্থ হয়, একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই আটকে থাকে। বই ঠিক তার উল্টো। বই চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে শিশুসহ আমাদেরও আরও বেশি মননশীল করে তোলে, একজন ভালো মানুষ হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বই।‘ শিশু চত্বরে কথা হয় বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক ও শিশু সাহিত্যিক আনজীর লিটনের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিশুদের আনাগোনা বইমেলায় অন্যরকম একটা আবহ তৈরি করেছে। শিশুরা যেভাবে এই মেলায় অংশ নিচ্ছে, সেটি আমাদের জন্য একটি প্রেরণার অংশ। তবে শুধু অংশগ্রহণ নয়, শিশুদের অবশ্যই বই পড়তে হবে। শিশুরা নিজে হয়তো তার জন্য সঠিক বইটি চিনে নিতে পারবে না, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অনেক সচেতন হতে হবে যে কোন বই শিশুর হাতে দেয়া হবে। আমাদের যে কালজয়ী সাহিত্যগুলো আছে, পুরনো দিনের যে লেখাগুলো আছে, সেগুলো তো অবশ্যই পড়বে, পাশাপাশি শিশুদের সমকালীন লেখাগুলোও পড়তে হবে। কারণ লেখার মধ্যে সমকালীন চিত্র ফুটে ওঠে। শিশু–কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা: সকাল সাড়ে ৮টায় অমর একুশে উদ্যাপনের অংশ হিসেবে শিশু–কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী।
শিশু–কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা সস্ত্রীক পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ক–শাখায় ২৭০, খ–শাখায় ২১৫ এবং গ–শাখায় ৯০ জন; সর্বমোট ৫৭৫ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। আগামী ২২শে ফেব্রম্নয়ারি ২০২০ প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার মেলায় বই এসেছে ৩০৮টি। এর মধ্যে প্রথমা এনেছে আনিসুল হকের উপন্যাস ‘এখানে থেমো না‘, অনন্য এনেছে মোস্তফা কামালের ‘স্বপ্নবাজ‘, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে এসেছে অংশুমানের উপন্যাস ‘জলে ডোবা প্রাণ‘, একই প্রকাশনা থেকে ড. মো. নাছিম আখতার ‘স্বপ্ন ও সাফল্যের রসায়ন‘, জার্নিম্যান বুকস থেকে এসেছে সুইডিশ লেখক মনিকা ছাকের গল্পগ্রন্থ ‘অ্যাসিড ছোড়ার আগের ও পরের গল্প‘ এবং তোফায়েল আহমেদের ‘রক্তঝরা মার্চ ১৯৭১: অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা‘, কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে আবুল কাশেমের ইতিহাস গ্রন্থ ‘মুক্তির পরম্পরা‘, সনৎ কুমার সাহার ‘ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে‘ ও সৈয়দ আজিজুল হকের সমালোচনা গ্রন্থ ‘কথাশিল্পী মানিক‘, পাঞ্জেরী থেকে এসেছে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘উপন্যাস ত্রয়ী‘, অন্যপ্রকাশ থেকে নওশাদ জামিলের কবিতার বই ‘প্রার্থনার মতো একা‘। মূল মঞ্চের আয়োজন : বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সৈয়দ শামসুল হক রচিত বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা এবং এর অনুবাদ ‘ইধষষধফ ড়ভ ড়ঁৎ ঐবৎড় : ইধহমধনধহফয্থঁ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন খায়রুল আলম সবুজ এবং আনিসুল হক। অনুবাদকের বক্তব্য প্রদান করেন অনুবাদ–গ্রন্থের প্রণেতা ড. ফকরুল আলম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমরান কবির চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক। তিনি যখন শিশুদের উপযোগী করে বঙ্গবন্ধুর জীবনী লেখেন তখন তা একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা এই কারণে একটি বড় ঘটনা। শিশুদের জন্য এ রকম জীবনীগ্রন্থ বাংলা ভাষায় বিরল। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র জীবন শিশুদের উপযোগী করে লেখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ভাষার দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, ঘটনা, বর্ণনার দিকে অতিরিক্ত মনোযোগী হতে হয় এবং জীবনকথা তুলে ধরতে হয় এমন একটি আকর্ষণীয় ভঙ্গিমায় যাতে শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বইটি পড়ে। সৈয়দ হক এই কাজটি করেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবনকথা শিশুদের কাছে অতি মনোরম ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন বাংলা ভাষার এই বড় লেখক। আলোচকবৃন্দ বলেন, বাঙালির হাজার বছরের কোনো এক পুণ্য–বলেই বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালির ঘরে। হতদরিদ্র, নিপীড়িত এক মানবগোষ্ঠীকে একটি জাতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কঠিন কাজটি সম্পন্ন করেছেন বাংলার বীরসন্তান বঙ্গবন্ধু। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা নিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের রচিত বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা গ্রন্থের মাধ্যমেই শিশু–কিশোররা বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে চিনতে শুরু করবে এবং তাঁর মতো আত্মবিসর্জন ও ত্যাগের মহিমায় দেশের প্রয়োজনে নিজেদের নিবেদিত রাখবে। গ্রন্থের অনুবাদক বলেন, বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনকথা অতি আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে শিশু–কিশোর পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন আমাদের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। এই অসাধারণ গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে পারা আমার জন্য পরম গৌরব ও আনন্দের। সভাপতির বক্তব্যে এমরান কবির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতা হঠাৎ করেই আবির্ভূত হন না।
দীর্ঘ সময়ের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসাই বঙ্গবন্ধুকে মহান নেতায় পরিণত করেছিল। কালজয়ী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা এবং ফকরুল আলম–কৃত ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে এদেশের শিশু–কিশোররা এই মহান নেতার জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে সম্যক অবগত হবে। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি হাসান হাফিজ, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, কবি নুরুন্নাহার শিরীন, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মাসকুর–এ–সাত্তার কলেস্নাল, আলোক বসু এবং কাজী বুশরা আহমেদ তিথি। নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যসংগঠন ‘বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস‘ (বাফা)-এর নৃত্যশিল্পীবৃন্দ। সংগীত পরিবেশন করেন আজগর আলীম, নারায়ণ চন্দ্র শীল, শান্তা সরকার, আল মনসুর। তথ্যসূত্র যাযা দিন।