অতনু দাস : ভারতীয় তথা হিন্দু সমাজে মাতৃ শক্তির আরাধনা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে,ঠিক তেমনি উড়িষ্যার ঘরে ঘরে প্রভু জগন্নাথ দেব পূজিত হলেও উড়িষ্যার অধিকাংশ ঘরে মাতৃশক্তির আরাধ্যা হিসাবে দেবী তারা তারানী পূজিত হন ।
এই তারা তারিণী দেবীর মন্দিরই ছিল আমাদের এবারের গন্তব্যস্থল।উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলার ঋষিকূল্য নদীতীরে (স্থানীয় অভিমতে ঋষিকূল্যকে গঙ্গার বড়দিদি হিসাবে অভিহিত করা হয়,উড়িষ্যার পবিত্র একটি নদী) কুমারী পর্বতে অবস্থিত মা তারা-তারিণীর মন্দির।এই মন্দিরটি সতী ৫১ পীঠের অন্যতম।কালিকা পুরাণ অনুযায়ী এই স্থানে দেবী স্তন যুগল পতিত হয়।দুটি স্তনরুপিবক্ষশীলা ,একটি তারা, অপরটি তারিণী নামে পূজিত হন (যমজ দেবতা)।এই মন্দিরটি কল্যাণীধাম নামেও পরিচত।এছাড়াও পুরান মতে আমাদের দেশে ৪টি তন্ত্রসাধনার পীঠ আছে তার মধ্যে এই তারা তারিণী মন্দিরটি একটি তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান। এখানে আজও বিভিন্ন তিথিতে তন্ত্রসাধনা করা হয়,এবং তন্ত্র সাধকদের সমাগম হয়।
স্থানীয় ইতিহাস দাবী করে এ মন্দির প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরোনো।এই মন্দিরের সঠিক নির্মাণকাল জানা না গেলোও কিন্তু এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে জনমানসে বিভিন্ন কাহানি প্রচলিত আছে…
স্থানীয় লোকমুখে এক কাহানি প্রচলিত আছে যে ,বাসু প্রহরাজ নামে এক ব্রাহ্মণ তার দুই যমজ বোন (তারা ও তারিণী)সাথে ঋষিকূল্য নদীর তীরে বসবাস করতো।হঠাৎ একদিন ওই দুই বোন এই তারা তারিণী পাহাড়ে এসে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বাসু প্রহরাজ বহু প্রচেষ্টার পরও তাদের খুঁজে পান নি।সেই রাতে দুই বোন প্রহরাজের স্বপ্নাদেশ দেন যে ওই পাহাড়ে আদি শক্তির মন্দির নির্মাণ করতে ও সেখানে নিত্য উপাসনা করতে।কথিত আছে তার পর এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়।
এই মন্দির সম্পর্কে আরো একটি জনশ্রুতি আছে।মৌর্য্য সম্রাট অশোক আর কলিঙ্গের রাজা অনন্তর সৈন্য বাহিনীর মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল তার প্রায় অন্তিমলগ্নে,ইতিহাসে বর্ণিত আছে ধৌলি পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা দয়া নদী রক্তগঙ্গাতে পরিণত হয়েছে,সেই লগ্নে,কলিঙ্গরাজ পরাজয় নিশ্চিত বুঝে গুপ্তচর মারফত খবর পাঠিয়ে দেন অন্তঃপুরে,এবং নির্দেশ দেন রানীদের রাজমহল পরিত্যাগের। রানী ও সমস্ত রমণীরা রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন ঋষিকূল্য নদীর ধারে পাহাড়ের উপর তারা তারানী মন্দিরের উদেশ্যে। এই বিপদে দেবীই ভরসা। অশোকের সৈন্যবাহিনীর একাংশ যারা কলিঙ্গ নগর লুঠপাট করছিলো,তাদের কাছে খবর পৌছালো রাজ্ রমনীদের পাহাড়ে আত্মগোপনের কথা। অত্যুৎসাহী সৈন্যদল পিছু নিলো রানীদের।ওদিকে রানী ও সমস্ত রমণীগণ আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরের গর্ভ গৃহে। অশোকের সৈন্যদল পৌছালো পাহাড়ের পাদদেশে।অশোকের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে তখন লালসা তীব্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাধ সাধলো ।চমৎকার হলো,অসুর বিনাশিনী দেবী তারা তারিনীর আবির্ভাব ঘটলো।পথ আটকে দাঁড়ালো ত্রিশূল হাতে এক দেবী। চোখ তাঁর জ্বলছে আগুনের মতো। অগ্নিগর্ভ তেজে এঁটে উঠতে পারলো না অশোকের সৈন্যরা। মন্দিরে ওঠার দুঃসাহস না দেখিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচালেন সৈন্যরা। ওদিকে কলিঙ্গ যুদ্ধ সমাপ্ত ,চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছেন রাজা অশোক। সম্রাট অশোকের কানে যখন এই দেবীর কাহিনী পৌঁছায় ততক্ষনে তাঁর বোধোদয় ঘটে গেছে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা ছেড়ে তাঁর মন তখন বুদ্ধের প্রেমের বাণীতে আকৃষ্ট হয়েছে। মন্দির পরিদর্শনে এলেন স্বয়ং সম্রাট।তিনি নবরূপে মন্দিরটিকে আবার পুনর্নির্মাণ করলেন ,হিন্দু দেবদেবীর পাশাপাশি স্থাপনা করলেন বৌদ্ধমূর্তির।তাই বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিকরা দাবি করেন এই মন্দিরের নির্ম্মাণ অশোকের সময়কালে।
এই মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা ৯৯৯ টি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে সরকারি প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা রোপওয়ের সাহায্যে অনায়াসেই যে কেউ পাহাড়ের তলদেশ হতে পাহাড়ের উপরে অধিষ্টিত মাতৃধামে পৌঁছে যায়(মাত্র ৫৯টাকা মাথা পিছু টিকিট )।
মন্দিরের স্থাপত্য আর মন্দিরের উপর হতে বয়ে চলা ঋষিকূল্য নদী, দেখতে দেখতে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। তবে সাবধান ! মন্দির চত্বরে অজস্র বানর সেনার উপস্থিতি। আপনার হাত থেকে প্রসাদের থালা, আপনার হাতের খাবার, কেড়ে নিয়ে চলে যাওয়াই এদের মূল লক্ষ্য।বেশ এইটুকুই বাঁদরামী!!
সুতরাং তারা তারিণী ধাম হলো মাতৃশক্তির পীঠস্থান ,তন্ত্রসাধনার আঁতুর ঘর,এখানে আছে মানুষের আস্থার গল্প।সুতরাং আপনারাও চলে আসতে পারেন এখানে।
+কিভাবে যাবেন?
নিকটতম রেলস্টেশন হলো ব্রহ্মপুর.. ওখান থেকে অটো বা চার চাকা ভাড়া করে চলে আসা যায় তারা তারিণী মন্দির. ব্রহ্মপুর থেকে তারা তারিণী মন্দিরের দূরত্ব ৪০ কিমি
+কোথায় থাকবেন?
থাকার জায়গা বলতে ব্রহ্মপুর রেল স্টেশনের কাছে ভালো মানের ও সস্তার হোটেল ভাড়া পেয়ে যাবেন.. এছাড়াও কেউ যদি চান গোপালপুর থেকে তারা তারিণী ঘুরে যাবেন সেটাও করা যায়.(দূরত্ব৬০ কিমি) এছাড়াও থাকতে চাইলে তপ্তপানী ও রম্ভা পান্থনিবাসে (সরকারি)থাকতে পারেন ………..