রূপসী দেউল:“গভীরে যাও আরো গভীরে যাও” হ্যাঁ আমি গভীরেই যেতে চাই, কারণ!
সবুজের সাথে আমার খেলা, আকাশের বুকে আমার ভাসা। এভাবেই কাটে আমার সকাল সন্ধ্যা বেলা। বোলপুর ডেরা থেকে গাড়ির ভেজা কাচের ভিতর থেকে আমার চেনা জানা শাল, পিয়াল,মহুল এর সাথে সোনাঝুরি, পলাশ দের দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম ইলামবাজার এর পথে। শ্রীনিকেতন, চৌপাহাড়ী,দোরান্দা পেরিয়ে ইলামবাজার এর পর অজয় নদের ব্রিজ টপকে ১১ মাইল থেকে ডানদিকে নেমে গেলাম। রামায়ন এর অযোধ্যা এটা নয়, এটা বর্ধমান এর অযোধ্যা। গাড়িতে আমরা সেই চারজন ভ্রমণ প্রিয় মানুষ। সঙ্গীরা কেউ জানে না আমি আজ কোন পথে উড়ে চলেছি। সবাই ভেবেছিল এমনি বর্ষা ভেজা এই ইলামবাজার জঙ্গল মানে দুর্গাপুর রেঞ্জের শিবপুর বিট এর খেওবাড়ি জঙ্গল দেখতে এসেছি। কাঁকসা থানার অধীন বনকাটি অঞ্চলের আদিবাসী মানুষের মহল এটা। গাড়িতে চলছিল ইন্দ্রনীল সেনের কণ্ঠে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর লেখা
” আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে”। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে বাবার সাথে প্রথম আসা হয়েছিল এই পথে। এখনো মনে আছে,কলকাতা থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে পানাগড়ে নেমে সেখান থেকে বাসে এই ১১ মাইল নামতাম। বাসের অনেক যাত্রী অবাক হয়ে দেখতো আমাদের। কারণ তখন এখানে একটাই মিষ্টির দোকান ছিল। আর কিছুই ছিলনা। দোকানের মালিকের নাম ছিল রামচন্দ্র। বাবার সাথে ব্যবসার কাজে এখানে প্রতি মাসেই আসতাম। তখন রাস্তা এতো সুখের ছিলোনা। সারা দিন এই রামবাবুর মিষ্টির দোকানে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগেই জঙ্গলের ভিতরে অযোধ্যা গ্রামে আশ্রয় নিতাম রামবাবুর মাটির বাড়িতে। রামবাবু আমাদের হয়ে এই অঞ্চলে আমাদের ব্যাবসার দায়িত্বে ছিলেন। লাল মোরাম এর উঁচুনিচু পথ, রিকশা করে যেতাম। তেমন বাড়ি ঘর ছিল না। আলো নেই, টিভি নেই। জঙ্গল এতই গভীর ছিল যে দিনের বেলায়ও কেউ একা জঙ্গলএ প্রবেশ করতো না। ভাল্লুক, হাতি, ছাড়াও বিষধর সাপ দের অবাধ ভূমি ছিল। আমরা যখনই বাবা মা এদের কথা বলি তখন কেমন জানি আবেগ তাড়িত হয়ে যাই। আজ খুব বাবার কথা মনে পরছে। পুরো পাল্টে গেছে এই অযোধ্যা গ্রাম। বড়ো বড়ো সব পাকা বাড়ি। লাইট পিচ রাস্তা মোরে মোরে পানিও জলের ব্যবস্থা। গ্রামে না এলে বাংলা তথা ভারতবর্ষের উন্নয়ন এর চেহারাটা দেখা যায়না। আমরা চলেছি ইছাই ঘোষের দেউল দেখতে। এই অযোধ্যা গ্রাম থেকে আরো ৫ কিলোমিটার জঙ্গলের ভিতর এর দেউল। এতো সুন্দর এই পথ যা লেখায় বর্ণনা হয় না। ঘন জঙ্গল উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তার মত প্রতিটা বাঁকে একেকটা করে নতুন আনন্দ। ছোটো ছোটো আদিবাসী গ্রাম, লাল মোরাম পথ।
চলেছি জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরতর দিকে, আর একে একে তার আদিম সৌন্দর্য উন্মোচিত হতে লাগলো। সাপ, বন বিড়াল, নাম না জানা কিছু ছোট বড় পাখি। এই জঙ্গলে হাতিও নাকি এসে পরে। আমাদের উত্তেজনার পারাও চড়তে লাগল। নিস্তব্ধ জঙ্গল, মাঝে মাঝে পাখির ডাক। পোকার ডাক এমন নানা ধরনের হয় জানতাম না। কত কি যে এখনও না জানার আছে প্রকৃতিতে, তা এখানে এসে আবার উপলব্ধি করলাম।
বর্ধমানের কাঁকসা থানার ভিতর গভীর জঙ্গলে ঘেরা অতীতের ‘ঢেকুর’ গ্রাম, বর্তমান নাম গৌরাঙ্গপুর। জনবসতি খুবই কম। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অজয় নদ ও-পারে কেন্দুলি, আর এ-পারে শাল- পিয়াল – অর্জুন-শিরীষ ও নানা বুনো গাছগাছালি নিয়ে ভরা গা ছমছমে এই জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝে রয়েছে প্রায় ১০০ ফিট উঁচু প্রসিদ্ধ এক বিশাল শিবমন্দির। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার নকশা। এই মন্দিরই ইছাই ঘোষের দেউল। অনেকে মনে করেন দেউলটি ১৬শ/১৭শ শতকের। তার চেয়ে প্রাচীন নয়। এই দেউল থেকে আরও ৪ কি মি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলে গেছে ইছাই ঘোষের আরাধ্যা দেবী শ্যামরূপার মন্দিরে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এ পথ। পথ ভুল করার আশঙ্কা পদে পদে। কারণ টুরিস্ট ছাড়া এই পথে আর বিশেষ কোনও মানুষজন যাতায়াত করে না। দেউল এর পাশেই অবস্থিত একটা সুন্দর রিসর্ট, সাথে বিনোদন পার্ক। থাকার ব্যবস্থা বেশ ভালই। এই দেউল এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রক্ষিত। বোলপুর হেকে ৫১ কি মি ই পথ। ঘোর বর্ষায় বা শীতের দুপুরে ঘুরে আসা যায়।