ওড়ান


শনিবার,২৮/১২/২০১৯
2260

ওড়ান
এসকেএইচ সৌরভ হালদার

বসে আছি হাওড়া নদীর পাড়ে ।পাশ দিয়ে যাচ্ছে লঞ্চ ,নৌকা ইত্যাদি যানবাহন। নদীর জলের ছল ছল শব্দ বয়ে আসছে। দক্ষিন দিক থেকে ঝড় বাতাস বয়ে আসছে। এই নদীর সুমধুর জলস্রোত এর শব্দের তাল নিয়ে আর প্রাকৃতিক বাতাসে বসে তৈরি করছে একটি গল্প। জানি না গল্পটা কত সুন্দর তবে গল্পটা রহস্যময় ও আনন্দময় ।

গল্পের প্রথমে বলেছিলাম আমি বসে আছি হাওড়া নদীর পাড়ে। আমার বসার উপস্থিতি দেখে আমার পাশে এসে বসলো রুপসার মাঝি মঞ্জিল সে আমাকে বলছে
-বাবু দেখেছেন, ঐ আমাদের গাঁ
-আমি ওখানে বাস করি।
আমি তখন বলে উঠলাম “দেখেছি”

আর আমি,
শাওন চৌধুরী । চৌধুরী বাবুর ছোট ছেলের ছেলে
হ্যাঁ আমি আপনাকে চিনি। চৌধুরী বাড়ির পরিবার কে কে না চেনে। আপনি বিদেশে শুনেছিলাম পড়ালেখা করতে গিয়েছিলেন।
-হ্যাঁ ওই আর কি!
তবে চৌধুরী বলে আমাদের অত বড় করে দেখার কিছু নাই ।আমি মনে করি সবাই সবার কাছে ভালোবাসার একটি পাত্র, যেখানে সকলে একসাথে ভালোবাসার অধিকার আছে।

হুম তবে কি আর সবাই বুঝবে আপনার মত
আমি মুখ্য সুখ্য মানুষ অত কিছু বুঝি না।

এইভাবে মঞ্জিল এর সাথে গল্প করতে করতে দেখলাম কাঁধে কলসি আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকা পায়ে আবার আলতা পড়া। নুপুরের ঝনঝনি শব্দের জন্য চোখটা একটু ওদিকে চলে গেল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম
মঞ্জিল কে হে রুপসী কন্যা?

মঞ্জিল বললো সে এক বিশাল বড় কাহিনী খুবই । বেচারী মেয়েটারই বা কি দোষ। সে এখন এক অভাগী মেয়ে।
-কেন মঞ্জিল কি হয়েছিল তার সাথে।
হয়েছিল যা তা বলা যায় না মুখে না উপলব্ধি করা যায় মনে ।খুবই দুঃখজনক। ছোট বাবু আপনি যখন শুনতে চাইছেন তাহলে শুনুন কি হয়েছিল?

কয়েক মাস আগের কথা,
এই মেয়ের নাম উড়িয়া। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা আরেকটি বিয়ে করে। এরপর তার সৎ মা তাকে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করে। ছোট একটি মেয়ে কতইবা কাজ করে পারে। কখনো না খাইয়ে রাখে আবার কখনো সারাদিন কাজ করে আবার খেতে দেয় না ।ওর বাবা মায়ের অত্যাচারে ওকে আর কিছু বলতে পারেনা। কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনা। মেয়েটি কখনো এ জীবনে শান্তি পেল না। হয়তো ওর ভাগ্যে লেখা ছিল এরকম। তার জন্য এইভাবে দুখিনী হতে হলো।

মঞ্জিল আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বললো।গ্রাম পঞ্চায়েতের ছেলে ,হ্যাঁ গো গ্রাম পঞ্চায়েতের ছেলে উড়িয়ার সাথে ভাব ছিল।

কিন্তু ছেলেটি ভালো ছিল তার কথা সুমধুর, কালো কালো দুটি চোখের মনি যেন দেখতে রাজপুত্তুর হ্যাঁ গো রাজপুত্তুর।
ছেলেটি নাম ছিল ওড়ান। তাদের ভালোবাসার একটা কাহিনী, হয়তো এই ঘটনা সবাই জানে আপনি বিদেশে থাকার কারণে হয়তো আপনার জানা হয়নি তবে শুনুন কি হলো

ওহ , আরেকটি কথা বলা হয়নি ছেলেটি ছিল মুসলিম আপনি তো জানেনই, আর মেয়েটি হিন্দু। কিন্তু ওদের কাছে এই ধর্ম টা বড় ছিল না। আসল ধর্ম ছিল ভালোবাসা। যা দিয়ে এই পৃথিবীটাকে বদলানো যায়। যার জন্য হতে হয় মানুষকে অপমানিত আবার কখনো মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। শুধু একটু ভালোবাসার জন্য।

-তারপর !তারপর কি হল মঞ্জিল?
তারপর ছেলেটি আর মেয়েটি ওই মন্দির আছে না ।বড় মন্দির, মন্দিরের পিছনে যে বটগাছ ।বট গাছের পিছনে লুকিয়ে প্রেম করতো, ভালোবাসা করত।

তবে একদিন দেখে ফেলল পঞ্চায়েতের একটি ছেলে।এইদেকে গোপনে খবর দিল পঞ্চায়েত কে ।আর পঞ্চায়েত গ্রামবাসী এবং লোকজন নিয়ে চলে এলো।

হাজির হলো ওই বটগাছের পিছনে। তারপর মেয়েটিকে বিভিন্নভাবে অপবাদ দিল আর ছেলেটির কোন দোষ না দিয়েই বাড়ি ফিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্থান করলো। এমন সময় ছেলেটি বলে উঠলো আব্বা,
– ওর কোন দোষ না। আমি ওকে ভালোবেসেছি আমি ওর জন্য মরতেও পারি ।ভালোবাসায় কি দোষ আব্বা?
আমি কোন চুরি করে নি, ডাকাতি করিনি। না কারোর নামে কলঙ্ক করেছি ।শুধু একটুইনা ভালোবেসেছি ,এটাই কি আমার দোষ।
পঞ্চায়েত বলে উঠল
-তুই চুপ কর ।
ভালোবাসারে তুই কি বুঝবি ?
ছোট মানুষ এই বয়সে এরকম হয় ।
তবে এতদূর!
আমি আগেই বুঝতে পারিনি আর ওত হিন্দু। এর জন্য কি আমাদের বংশের মান সম্মান হানি করব ।এটা হতে পারে না ।
-অসম্ভব!

ওড়ান চিৎকার করে বলে উঠলো আব্বা, কোন ধর্মে লেখা আছে যে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মকে ভালবাসতে পারবে না ,কোন ধর্ম এ লেখা যে একজনকে ভালোবাসা একটি অপরাধ।
ধর্ম! ধর্ম !ধর্ম
এই ধর্ম মানুষকে বেঁধে রেখেছে একটি সীমাহীন গণ্ডির ভেতর। কিন্তু কজনই বা মেনে চলছে ধর্মকে। ধর্ম যদি মেনে চলতো তাহলে, এই পৃথিবীতে খুন, হয়রানি,ভালো – মানুষ খারাপ মানুষ থাকত না। শুধু ভালোবাসা দিয়েই মানুষকে ধর্মের পথে আনতে পারে ।একজন খারাপ মানুষ ভালো হতে পারে ,শুধু ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। আর এর জন্যই আমি যদি দোষী হয়ে থাকি তাহলে আমি অগ্নিস্নান করব।
চুপ কর! চুপ কর!
এখানে কোন বাংলা সিনেমার আমি ডায়লগ শুনতে আসিনি ।তুই যদি এতই বুঝিস তাহলে ভালোবেসেই পৃথিবীটাকেই কি বলতে যেতে পারিস।
আব্বা………
চুপ ! একদম চুপ!
তোর মুখ থেকে আরেকটি কথা শুনতে চাচ্ছি না।

হারাধন তোমার মেয়ে লজ্জা হওয়া উচিত। এই সমাজের কলঙ্ক ।ওকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হোক ।ও একটা সমাজের কীট, বিষাক্ত কীট ।
গায়ে লাগলে যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
উড়িয়া চোখে জল থামছিল না যেন ওর প্রতিটা রক্তবিন্দু একটু, একটু করে জলছিল অগ্নিদাহের মত।

সমাজপতি, পঞ্চায়েত ,গ্রামবাসী এরা আর ভালোবাসার কি বুঝবে, এরা তো শুধু দোষারোপ করেই চলছিল ,ওই ছেলে মেয়েদের উপর ।আমি দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ কিন্তু মানুষের মানবতা ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারি। সামান্য গরিব মানুষ বলে কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি। এই বোঝাটা যেন আমাকে খুবই কষ্টদায়ক করে ,ছোট বাবু খুবই কষ্টদায়ক করে ওঠে মনের ভেতর।

এরপর ছেলেটিকে পঞ্চায়েত নিয়ে গেল ।আর মেয়েটিকে তো টানতে টানতে নিয়ে গেল ওর সৎ মা ।আর চিৎকার করে বলতে লাগল তোর জন্যই গ্রামের লোকেদের কাছে ছোট হতে যাব কেন। তোর মার সাথে তুইও চলে যেতে পারলিনা।

এক, দুই,তিন এইভাবে পাঁচ ঘণ্টা পর পঞ্চায়েতের বাড়িতে চিৎকার-চেচামেচি শোনা গেল। একটা হট্টগোল হয়ে উঠলো পরিবেশটা।
আমি শুনতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম ওড়ান গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর চিৎকার করে বলছে ।মৃত্যুর আগেও চিৎকার করে বলছে
“উড়িয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি ”
“উড়িয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি ”
শুধু তোমাকে

এই দেখে তো মানুষ হতবাগ হয়ে গেল। গায়ে জল ঢালছে ওড়ানের। কিন্তু পোড়া মানুষ যার গায়ে আগুন নেভাতে না লাগে জলের ফোঁটা, তারপরেও ছিটিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে একটি কঙ্কাল শুয়ে পড়লো এই বধ্যভূমিতে। এই খবর পেয়ে উড়িয়া বাড়ি থেকে ছুটতে ছুটতে এলো, কিন্তু তার পরেও তাকে আসতে দেওয়া হলো না ওড়ানের কাছে। ছুঁতে দেওয়া হলো না। দূর থেকে সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

সেই রক্ত মাখা লাল আলতা পায়ে ছুটে যাওয়া ঘাসের উপর দিয়ে কয়েক বার মরতে গিয়েছিল উড়িয়া কিন্তু মরতে মরতেও আবার বেঁচে উঠলো এই দুনিয়ার মাঝে। এখন এই অভাগী রক্তমাংসের সারাক্ষণ পুড়ে থাকা একটি মানুষ।
সত্যি মঞ্জিল মানুষ শব্দটা কিভাবে একজন মানুষকে দেওয়া যায় জানিনা ।তবে যদি দুই ভাগ করা যেত পৃথিবীটাকে ,তবে ওরা হয়তো অমানুষের তালিকায় পড়তো। এদের মধ্যে থাকলে জীবনটা কখন‌ সুখ অতিক্রম করতে পারে না কোথাও যেন বাঁধা পড়ে। কিন্তু জ্বলজ্বল করা অগ্নি যেমন কখনো থামে না ঠিক তেমনি ঝরনা থেকে ঝরে পড়া জল কখনো থামে না এই ভাবেই ভালোবাসার শুরু এবং শেষ হয়।আর যারা ভালবাসা দিয়ে পৃথিবীটাকে বদলাতে চেয়েছি তাদেরই এভাবে মৃত্যু হয় এটাই বাস্তবতা। খুবই দুঃখজনক ওড়ানের ভালোবাসা।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট