ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা: দেশে এখন ঝড়, বন্যা, ভূমিধস, খরা, নদীভাঙনসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এসব দুর্যোগের কারণে ভিটেমাটি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত জীবন গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ইন্টারনাল ডিসপ্লেস মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ১২ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার বাংলাদেশী। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রভাব বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। ঘন ঘন দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে জেলাগুলো। সংকটকে আরো ঘনীভূত করছে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। পানির লবণাক্ততাও একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলের অনেক এলাকাই এখন এ সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা বা অতিবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে মানুষের জীবিকা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠার ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত।
এক পর্যায়ে জীবন ধারণের তাগিদে বাধ্য হয়েই নিজ পেশা ও ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে। এদেরই একজন সন্দ্বীপের বাসিন্দা মো. হানিফ (৩৭)। দুই বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে বাস করছেন তিনি। এক সময়ের কৃষক মো. হানিফ এখন পেশায় একজন গাড়িচালক। এছাড়া বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঠিকা গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করছেন তার স্ত্রী। ভিটেমাটি ফেলে ঢাকায় চলে আসার কারণ জানতে চাইলে মো. হানিফ বণিক বার্তাকে জানান, আগে কৃষিকাজের সময়ে প্রতি বছরই ঝড়-বাদলসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হতো। ফলে সেখান থেকে আয় খুব একটা থাকত না। এরপর মালটানা গাড়ি চালানো শুরু করি। সেখানে আয় মোটামুটি থাকলেও প্রতি বছরই এর একটা অংশ চলে যেত ঘরবাড়ি মেরামতে। শেষ পর্যন্ত জীবনের তাগিদেই ঢাকায় চলে আসি।
আইডিএমসির তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে বাংলাদেশে ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট বা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার মানুষের সংখ্যা ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে। এ সময়কালে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা ১৭ লাখ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবের কথা। অন্যদিকে এই এক যুগে সবচেয়ে কম মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০০৮ সালে। সে সময় বাস্তুচ্যুত হয়েছিল ৬১ হাজার মানুষ। এরপর ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৪২ হাজারে। ২০১০ সালে ৫ লাখ ৬৯ হাজার, ২০১১ সালে ৪ লাখ ও ২০১২ সালে ৬ লাখ ৫১ হাজার বাংলাদেশী নিজ ভিটেমাটি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়। এরপর ২০১৩ সালে ১১ লাখ ৬০ হাজার, ২০১৪ সালে ৫ লাখ ৪৩ হাজার, ২০১৫ সালে ৫ লাখ ৩১ হাজার ও ২০১৬ সালে ৬ লাখ ১৪ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোরা। ওই বছর বাস্তুচ্যুত হয় ৯ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ। ২০১৮ সালে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা নেমে আসে ৭৮ হাজারে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ একটি উদাহরণ ঘূর্ণিঝড় আইলা। ২০০৯ সালের ২৫ মে সংঘটিত এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে গৃহহীন হয়ে পড়ে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকার বহু পরিবার। প্রাণহানি ঘটে ৭৩ জনের। আইলার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পুনর্বাসিত হতে পারেনি অনেক গৃহহীন পরিবার। এর মধ্যে অনেক পরিবারই এখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাসমান জীবনযাপন করছে। আইলা দুর্গত এলাকাগুলোর একটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবুল কাসেম জানান, আইলার ছোবলে তার ইউনিয়নের পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সরকারি বা বেসরকারি সহায়তায় এসব বাস্তুহারার একাংশকে পুনর্বাসিত করা গেলেও এখনো অনেক পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারেনি। এসব পরিবার এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান জীবনযাপন করছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আইলায় গৃহহীন হওয়ার পর পদ্মপুকুর ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামের লাভলু গাজী ও তার ভাই বাবলু গাজী এখন খাগড়াছড়িতে বসবাস করছেন। একই গ্রামের গোলাম মোস্তফা ঘরবাড়ি হারিয়ে পরিবার নিয়ে চলে গেছেন যশোরের ঝিকরগাছায়। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এসএম আতাউর রহমান বলেন, আইলার ছোবলে তার ইউনিয়নের বাস্তুচ্যুত প্রায় ৬০-৬৫টি পরিবারকে আজও পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরার সুন্দরবন-সংলগ্ন ইউনিয়ন গাবুরা আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
এখানকার চেয়ারম্যান জিএম মাকসুদুল আলম জানান, আইলায় তার ইউনিয়নের ৯০ শতাংশ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ৫০-৬০টিকে এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি। এসব গৃহহীন পরিবারের মধ্যে কয়েকটি এখন খুলনার গল্লামারীতে ছিন্নমূল জীবনযাপন করছে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশের মিশনপ্রধান গিওর্গি গিগাওরির ভাষ্য হলো, কোনো এলাকায় বন্যা হয়, পানি নেমে গেলে আবারো গিয়ে পুনর্র্নিমাণ করা যায়। কিন্তু যদি কেউ দেখে তার দরজায় সমুদ্র চলে এসেছে, তবে তাকে সেখান থেকে সরে যেতে হবে। এছাড়া নদীভাঙনের কারণে যে সরে গেছে, তার জমি তো নদীবক্ষেই চলে গেছে। ফলে যারা সরে গেছে, তাদের ফেরত যাওয়ার আর কোনো কারণ নেই। এ মানুষগুলো সেসব স্থানেই যায়, যেখানে তারা নিজেদের জন্য সবচেয়ে বেশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ পাবে বলে মনে করে। এ কারণে গ্রাম থেকে শহরে প্রচুর মানুষ চলে আসে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, প্রকৃতি তার পরিবেশে যেভাবে পরিবর্তন আনছে, তাতে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত এলাকা থেকে অন্যত্র সরে যাবে। আর এটি অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ইস্যু। শুধু সরকারের জন্য নয়, যে এলাকায় এ অভিবাসন হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের জন্যই এটি একটি বড় বিষয়।
সংকট নিরসনে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়া এবং সহনশীলতার ওপর জোর দেন আইওএমের বাংলাদেশ প্রধান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সহনশীল হতে হবে। সেই সঙ্গে এ অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় আমাদের টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সংশ্লিষ্ট গ্রাম বা এলাকার মানুষদের সচেতন করতে হবে। বাস্তুচ্যুতদেরও নতুন এলাকার মানুষদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সেখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে বাংলাদেশের এ নাজুক অবস্থানের কথা এর আগেও বিভিন্ন সংস্থার নানা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জার্মান ওয়াচ প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০১৬’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝড়, বন্যা, ভূমিধস ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছয় নম্বরে। সূত্র: বণিক বার্তা।