বাংলাদেশের ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্যে হানা: যুবলীগ নেতা মাহমুদ গ্রেফতার


শুক্রবার,২০/০৯/২০১৯
660

মিজান রহমান, ঢাকা: দল ও অঙ্গসংগঠনের ভেতর থাকা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত দেওয়ার পর রাজধানীতে অভিযান শুরু হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে প্রথমেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সাধারণ কর্মী থেকে এই খালেদ হয়ে উঠেছিলেন অপকর্মের গডফাদার। রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে আধিপত্য ছিল তাঁর। র‌্যাব তাঁর বাড়ি থেকে তিনটি অস্ত্র, গুলি ও ইয়াবা উদ্ধার করেছে। অস্ত্র তিনটির মধ্যে একটি অবৈধ, বাকি দুটি জব্দ করা হয়েছে লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করার কারণে। প্রায় একই সময় ফকিরাপুল এলাকায় খালেদের নিয়ন্ত্রিত ইয়ং মেন্স ক্লাবে চালানো ক্যাসিনোতে অভিযান চলে। সেখান থেকে ১৪২ জনকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জব্দ করা হয় মাদকদ্রব্য ও জুয়ায় ব্যবহৃত নগদ টাকা। র‌্যাব এরপর রাতে আরো তিনটি ক্লাব কাম ক্যাসিনোতে অভিযান চালায়।

এসব অভিযানের পর অপকর্মের সঙ্গে জড়িত যুবলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। জানা গেছে, যুবলীগের কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে গাঢাকা দিয়েছেন। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম গত রাত সাড়ে ১১টার দিকে জানান, ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে আটক ১৪২ জনের মধ্যে ৩১ জনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ১১১ জনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, যাদের আটক করা হয়েছে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের মদ পানের লাইসেন্স নেই। এখন পর্যন্ত সেখান থেকে জুয়া খেলায় ব্যবহার হওয়া ২০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে।  র্যাব-১-এর সদস্যরা রাত ৯টার দিকে বনানীর আহম্মেদ টাওয়ারে থাকা ‘গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ’ নামের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায়। ক্যাসিনোটি বন্ধ পাওয়া যায়। র্যাব সেখান থেকে জুয়া খেলার সরঞ্জাম জব্দ করে ক্যাসিনোটি সিলগালা করে দেয়। র্যাব-৩ রাতে রাজধানীর ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে ১০ লাখ ২৭ হাজার ২০০ টাকা ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম জব্দ করে এবং এটিও সিলগালা করে দেয়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্যাসিনো থেকে লোকজন পালিয়ে যায়। এখানে ২০ হাজার ৫০০ জাল টাকাও পাওয়া যায়।

রাতে গুলিস্তান এলাকার পীর ইয়েমেনি মার্কেটের পাশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের অবৈধ ক্যাসিনোতেও অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে ৪০ জনকে আটক করা হয়। পরে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এখান থেকে মাদক, নগদ অর্থ, কষ্টিপাথরের মূর্তি ও ক্যাসিনোসামগ্রী জব্দ করা হয়। জানা গেছে, রাজধানীর ৬০টি স্পটে অবৈধ ক্যাসিনো (জুয়ার আসর) ব্যবসা চলছে। এই জুয়ার আড্ডাগুলো সম্পর্কে সম্প্রতি প্রমাণসহ গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেওয়া হয়। এসব জেনে চরম ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকায় যুবলীগ নেতারা অবৈধভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নেওয়া হয়েছে। যুবলীগের সবার আমলনামা আমার কাছে রয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে। আমি জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।

এর আগে গত শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ‘মনস্টার’ উল্লেখ করে তাঁদের পদ থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সভায় যুবলীগের কিছু নেতার কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ও মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগের একশ্রেণির নেতা ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব জুয়ার আসরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও মাঝেমধ্যে অংশ নেন। ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের আনা হয়। ক্যাসিনোগুলোতে প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকার খেলা হয়। অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে গতরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘গোয়েন্দা রিপোর্টে যাঁদের নাম আছে তাঁদের বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ : রাজধানীর গুলশান এলাকার নিজ ফ্ল্যাট থেকে সন্ধ্যায় খালেদ মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়।র‌্যাব জানায়, ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল থেকে র্যাব-৩-এর অর্ধশতাধিক সদস্য রাজধানীর গুলশান-২-এর ৫৯ নম্বর রোডের ৫ নম্বরের ছয়তলা বাড়ি ঘিরে ফেলে। ওই বাড়ির চতুর্থ তলার এ/৩ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। র্যাব সূত্র জানায়, অভিযানের সময় তারা তাঁর তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে লকার দেখতে পান। সেই লকার থেকে পাওয়া যায় দুটি আগ্নেয়াস্ত্র। সেই দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেখাতে পারলেও একটির মেয়াদ শেষ, অরেকটির শর্ত মানা হয়নি। পরে ওয়ার্ডরোবে একটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়। নগদ পাওয়া যায় ১০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া পাঁচ-ছয় হাজার ডলারও পাওয়া যায়।

অস্ত্রের পাশাপাশি একটি শোকেসে নীল রঙের প্যাকেটে ৪০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। এরপর খালেদকে হাতকড়া পরিয়ে একটি হাইয়েস গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা গেছে, খালেদ মাহমুদ তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করছিলেন। খালেদের পরিচিত একজন কালের কণ্ঠকে জানান, দুই দিন ধরে খালেদ মাহমুদ ঘর থেকে বের হতেন না। তাঁকে চিন্তিত দেখা যেত। খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। মতিঝিল-ফকিরাপুল ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো থেকে শুরু করে কমপক্ষে সাতটি সরকারি ভবনে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি জমি দখলের মতো নানা অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। রয়েছে একাধিক মামলাও। কয়েক বছর আগে অন্তর্দ্বন্দ্বে যুবলীগ নেতা রিয়াজ মিল্কি ও তারেক হত্যার পর পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেন খালেদ। ২০১২ সালের পর মহানগর যুবলীগের অন্য এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় ঢাকার এক অংশের নিয়ন্ত্রণ আসে খালেদের হাতে। রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন এ যুবলীগ নেতা। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়ং মেন্স নামের ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করেন। প্রতিটি ক্লাব থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ টাকা নেন তিনি। এসব ক্লাবে রাত-দিন জুয়া খেলা চলে। খিলগাঁও-শাহজাহানপুর হয়ে চলাচলকারী লেগুনা ও গণপরিবহনকে নিয়মিত টাকা দিতে হয় খালেদকে।

প্রতি কোররবানির ঈদে শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর পশুর হাট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। খিলগাঁও লেভেলক্রসিংয়ে প্রতিরাতে মাছের একটি হাট বসে। সেখান থেকে মাসে কমপক্ষে এক কোটি টাকা আদায় করেন তিনি। খিলগাঁও কাঁচাবাজারের সভাপতির পদটিও দীর্ঘদিন তিনি ধরে রেখেছেন। শাহজাহানপুরে রেলওয়ের জমি দখল করে দোকান ও ক্লাব নির্মাণ করেছেন তিনি। জানা যায়, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মুগদা এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ এই খালেদের হাতে। এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন—রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশির ভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন এ নেতা। ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া’ নামের প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে তিনি তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ইয়ং মেন্স ক্লাবে অভিযান : র্যাব ফকিরাপুল এলাকায় খালেদের নিয়ন্ত্রিত ‘ইয়ং মেন্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ১৪২ জনকে আটক করে। এদের মধ্যে দুজন নারী। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এখানে অভিযান শুরু করে র্যাব-৩-এর একটি দল। এতে নেতৃত্ব দেন র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম ও র্যাব-৩-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান। জানা গেছে, যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার তত্ত্বাবধানে ক্লাবটিতে নিয়মিত জুয়ার আসর বসে।

মতিঝিল থানার পাশেই অবস্থিত ইয়ং মেন্স ক্লাবটি ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলার জন্য ক্রীড়ামোদীদের কাছে পরিচিত হলেও জুয়ার আসর পরিচালনার বিষয়টি স্থানীয়দের ভীষণ বিব্রত করত। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই ক্লাবের কমিটিতে যুবলীগের কয়েকজন নেতা অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর তাঁদের প্রভাব বাড়তেই থাকে। ক্লাবটিতে নিয়মিত মদ্যপানের আসর বসানোর পাশাপাশি হাউজি খেলা চালু করেন তাঁরা। এরপর এখানে জুয়ার পরিসর বাড়তে থাকে। যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেগুনবাগিচার আটটি স্থানেও যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নিয়ে ক্যাসিনো চালানো হচ্ছে। এখানেই মূলত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ছয় নেতাসহ অনেকের আনাগোনা রয়েছে। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবেও অনানুষ্ঠানিক ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ রয়েছে গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, নিউ মার্কেট এলাকার এজাজ ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলাসহ বেশ কয়েকটি নামিদামি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে। জানা যায়, বড় ৬০টি ক্যাসিনোয় একেকটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। সেই হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোতে দৈনিক ১২০ কোটি টাকা উড়ছে। এ টাকার একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় বিদেশে। অনেক ক্ষেত্রে পেশাদার জুয়াড়িরা ক্লাব-গেস্ট হাউসের জুয়া পরিচালনা করলেও নেপথ্যের শেল্টারদাতা হিসেবে থাকেন যুবলীগের নেতা। গভীর রাতে ক্লাবগুলোতে আসতে শুরু করে বিত্তবানদের গাড়ি।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট