মাসুদের কাশ্মীর নামা
পর্ব – ০৩
জম্মু থেকে শ্রীনগর।
জম্মু স্টেশনে ট্রেন পৌঁছালে আমরা নেমে পড়লাম। মনের ভিতর এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে তখন। স্টেশনে নেমে অবশ্য অন্যরকম তেমন কিছু দেখলাম না। বাইরে এসে হেলাল ভাইয়ারা আমাদেরকে বাসের বদলে একটা টয়োটা ফরচুনার ঠিক করে দিলো। আমরা দুইজন ছাড়াও ড্রাইভার আরো কিছু লোক নিবে। এইজন্য আমাদেরকে একটি পেট্রল পাম্প এ ওয়েট করালো। তখন ও খুব গরম। ড্রাইভার আমাদেরকে পেট্রল পাম্পের ফাস্টফুডের দোকানে বসে অপেক্ষা করতে বললো। ওই ফাস্টফুডের দোকানে আবার এসি চলছে। আমরাও তার কথামতো ফাস্টফুডের দোকানে চলে গেলাম।
দোকানে প্রবেশ করার সময় দেখলাম দরজায় শক্ত পলিথিন। আমি জম্মু বাদে এই সিস্টেমটা আর কোথাও দেখি নাই। সাধারণত এসি শপ এ থাই গ্লাস লাগানো থাকে। অবশ্য এনারা থাই গ্লাস এর পরিবর্তে শক্ত পলিথিনের এক অদ্ভুত প্রযুক্তি আবিষ্কার করে নিয়েছে। আমরা বসে বসে অপেক্ষা করছি কখন ড্রাইভার এর কাঙ্খিত যাত্রী পেয়ে যায়। শপ এ তো আর খালি খালি বসে থাকা যায় না তাই আমরা দুইটা কোল্ড ড্রিঙ্কস অর্ডার করলাম। বসে বসে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছি এর মধ্যে এক জুটি মানে প্রেমিক প্রেমিকা এসে হাজির। তারাও যাবে শ্রীনগর। কথা বলে বুজলাম তারা এসেছে পাঞ্জাব থেকে। প্রথমে আমাদের গাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও অন্য একটা গাড়ির ড্রাইভার চালাকি করে তাদের নিয়ে নিলো এবং আমাদের অপেক্ষার প্রহর আরো বাড়তে লাগলো। আস্তে আস্তে অপেক্ষাটা অধৈর্যে পরিণত হলো। আমরা যাবো সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জায়গায়। কিন্তু আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আরো বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পর ড্রাইভার মহাশয় তার কাঙ্খিত যাত্রীর ব্যাবস্তা করলো এবং আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হলাম বহুল প্রতীক্ষিত শ্রীনগরের দিকে। আমাদের মধ্যে দুইজন ব্যাক্তি ছিল শ্রীনগরের এবং এক ছেলে ছিল লাদাখের।
আমরা চলা শুরু করলাম শ্রীনগর এর পথে। জম্মুর খুব হালকা যানজট পেরিয়ে যখন আমরা ন্যাশনাল হাইওয়ে ফোর এ উঠলাম তখন খুব এক্সিসাইটেড হলাম। চারপাশটা দেখে খুব ভালো লাগতে শুরু করলো। পাহাড় , সুন্দর পরিবেশ। তাছাড়া NH-4 এর ও একটা আলাদা সৌন্দর্য ছিল। আগে থেকেই আমি সামনের সিটটা নিজের জন্য বরাদ্দ রেখেছিলাম। এই জায়গায় আমি একটু স্বার্থপরের মতো কাজ করেছি। একটু না বেশ স্বার্থপরের মতো কাজ। ঘুরতে গিয়েছি মাত্র দুইজন। কিন্তু ইলিয়াছ কে পিছনে একা রেখে আমার নিজের সামনে আসাটা খুব বড় ধরণের স্বার্থপরের মতো কাজ ই মনে হবে। তবে এর পিছনে একটা কারণ ছিল। কারণটা হলো বমি। পিছনে বা মধ্যখানের সিট্ গুলাতে বসলে ইদানিং খুব বমির ডিসটার্ব হচ্ছে। গত দার্জেলিং টুর এর সময় ও পিছনে বসার কারণে প্রচুর বমি হয়েছিল। তাই স্বার্থপরের মতো সামনে বসা ছাড়া আমার আর অন্য কেন উপায় ছিল না।
আমরা NH-4 ধরে ছুটে চলেছি শ্রীনগর এর দিকে। যেমন সুন্দর রাস্তা তেমন সুন্দর গাড়ি আর সাথে রয়েছে এক টগবগে যুবক পাইলট। গাড়িও খুব ভালোই চালাচ্ছে আমাদের পাইলট মহাশয়। দুই ধারে পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে রাস্তা দেখতে খুবই চমৎকার লাগছিলো। কিছুদূর পর আবার একপাশে পাহাড় আর একপাশে নদী। সে যে কি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য ! একটু সময় পর একটা টোল দিতে হলো পাইলট মহাশয় কে। রাস্তাটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সবাই নিয়ম মেনেই গাড়ি চালাচ্ছিল। এটা দেখে বেশ ভালোই লাগলো। বেশ কিছুক্ষন পর একটা টানেল আসলো। জীবনে প্রথম গাড়িতে করে টানেল পার হবো। সে যে কি মজা বলে বুঝাতে পারবো না। টানেল পার হচ্ছি আর চিন্তা করছি মাথার উপর কি বিশাল পাহাড়। একটা দুইটা করে বেশ কয়েকটা টানেল পার হওয়ার পর আসলো সবথেকে বড়ো টানেলটা।
টানেলটা যেমন বড়ো তেমনি সাজানো গোছানো। টানেল গুলাই মনে হয় এমন সুন্দর হয়। অসাধারণ লাইটিং। গাড়িগুলো খুব সুন্দর ভাবে সারিবদ্ধ ভাবে চলছে। সামনে থেকে যখন গাড়িগুলা আমাদের গাড়িকে অতিক্রম করছে তখন বেশ চমৎকার লাগছিলো। টানেলের ভিতরের আবহাওয়াটাও অনেক সুন্দর। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব ছিল। এককথায় অসাধারণ। টানেল অতিক্রম করে বেশ কিছুসময় চলার পর পাইলট মহাশয় হাইওয়ে ছেড়ে মনে হলো শর্টকাট নিলো। পরে মনে হলো ঐটাই মনে হয় শ্রীনগর যাওয়ার রাস্তা। নতুন পথ ধরে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আমাদেরকে একটা রেস্টুরেন্টএ যাত্রা বিরতি দেয়া হলো।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমরা ফ্রেশ হওয়ার জন্য বললে আমাদেরকে রেস্টুরেন্ট এর ছাদে যেতে বলা হলো। ছাদে গিয়ে তো আমরা অবাক। রেস্টুরেন্টটা একটা পাহাড়ি নদীর কিনারায় অবস্থিত। ছাদ থেকে পাহাড়ি নদীটাকে অসাধারণ সুন্দর লাগছিলো। ফ্রেশ হওয়া বাদ দিয়ে চারিদিকটা শুধু দেখতে লাগলাম। তারপর বেশ কয়েকটা পিক তুলে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম। কি অর্ডার দিবো ঠিক বুজতে পারলাম না। অনেকক্ষন চিন্তার পর চা অর্ডার করলাম এবং পাশের টেবিলে একজন যেটা খাচ্ছিলো সেইটা দিতে বললাম। বেশ কিছু সময় পর চা এবং একটা বড়ো সাইজের লুচি দিয়ে গেলো। প্রত্যেক টেবিলে চিনি জাতীয় একটা কিছু দেখলাম। পরে অবশ্য জানলাম ওটা আমাদের দেশের মুহুরী টাইপের খাওয়ার পর খাওয়ার একটা জিনিস। কিন্তু আমাদের দেশের যে কেউ দেখলে ওটাকে চিনি বলে ভুল করবে। লাল চিনি।
নাস্তা শেষ করে বাইরে এসে দেখি সেই হেলাল ভাইয়ারা গাড়ি পার্ক করছে। এখানেও হেলাল ভাইদের সাথে বেশ কিছু সময় গল্প গুজব হলো। ওনারা বললো ওদের গাড়িতে যদি জায়গা থাকতো তাইলে আমাদেরকে উনাদের গাড়িতেই নিয়ে যেতো এবং হোটেল এ না রেখে ওনাদের বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্তা করতো। কত টুকু সত্যি তা জানি না তবে শুনে ভালো লাগলো। বললো উনাদের বাড়ি শ্রীনগর থেকে আরও প্রায় ৩৫ kilometer দূরে। আরও বললো এই রেস্টুরেন্ট এর মিষ্টি নাকি অনেক বিখ্যাত। সবাই বাড়ি যাওয়ার সময় এখান থেকে মিষ্টি নিয়ে যায়। তাই উনারাও মিষ্টি নেয়ার জন্য এখানে যাত্রা বিরতি দিয়েছে। উনারা মিষ্টি নিয়ে এবং আমাদেরকে পরবর্তী বার উনাদের মেহমান হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমরা আরো বেশ কিছু সময় ওই রেস্টুরেন্ট এ অবস্থান করলাম। এরই মধ্যে লাদাখের সেই ভাইয়ের সাথে বেশ গল্প টল্প করলাম। উনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় এ পরে শ্রীনগর যাচ্ছে একটা ভাইভা দিতে। তারপর আবারো আমাদের শ্রীনগর এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো।
একটু পর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে। রাস্তা বেশ খারাপ। একপাশে ভঙ্গুর পাহাড় আর একপাশে কয়েকশো ফুট গভীর নিচু নদী। নদীর দিকে তাকালেই মনের অজান্তেই ভয় চলে আসে। একটা বাঁকে পাইলট মহাশয় চা পানের বিরতি দিলো। তখন বেশ ভালো করেই দেখে নিলাম ভঙ্গুর পাহাড় আর গভীর পাথুরে নদী। ঐখানে বাকটার দিকে দেখিয়ে পাইলট মহাশয় বললো গতকাল এখানে টার্ন নেওয়ার সময় গাড়ির নিচে পাথর পড়ে গাড়ি এমন ভাবে ঘুরে গেলো যে রোডের পাশে যে ঢালাই দেওয়া বেশ উঁচু বেরিকেড থাকে ঐটায় বারি খেয়ে গাড়ি কোনো মোতে থেমে গেলো। ওই বেরিকেড গুলা না থাকলে আজ আপনাদের সাথে আমার দেখা হতো না। এখন বেরিকেড এর দিকে একটু অন্য নজর এ তাকাতে লাগলাম। মনের অজান্তেই একটা ভয় এসে মনের ভিতর আসন গেড়ে বসে গেলো।
এরকম একটা ভয় নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলাম। আগেই শ্রীনগর এর একজনের সাথে যোগাযোগ করে সব কিছু ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার এক বন্ধু ইমরান সব কিছু ঠিক করে দিয়েছিলো যে গতবছর কাশ্মীর ঘুরে গিয়েছিলো। আমাদের সিম যেহেতু কাশ্মীর এ চলবে না তাই আমরা ড্রাইভার এর ফোন থেকে শ্রীনগর এর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম। উনিও বেশ কিছু সময় পর পর কল করে আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছিলো আমরা ঠিক থাকে আছি কিনা এবং কত দূর পৌছালাম। এই বিষয়টা আমার কাছে বেশ ভালোই লাগছিলো। যেতে যেতে বেশ কিছুদূর পর একটা মিলিটারি টানেল পড়লো। বেশ জ্যাম। জ্যামের সুযোগে একটু প্রাকৃতিক কাজ সেরে নিলাম। ড্রাইভার এর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম কপাল ভালো থাকলে এই এলাকায় চিতাবাঘের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। তারপর থেকে বাকি পথ টুকু শুধু চেয়ে থাকলাম সামনে যদি একটা লেওপার্ড দেখা যায় কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি দেখা হলো না লেওপার্ড এর সাথে। লেওপার্ড দেখার আশায় থাকতে থাকতে পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর এ। পাইলট মহাশয় অন্য যাত্রীদেরকে বিভিন্ন জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আমাদেরকে সেখানে নামিয়ে দিলো যেখানে আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য অন্য একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। আমরা ভাড়া মিটিয়ে পাইলট মহাশয়কে খুশি করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।
নতুন গাড়িতে উঠেই তো আমরা পুরাপুরি অবাক হয়ে গেলাম। ড্রাইভার ভাই বলে উঠলো “মাসুদ ভাই কেমন আছেন ?” আমার হতবাকে উত্তর দিতে বেশ দেরি হয়ে যাচ্ছিলো। উনি আবার প্রশ্ন করলে তারপর আমি উত্তর দিলাম। মনে মনে চিন্তা করলাম আর খুশি হলাম এতটা দূরে কাশ্মীরে এসেও একজন বাঙালি ড্রাইভার পাওয়া গেলো। কিন্তু না উনি বাঙালি না। উনি কাশ্মীরি। বেশ বাংলা জানেন আর কি। অনেকটা চিন্তা মুক্ত হলাম। বেশ গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত গেস্ট হাউসে। উনারা বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা বেশ দেখেন বা খোঁজ খবর রাখেন। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রাহিম, মোস্তাফিজুর রহমানকে বেশ ভালোভাবেই চিনেন। গেস্ট হাউসে পৌঁছে উনাদেরকে বিদায় দিলাম সকালে একসাথে ঘুরতে যাবো বলে।
গেস্ট হাউসে আমাদের নির্ধারিত রুমে প্রবেশ করলাম। রুমটা বেশ বড়ো। একেবারে ডাল লেক এর পাশে যদিও সেটা বুজতে পেরেছি সকালে। গেস্ট হাউসের বারান্দা থেকে রুম সবখানে কার্পেট বিছানো। গেস্ট হাউসের বয় আসার পর রাতের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেলো। ইতিমধ্যে আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এর ভিতর ঘটলো এক অনাকাঙ্কিত ঘটনা। বাথরুমে ঢুকে দেখি কেঁচো। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লাম বেডে। বেড বেশ বড়। কিছুক্ষন পর খাবার চলে আসলো। লম্বা লম্বা চিকন চালের সাদা ভাত এবং মুরগির মাংশ। মাংশটায় একটু জ্বালানো কম কিন্তু বেশ মশলাদার। খুব ক্ষুধা ছিল তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম।
খাওয়া শেষ এবার ঘুমানোর পালা। এমন সময় আমাদের জানানো হলো আমাদের রুম পরিবর্তন করতে হবে। মানে পাশের গেস্ট হাউসে আমাদের যেতে হবে। এবার বেশ ভয় পেলাম। কি হচ্ছে ঠিক বুজতে পারলাম না। আমাদের কাছে কোন সিম নাই। আমরা পুরাপুরি নেটওয়ার্কের বাইরে। ঠিকঠাক মতো সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম নতুন রুম এর উদ্দেশ্যে। যাচ্ছি আর ভাবছি এই রুমের বাথরুম এ যদি কেঁচো থাকতে পারে তাইলে না জানি ওই রুম এর বাথরুম এ সাপ থাকে। এসব চিন্তা করতে করতে পৌঁছে গেলাম নতুন রুম এ। কিন্তু না নতুন রুম আমাদের হতাশ করে নাই। রুমটাও আগের থেকে অনেক ভালো আর আর বাথরুম ? এককথায় সুপার। যাক আপাতত চিন্তামুক্ত একটা ঘুম দেয়া যাবে। এইরুমটা ডাল লেকের আরো কাছে এবং সবথেকে বড়ো কথা এইরূমের জানালা খুললে ডাললেকের ক্যানেল দেখা যায়। অসাধারণ! আপাতত একটা ফ্রেশ একটা ঘুম দিতে হবে। যেইভাবা সেই কাজ। সোজা চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। সারাদিনের জার্নির ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটা কাশ্মীরের নরম কম্বলের পরশ পেতেই ঘুমের রানীর আদুরে মেয়েটা আমাকে পুরোপুরি দখলে নিয়ে নিলো।
দেখা হবে ঘুম থেকে উঠার পরে ….. চলবে।