পশ্চিম মেদিনীপুর:– রাজা মানসিংহের আমলের আগে থেকেই কেশিয়াড়িতে রয়েছে দেবী সর্ব্বমঙ্গলার মন্দির।মূল মন্দিরের মোট তিনটি ভাগ রয়েছে । যার শেষ ভাগে অর্থাৎ বর্তমানে মন্দিরে ঢোকার মুখের অংশটি রাজা মানসিংহের আমলে তৈরি হয়েছে বলে জানা যায় । তবে সর্বমঙ্গলা মায়ের মূল মন্দিরটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সঠিক সময় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে । সর্ব্বমঙ্গলা অত্যন্ত জাগ্রত দেবী। দূর্গাপূজা এই এলাকায় শুরু হয় সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরে পূজা দিয়ে। তবে অতীতের নিয়ম মেনে আজও দেবী সর্ব্বমঙ্গলাকে প্রত্যহ রাতে মাছ ভাজা সহ পান্তাভাত ভোগ দেওয়া হয়। সুদূর অতীতে কেশিয়াড়ি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। শোনা যায় পাল্কিতে চেপে কোন এক সধবা মহিলা একটি কুলের গাছ ( স্থানীয় ভাষায় বৈঁচ কূলের) তলায় বিশ্রাম করেন। তারপর দেখেন বেহারা আর নেই। সেই মহিলাই আসলে দেবী সর্ব্বমঙ্গলা। আরও কথিত আছে যে, রাজা মানসিংহের মনস্কামনা পূর্ণ করেছিলেন এই দেবী।
তাই দেবীর নিত্যপূজার জন্য তিনি অনেকটা জমি দিয়েগিয়েছিলেন। ময়ূরভঞ্জের এক রাজা, সিংভূমের রাজা, খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকার খেলাড়ের জমিদার শতপথি পরিবার, বেলদার কূশমুড়ির জমিদার দেব পরিবার সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের নামে শুধু জমি নয় গয়না এবং মন্দিরও দান করেছিলেন। সর্ব্বমঙ্গলা এতটাই সাধারনের দেবী অনেকেই দেবীকে কন্যাস্নেহে ‘মঙ্গলাবুড়ি’ বলেও সম্বোধন করেন। শুধু কেশিয়াড়ি, বেলদা বা খড়্গপুর, নয়াগ্রাম নয়। পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশা থেকেও বহুমানুষ আসেন পূজা দিতে। এখানে মানত পূরণে দেবীকে নতুন বস্ত্র পরানোর রীতি আছে। এক এক সময় এত ঘন ঘন বস্ত্র পরানো হয় যে, ঘন ঘন দেবীর রূপ পালটে যায়। তাই এলাকার মানুষের মধ্যে প্রচলিত কথা ছিল ‘মঙ্গলাবুড়ির ষোল ঘড়ি ষোল বেশ’।
প্রসঙ্গত এখানকার দুর্গাপূজা শুরু হয় পঞ্চমী থেকে ।আর ওই পঞ্চমীর দিন ঘট উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সর্বমঙ্গলা রুপি “বিজয়মঙ্গলাকে” দেবী দুর্গা রূপে পূজাে করা শুরু হয়।পুজোর পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রত্যহ চাল কুমড়োর বলি দেওয়া হয় । এখানকার সেবাইতদের একাংশ মিশ্র পদবী থেকে পরিচ্ছা তে পরিনত হয়েছেন। তবে কোন কোন সেবাইতের পদবী এখনো মিশ্রই আছে। দেবীর মন্দিরের সংস্কার, বিষয়সম্পত্তি দেখভাল এবং নিত্যপূজার পরিচালনার জন্য একটি ট্রাষ্টিবোর্ড ছিল। সেই বোর্ডের বহু সদস্য আজ আর নেই। বর্তমান সদস্যদের সাথে সেবাইতদের মাঝে মধ্যেই সংঘাত হয়। কখনো কখনো মামলা মোকদ্দমা ও হয়েছে। এখন প্রায় ১৫ বিঘা ধানজমি রয়েছে। এখানকার পুরানো নাটমন্দিরটি শুরু নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মন্দিরের বর্তমান সামনের অংশটি রাজা মানসিংহের আমলে তৈরি। দেবীর বিপুল পরিমান অর্থ ও সম্পত্তি নিয়ে এখনো মামলা চলছে।
সর্ব্বমঙ্গলা হল কেশিয়াড়ির মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার দেবী। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। গর্ভগৃহের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখানে বছরের বিভিন্ন দিনে বিয়ে সহ অন্যান্য পবিত্র অনুষ্ঠান হয়। দেবী নিরামিষাশী নন বলে অনেকেই মাছের ঝোল সহ ভোগ দেন। তবে মাছের পদে পেঁয়াজ রসুন ব্যবহার হয়না। দূর্গাষ্টমী ও বাসন্তী অষ্টমীতে নিরামিষ ভোগ হয়।প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়’। দূর্গাপূজার সময় সর্ব্বমঙ্গলাকে দেবী দশভূজা রূপে পূজা করা হয়। তবে মহালয়া থেকে চতুর্থী পর্যন্ত মূল মন্দির বন্ধ রাখা হয়।মন্দিরে ভেতরের অংশ এবং দেবীকে নব রূপে সাজিয়ে তোলা হয়। তখন মন্দিরের সামনে সর্বমঙ্গলা কে দূর্গা রুপি বিজয়মঙ্গলাকে পূজা করা হয়। পঞ্চমীর দিন দেবীর পূজা শুরু হয়। দূর্গাপূজার সময় অন্নকূটের ব্যবস্থা থাকে। অজস্র মানুষ আসেন দূর্গারূপী দেবী সর্ব্বমঙ্গলাকে পূজা দিতে। শুধু দূর্গাপূজা নয় কালী পূজার সময় দেবী কালিকা এবং বাসন্তী পূজার সময় দেবী বাসন্তী রূপে পূজিতা হন। গর্ভগৃহে আজও দেবীর আসন রয়েছে সেই কুলগাছের মূলে ,বলে সাধারনের বিশ্বাস।