পশ্চিম মেদিনীপুর:- নেই কামানের শব্দ।এখন হাতিশালায় হাতি আর ঘোড়াশালায় ঘোড়া নেই। উৎসব অনুষ্ঠানে কাছারিবাড়ির প্রাঙ্গণে আর বাজেনা নহবৎ। তবু দূর্গাপূজা এলে অতীতের সেই ঐতিহ্য ফিরে আসে ডাক কাঁসরঘণ্টা এবং শঙ্খধ্বনীতে ।বেলদা থানার কুশমুড়ির দেব পরিবারে। শতবর্ষ প্রাচীন দেব পরিবারের দূর্গাপুজায় এখন আর দেবী দশভূজার মূর্তি গড়া হয়না। ঘট বসিয়েই দেবী দূর্গার আরাধনা হয়। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সাথেসাথে কাছারিবাড়ির জৌলুস কমলেও ঐতিহ্য রক্ষায় দেবপরিবারের বর্তমান উত্তরসূরিরা আপ্রাণ প্রয়াসী।এই কাছারিবাড়ি এখন পোড় বাড়িতে পরিণত হয়েছে ।আগাছায় ছেয়ে গিয়েছে বাড়ির সমগ্র অংশ ।কিছু আগাছায় নাম না জানা কিছু ফুল ফুটে উঠেছে ।যেন সেই ঐতিহ্যের স্মারক ক্ষয়িষ্ণু বাড়িটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে ।দেব পরিবারে বাড়িতে ঢোকার মুখেই এখনো রয়েছে প্রায় ভঙ্গুর, তৎকালীন সেই প্রাচীন ঐতিহ্যশালী একটি তোরন।যার সামনে একসময় ঘোড়ায় ও হাতির পিঠে চড়ে তৎকালীন রাজারা ও ইংরেজরা আসতেন রাজবাড়ীতে ।
প্রায় দেড়শ বছর আগে বিহারের রাজপুতদের একজন গুরুপ্রসাদ দেব কুশমুড়ি এলাকায় সুদের ব্যবসা করতে আসেন। উদায়স্ত ঋণ ব্যবস্থা ছিল। সূর্যাস্তের পর ঋণ শোধ করতে নাপারলেই ঋণ গ্রহীতার জমি দখল করে নিতেন ঋণ দাতা। এভাবেই অধূনা বেলদা১ গ্রামপঞ্চায়েতের কুশমুড়িতে দেব পরিবারের প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরিবারের দুই সন্তান রাধামোহন দেব এবং গোলকমোহন দেব। এঁরাই তদানীন্তন রাজার কাছ থেকে চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। চৌধুরী রাধামোহন দেব এবং চৌধুরী গোলকমোহন দেব , পরিবারের কুলদেবতা ব্রজরাজ দেব মহাপ্রভুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে দেবপরিবারের কুলদেবতার এই মন্দির তৈরি করতে প্রায় ১২ বছর সময় লেগেছিল। এখন বর্তমান উত্তরসুরিরা দূর্গাপূজার আয়োজন করেন। আর এই কুল দেবতার মন্দির এর কাছেই রয়েছে দুর্গা মন্দির ।তবে তার অবস্থা এখন জরাজীর্ণ ।বর্তমান যেসকল উত্তরসূরিরা রয়েছেন তারা সবাই মিলে অর্থ দিয়ে এবছর মন্দিরটিকে পুনরায় ঠিক করার পরিকল্পনা নিয়েছেন ।সামনে আর কটা দিন পরে পুজো তাই যার কাজও চলছে এখন বেশ জোরকদমে ।
পরিমল দেব, অমল দেব, ত্রিপুরারি দেব, দীপক দেব, প্রবীর দেব, ঊষারানী দেব, কিরন দেব, অরুন দেব, দিব্যেন্দু দেব এবং সদারানী দেব এই দূর্গাপুজা পরিচালনা করেন। আগে ডাকের সাজের দেবী দশভূজা তৈরির জন্য খরচ হত লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু একদিকে জমিদারির পতন, আর অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পুজার খরচকে সঙ্কুচিত করেছে। তাই ১৯৭২ সাল থেকে কূশমুড়ির প্রাচীন কাছারিবাড়ির অঙ্গণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঘটপূজা। অথচ একসময় কুশমুড়ির দেবপরিবারের দূর্গাপুজা ছিল জেলার সেরা পুজা। এখানকার জমিদারই কেশিয়াড়ির সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরের জন্য প্রায় ৫০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। দেব পরিবারের দুর্গাপুজা শুরুর আগে সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরে পুজা দেওয়া হত। এই প্রথা এখনো আছে। দেব পরিবারের পুজা আগে সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের কাছে দেওয়ার পর শুরু হয় দুর্গােপুজোর । আবার দেব পরিবারের দূর্গাপুজা শুরুর আগে কামান দাগা হত। দেব পরিবারের দূর্গাপুজার সূচনার শব্দ শোনার পর অন্যান্য জায়গার পুজা শুরুহত।
এখনো কুলদেবতার মন্দিরে নিত্যপুজা হয়। সেইপুজার খরচ ও সব শরিক মিলে দেন। অতীতে দূর্গাপুজার প্রায় একমাস আগে থাকে সাধুসন্তরা এখানে আসতেন। দেবীর মূর্তি গড়তেন মেদিনীপুর ও ঘাটালের শিল্পীরা। জমিদার পরিবারের লোকজন পালকি ছাড়া বেরতেন না। এখন আর সেসব নেই।
পুজার আচার মেনে এখানে ঘটপুজা শুরু হয় সপ্তমী থেকে। অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। পুজার দিনগুলিতে নিষ্ঠার সঙ্গে আচার মানা হয়। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসতেন দেবপরিবারের দূর্গাপুজা দেখতে। আগে দূর্গাপুজার দিন গুলিতে যাত্রা পালা হত। এখন আর এসব হয়না। তবুও ঘট পুজার মাধ্যমে ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করাহচ্ছে।একদিকে পূজা, হোম, যজ্ঞ হত। আর অন্যদিকে দানধ্যান করাহত। সাধু সন্তদের শুধু থাকা খাওয়া নয় তাঁদের বিভিন্ন সামগ্রী দান করা হত। এখন দান ধ্যানের বালাই নেই। তবু অনেকে আসেন দেব পরিবারের ঘট পূজা দেখতে। সপ্তমীতে পাতপেড়ে খাওয়ানো ও হয় অতিথিদের। পরিবারের অন্যান্য জায়গায় যারা রয়েছেন আত্মীয়স্বজনরাও হাজির হন ওই দিন ।একসঙ্গে দূর্গাপূজার এই কটা দিন বেশ আনন্দের সঙ্গে কাটান বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা ।