তারকেশ্বর : আজ এক তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে রইলাম (১৬/০৭/২০১৯)
সকালে ৬:৩২ মিনিটের ট্রেন ধরে হাওড়া থেকে আমি আর আমার স্ত্রী তারকেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই ।
ঠিক ৮:০৫ মিনিট নাগাদ তারকেশ্বরে পৌঁছে যাই । স্টেশন থেকেই এক পান্ডা পিছু নিল । যতো বলি আমাদের দরকার নেই, পূজো দেব না, কিন্তু উনি পিছু ছাড়ছেন না । ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছেন । শেষ পর্যন্ত একটু জোরের সাথেই বললাম যে আমাদের দরকার নেই । তখন পিছু ছাড়ল । স্টেশনের বাইরে কিছুটা এগোতেই আরেকটি ছেলে পিছু নিল । অল্পবয়েসী ছেলে । ছিনে জোঁকের মতো লেগে রইল । বলল, ঘর আছে । ঘর নিতে পারেন । নন এসি ২৫০/- টিভি ছাড়া, আর টিভি সহ নিলে ২৮০/- । পাঁচটা পর্যন্ত থাকা যাবে তাতে । এসি রুম ৮০০/- । এছাড়া ঘরে বসেই খাওয়া যাবে ইত্যাদি, ইত্যাদি । ওদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে । সেটাও দেখিয়ে দিল । এমন কি যখন বললাম যে আমাদের ঘর লাগবে না, পূজো দেব আর চলে যাব । তা সত্বেও বলে চলল, চলুন না । না নিলেও একবার ঘরটা দেখে নিন । এটা অনেকটা শাড়ির দোকানে যেমন করে আর কি ।
দিদি, নিতে হবে না, শুধু দেখে যান । যাই হোক, ওর উদ্দেশ্যটা বোঝা গেল না । বাড়ি দেখতে গিয়ে কোন ফাঁদে পড়তাম জানি না । ঘাটের অনেকটা আগেই একটা দোকানে প্রসাদ কেনার জন্য ঢোকাতে চাইছিল কিন্তু আমরা সেখানে ঢুকি নি । এবার ঘাটের কাছে একটা দোকানে দাঁড়ালাম প্রসাদ কিনব বলে । ছেলেটি আমাদের সঙ্গে আছে । আগেই বলছিল, বেকার ছেলে, এই করে খাই । লোকে দশ, বিশ, পঞ্চাশ যা দেয় তাতেই চলে । এবার ঐ দোকানে জুতো, ব্যাগ রাখলাম । সামনে ঘাটে গিয়ে হাত, পা ধুয়ে নিলাম । দোকানের একটি ছেলে কাগজ, কলম নিয়ে দাঁড়াল । প্রসাদ কতো টাকার কিনব তা লিখবে বলে । সবচেয়ে কম জেনারেল বলল ২৫০ টাকা, হাফ ৩৫০ টাকা আর ফুল ৫৫০ টাকা । আমি জিজ্ঞেস করলাম, কমের মধ্যে কিছু নেই ? বলল, না । সবচেয়ে কম ২৫০ টাকা । আবার একটা কথা বলল । আপনি ৩৫০ টাকা দিন তবে ঐ ৫৫০ টাকার ফুল (full) প্রসাদ দেব যাতে ১৬ রকমের প্রসাদ পাবেন । যাইহোক অগত্যা ২৫০ টাকার ডালা নিলাম । যাতে কয়েকটা রঙ্গিন বাতাসা, নকুলদানা কিছু আর বাকি সব সাদা বাতাসা দিয়ে হাড়িটা ভর্তি । এছাড়া গোটা দশেক সুতো (ধাগা), হাতে বাধার জন্য । ডালার পর্ব মিটল । এবার ধূপকাঠি ও মোমবাতির জন্য আরো কুড়ি টাকা দিলাম ।
এবার ঐ ডালা নিয়ে দোকানের ছেলেটি এলো জলের ঘট কেনার জন্য সারিবদ্ধ দোকানগুলোর একটিতে । জলের কলসির সাইজের ঘট থেকে নানান আকৃতির ঘট । আমরা বললাম ছোট ঘট দিতে । জল ভর্তি ছোট্ট ঘট আর কয়েকটা ফুলসহ এক একটা ৬০ টাকা করে চাইল । আমি বললাম, এর চেয়ে ছোট নেই । বলল, এটাই সবচেয়ে ছোট । পাশাপাশি অনেক ঘটের দোকান । বুঝতে পারলাম মুরগী বানাচ্ছে । তাই বললাম, না এটা নেব না । আমি অন্য জায়গায় দেখছি । বলে পা বাড়াতে যেতেই আগের ঘটের তুলনায় আরেকটু ছোট ঘট দিয়ে বলল, এটা নিন । তিরিশ টাকা । সেই ঘট দুটো নিলাম । অগ্রসর হলাম মন্দিরের দিকে । ডালা কেনার সময় দোকানের ছেলেটি বলেছিল যে পূজোর দক্ষিণা ছাড়া আর কিছু দিতে হবে না । দক্ষিণা আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী দশ, বিশ, পঞ্চাশ যা খুশি দেবেন । কিন্তু মন্দিরের সামনে গেরুয়া ধূতি, কুর্তা পরিহিত লম্বা চওড়া এক পুরুতের হাতে ডালাটি দিল ।
আমরা ভাবলাম ইনি আমাদের মন্দিরে নিয়ে যাবেন পূজো করবেন । না, তা করলেন না । মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়লেন । আমাদের সাথে সাথে বলতে বললেন । হলো সেটা । এবার জিজ্ঞেস করলেন আমরা কতো টাকার সংকল্প দিতে চাই । মানেটা বোঝার চেষ্টা করলাম । বলল, ৩৫০ টাকার আছে, ৭৫০ টাকার আছে, ১২০০ টাকারও আছে । আমি তখন সঙ্গের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কেন লাগছে । তুমি তো বলেছিলে দক্ষিণা দেবেন আপনার খুশি মতো, দশটাকা, বিশ টাকা । এতো টাকা দেব না । আমরা এভাবে এতো টাকা দিয়ে সংকল্প কিছু করব না । তখন দেখলাম সেই পুরুত ভদ্রলোক (?) বেশ রুষ্ট হলেন । এরপর কিছুক্ষণ দরাদরি চলতে লাগল । ৩৫১-৩০১-২৫১-২০১-১৫১ এইভাবে নীচে আসতে লাগল । শেষে ১০১ টাকায় রফা হলো । ফল হলো পুরুত ভদ্রলোক ডালাটি দোকানের ছেলেটির হাতে দিয়ে ১০১ টাকা নিয়ে চলে গেল । দোকানের ছেলেটি বলল, আপনারা এবার জল ঢেলে আসুন । আমি বললাম, ডালাটার পূজো হবে না ? বলল, হ্যাঁ, উনি করবেন । আমি বললাম, উনি তো এটা দিয়ে চলে গেছেন ।
আর কোনো উত্তর নেই । আমরা বাবার মাথায় জল ঢালার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম । বেশি ভিড় ছিল না । কিছু লোক (৮-১০) সামনে ভিড় করে ছিল । মন্দিরের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না । একটা চ্যানেল করা আছে । যাতে সকলে বাইরে থেকে জল ঢালছে যা বাবার কাছে (মাথায় ?) গিয়ে পড়ছে । একজন মহিল পুলিশকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । যেখান দিয়ে সবাই বের হচ্ছিল জল ঢেলে সেই দিকে । আমরা যখন জল ঢাল ছিলাম তখন কয়েকজন পেছন থেকে আমার মাথায় ও হাতে জল ঢেলে স্নান করিয়ে দিল । স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তাই হলো । খুব বেশি হলে ১৫-২০ জন ছিল লাইনে । কিন্তু অসভ্যতামি যারা করে তারা যে সর্বদা ভিড় থাকলেই করে তা কিন্তু নয় । যাইহোক বাবার হয়ে আমি তাঁর জল মাথায় ও শরীরে নিয়ে সেই ব্যক্তিগণের হয়ে বাবার কাছে প্রার্থনা করলাম যাতে ওদের উনি সুবুদ্ধি দান করেন । জল দেওয়ার পর এবার মোমবাতি ও ধূপকাঠি জ্বালানোর জায়গায় এলাম । একজন সেখানে পেতলের কর্পূরদানীতে কর্পূর নিয়ে ঘুরছিল । কিছু বোঝার আগেই আমার হাতে একটা কর্পূরদানী ধরিয়ে কর্পূরে আগুন দিল আর বলল, দশটাকা ।
আমি বললাম, চাই না । ফেরত দিতে উদ্যত হলাম । গিন্নী বলল, থাক, একটা তুমি নাও । দশটাকা দিয়ে দিলাম । দোকানে ফিরে এলাম । আমাদের ডালার প্রসাদ বেঁধে দিয়ে হাত পাতল দুজনে – যে আমাকে নিয়ে এসেছিল আর দোকানের ছেলেটি । বলল, আপনি খুশি মনে পঞ্চাশ-একশ যা দেবেন দু’জনে ভাগ করে নেব । পঞ্চাশ টাকা ওদের দিলাম । আমাকে সেই ছেলেটি একটা কার্ড দিল । বলল, কেউ এলে এই ফোন নাম্বারটা দেবেন । আর ফোন করে আসতে বলবেন । মনে মনে ভাবলাম, তা আর বলতে । তোমরা যাতে এভাবে লোককে ঠকাতে পারো তাকে উৎসাহ দেবার জন্য লোক পাঠাবো । আমি এখানে ওর ভিজিটিং কার্ডের ছবিও দিলাম ।
গিন্নিকে বললাম, আর এভাবে কোনোদিন কোনো মন্দিরে পূজো দেব না । ভগবান দর্শন করব । আর প্রণামী বাক্সে নিজের সামর্থ অনুযায়ী দান করব । এই পান্ডা ও দালাল চক্র বন্ধ করার এর চেয়ে সহজ উপায় কিছু নেই ।
এখানে এসব জানানোর একটাই উদ্দেশ্য যাতে সকলে সাবধান হোন ।
ফিরে এলাম ৯:৩২ মিনিটের ট্রেন ধরে ।
* ** সমির চক্রবর্তী ***
( আপনিও আপনার ভ্রমণ কাহিনী আমাদের লিখে পাঠাতে পারেন , [email protected] এ )