Categories: ভ্রমণ

চলুন ঘুরে আসি টেরাকোটার শহর বিষ্ণুপুরে

বর্তমানে চাকুরীসূত্রে মেদিনীপুরের কাছে থাকার সুবাদে প্রায় গাড়ি নিয়ে বিষ্ণুপুরে ঘুরে আসি। বিগত কয়েক বছরে বিষ্ণুপুরে শহরের দ্রষ্টব্যস্থান গুলোর অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। বাস স্ট্যান্ডের আধুনিকীকরণ হয়েছে। বিষ্ণুপুর ছোট বড়ো বিভিন্ন ধরনের প্রচুর মন্দির থাকার জন্য এই শহরটি মন্দির শহর হিসাবে প্রসিদ্ধ। টেরাকোটার অপরূপ নিদর্শন সহ এই সকল মন্দিরগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে এই মন্দিরগুলোর বেশির ভাগ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং মন্দিরগুলির অবস্থান বেশ কাছাকাছিই। বাংলার এই প্রাচীন নিদর্শন গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে চলেছে, অতএব হাতে কিছু সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন এবং নিজের চোখে এইসকল টেরাকোটা মন্দিরগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরিদর্শন করে যান। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত তিনটি স্থাপত্য টিকিট কেটে দেখতে হয় রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির আর জোড় বাংলা মন্দির তথা কৃষ্ণরায় মন্দির। এন্ট্রি ফি ₹ ২৫/- বিষ্ণুপুরের এই তিনটি মন্দিরের যেকোনো একটি মন্দির থেকে টিকিট কাটলে অন্যান্য মন্দিরগুলোতে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিষ্ণুপুর রেলওয়ে স্টেশন কিংবা বাস স্ট্যান্ড থেকে নেমে অটো অথবা টোটোতে করে সোজা কলেজের দিকে আসার সময়ে বামদিকে দেখতে পাবেন বিশাল পিরামিডাকৃতি রাসমঞ্চ। রাসমঞ্চ দেখে ফিরে এসে কলেজের কাছে মেন রাস্তার উল্টো দিকের রাস্তায় অল্প কিছুটা গেলে লোহা দিয়ে তৈরি দলমাদল কামান দেখা যাবে। এই প্রাচীন কামানটিতে এত বছর পরে একটুও মরচে পড়েনি। দলমাদল কামানের পাশেই রয়েছে ছিন্নমস্তা মন্দির। আবার কলেজের দিকে এসে কলেজ ছাড়িয়ে বাম দিকের রাস্তায় প্রথমে পড়বে জঙ্গলে ঢাকা স্তুপের মধ্যে বিশাল লাল ইটের গুমঘর, একটু সামান্য এগিয়ে বাম দিকে গেলে পড়বে পাঁচচূড়া যুক্ত শ্যামরায় মন্দির। আবার এই গুমঘর থেকে আরও কিছুটা সামনে গেলে রাস্তার উপরে রাধাশ্যাম মন্দির, এই মন্দিরের সীমানার ভিতরে রয়েছে তুলসীমঞ্চ, রান্নাঘর ও নাটমঞ্চ। এই মন্দিরে আজও পুজোপাট হয়ে থাকে। রাধাশ্যাম মন্দিরের আগে ডান দিকের রাস্তায় একটু এগোলেই দেখা যাবে দুটো বড় মন্দির ও একটি ছোট মন্দির নিয়ে তৈরি জোড় বাংলা মন্দির এটি স্থানীয়ভাবে কৃষ্ণরায় মন্দির নামে পরিচিত।

আবার রাধাশ্যাম মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে মৃন্ময়ীমাতার মন্দির। বছর দুয়েক পরে গত রবিবারে আমার অফিসের কলিগ উৎপলের সাথে এবারে গিয়ে দেখলাম এই মৃণ্ময়ী মন্দিরের উত্তর ও পূর্ব কোণে খুব সুন্দর একটি পার্ক তৈরি হয়েছে। নবনির্মিত খুব সুন্দর এই পার্কের পিছনে দেখা যাবে প্রাচীরে ঘেরা রাধালালজিউর মন্দির। রাধালালজিউর মন্দির ছাড়িয়ে একটু গেলেই বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা দুর্গের তোরণের মতো বড় পাথর দরজা ও তার পরে ছোট পাথর দরজা। দু’টি পাথর দরজার তলা দিয়ে বেশ কিছুটা দূরে শহরের আরেক প্রান্তে মদনমোহন মন্দির। মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরের ছিন্নমস্তা মন্দিরের কাছে একটু ছাড়িয়ে প্রাঙ্গণে প্রতি শনিবার দুপুর একটা থেকে পোড়ামাটির হাট বসে। এত কিছু দেখার পরেও যেন বিষ্ণুপুরে দেখার মতো থেকে যায় আরও অনেক মন্দির ও আরও অনেক কিছু।

বিভিন্ন মন্দির ছাড়া এই শহরটি কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের জন্যও বিখ্যাত। এখানকার বালুচরি, স্বর্ণচরী শাড়ির কদর জগৎবিখ্যাত। এই শাড়ি কীভাবে কারিগররা তৈরি করে তা এখানে নিজের চোখে দেখে নেওয়া যায়। শাড়ী ছাড়া নানা হস্তশিল্পও এখানের খুব বিখ্যাত যার মধ্যে রয়েছে জনপ্রিয় পাঁচমুড়ার টেরাকোটা ঘোড়া, বিষ্ণুপুরী লন্ঠন, পোড়ামাটির নানা কাজ ইত্যাদি। শঙ্খ শিল্পের জন্যও বিষ্ণুপুরের নাম আছে। এছাড়া বিষ্ণুপুরের আরও এক ঐতিহ্য দশাবতার তাস। এই তাস সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। শিল্প সংস্কৃতির এই শহরে যদুভট্ট মঞ্চটিও দেখার মতো। বছরের শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের ২৩ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত চলে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী “বিষ্ণুপুর মেলা”। ঐতিহ্যে এবং কলেবরে এই মেলা শান্তিনিকেতনের মেলার থেকে কোনো অংশে কম নয়। অতএব বেড়ানো এবং কেনাকাটা দুটোই একসাথে সেরে নিতে বিষ্ণুপুরের সফরটা মন্দ হয় না ৷ কোনো অসুবিধা হলে অনুমোদিত গাইড সঙ্গে নিতে পারেন।

কিভাবে যাবেন :
হাওড়া বা সাঁতরাগাছি থেকে সরাসরি ট্রেনে করে বিষ্ণুপুর স্টেশনে যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সরাসরি সরকারি এবং বেসরকারি বাস চলে। এছাড়া ট্রেনে আরামবাগে নেমে সেখান থেকে বাসে করে কামারপুকুর, জয়রামবাটি হয়ে বিষ্ণুপুরে যাওয়া যায়। নিজস্ব গাড়িতে যেতে হলে সোজা মুম্বাই রোড ধরে খড়্গপুর চৌরঙ্গী থেকে ডানদিকে ঘুরে মেদিনীপুর হয়ে যাওয়া যায়। আবার সাঁতরাগাছি বা নিবেদিতা সেতু পার হয়ে আরামবাগ, কামারপুকুর, জয়রামবাটি হয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায়।

কোথায় থাকবেন :
থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো বন্দোবস্ত পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন টুরিস্ট লজে, কিন্তু বর্তমানে এটির সংস্কার চলছে। ভাড়া আনুমানিক ১,০০০-২,২৫০ টাকা। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুব হোস্টেল। ভাড়া আনুমানিক ৪০০-৩,০০০ টাকা। সাত আট মাস আগে এখানে ষ্টার ক্যাটাগরির হোটেল অন্নপূর্ণা চালু হয়েছে। ভাড়া আনুমানিক ২৫০০-৭,৫০০ টাকা। এই হোটেলে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাও আছে। বেসরকারি হোটেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উদয়ন লজ, হোটেল লক্ষ্মী পার্ক, মোনালিসা লজ।
পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন টুরিস্ট লজ : https://www.wbtdcl.com
যুব হোস্টেল : https://youthhostelbooking.wb.gov.in

**** রুদ্র প্রসন্ন সেন ****

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

রবীন্দ্র সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শনিবার রাতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে

কলকাতা, ১৬ নভেম্বর ২০২৪:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে আগামী শনিবার রাত থেকে রবীন্দ্র সেতু…

2 days ago

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

3 days ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

3 days ago

বিহারের জামুইতে ভগবান বীরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনজাতীয় গৌরব দিবসে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের জামুই জেলায় জনজাতীয় গৌরব দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে…

3 days ago

২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আগামী ২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। ঐ একই দিনে নান্দেথ…

4 days ago

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তায় ‘সরস মেলা’র উদ্বোধন করবেন ।আগামীকাল তিনি যাবেন…

4 days ago