পিরিয়ড/ মাসিক/ মিনস/ মেন্সট্রুয়াল সাইকেল সৃষ্টিকর্তা কতৃক নির্ধারিত, নারী চরিত্রের প্রকৃতিপ্রদত্ত একটি নিয়ম। এই স্বাভাবিক বিষয়টিকে সমাজে ট্যাবু করে রাখা হয় যার ফলে তৈরি হয় নানান ভুল ধারণা। এর জন্য অন্যতম কারণ ‘অজ্ঞতা’। এই অজ্ঞতার কারণে একজন নারীকে অনেক লজ্জাজনক এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। খুব দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে, অধিকাংশ মেয়েরাই এর খুঁটিনাটি জানেন না। এ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিতেই আজকের এই লেখা।
পিরিয়ড কী?
প্রতি চন্দ্রমাস পরপর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে তাকেই ঋতুচক্র বলে।
একজন নারীর পিরিয়ড তাকে প্রতি মাসে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে। আরেকটু সহজ ভাষায় বললে, আমরা শুধু জানি বাচ্চা হওয়ার জন্য পিরিয়ড হয়। তো বাচ্চা হওয়ার জন্য পিরিয়ড কেন হওয়া লাগে? কারণ, প্রতিমাসে মেয়েদের গর্ভাশয় তার বাইরের আবরণটাকে শক্ত করে যেন গর্ভবতী হওয়ার পর বাচ্চাকে আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু পরে যখন ভ্রূণ নিষিক্ত হয় না তখন সে তার সেই শক্ত আবরণটাকে ছিঁড়ে ফেলে আবার পরের মাসের জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। যে কারণে মেয়েদের শরীরের ভেতরের একটা অঙ্গ ছিঁড়ে সেটা সেই রক্তের সাথে বের হয়ে যায়। এই পুরো প্রক্রিয়া গড়ে ২৮ দিনের মধ্যে হয়।
পিরিয়ড ফেজ
এর তিনটি অংশ-
- মেন্সট্রুয়াল ফেজ- ৪ দিন স্থায়ী হয় (৪-৭ দিন)
- প্রলিফারেটিভ ফেজ- ১০ দিন স্থায়ী হয় (৮-১০ দিন)
- সেক্রেটরি ফেজ- ১৪ দিন স্থায়ী হয় (১০-১৪ দিন)
পিরিয়ড প্রক্রিয়া
মেন্সট্রুয়াল ফেজ: এই যোনি পথে রক্ত বের হয়। ৪-৭ দিন স্থায়ী এই রক্তপাতে ভেঙ্গে যাওয়া রক্তকনিকা ছাড়াও এর সাথে শ্বেত কনিকা, জরায়ুমুখের মিউকাস, জরায়ুর নিঃসৃত আবরণী, ব্যাকটেরিয়া, প্লাজমিন, প্রস্টাগ্লানডিন এবং অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে থাকে। ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের যৌথ ক্রিয়ায় এই পর্বটি ঘটে।
প্রলিফারেটিভ ফেজ: ৮-১০ দিন স্থায়ী হতে পারে। শুধু ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে এটি হয়। এই সময় জরায়ু নিষিক্ত ডিম্বাণুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্ততি নেয়।
সেক্রেটরি ফেজ: সবচেয়ে দীর্ঘ, প্রায় ১০-১৪ দিন। একে প্রজেস্টেরন বা লুটিয়াল ফেজ-ও বলা হয়। এটিও ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন উভয় হরমোনের যৌথ কারণে হয়। এই সময় নিষিক্ত ডিম্বাণুর বৃদ্ধির জন্য জরায়ু সর্বোচ্চ প্রস্ততি নিয়ে থাকে।
ডিম্বাশয়ের কোনো ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত না হলে জরায়ু আবার মেন্সট্রুয়াল ফেজ-এ চলে যায়। এভাবেই পূর্ণ বয়স্ক মেয়েদের ঋতুচক্র চলতে থাকে।
পিরিয়ড–এ রক্তপাতের পরিমাণ
প্রতি পিরিয়ডে এক কাপেরও কম রক্ত নিঃসৃত হয়। সাধারণত প্রথম দুই দিন বেশি রক্ত নিঃসৃত হয়। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি-এর স্কুল অব মেডিসিনের মতে-প্রতি মাসে কয়েক চামচ থেকে বড়জোর এক কাপ পরিমাণ রক্ত বের হয় শরীর থেকে। যদি ব্যবহার শুরু করার ২ ঘণ্টার কম সময়ে প্যাড সম্পূর্ণ ভিজে যায় তাহলে বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক নয়। জরায়ু মুখের ক্যান্সার, টিউমার, ওভারিয়ান সিস্ট ইত্যাদি কারণে পিরিয়ড-এ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। তাই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে লজ্জা না পেয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন ব্যবহারের নিয়ম
বাজারে এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ড-এর, বিভিন্ন ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড পাওয়া যায়। যে ধরনেরই হোক না কেন তা কোনভাবেই দীর্ঘক্ষণ পরা উচিত নয়। পিরিয়ড-এর প্রথম দুই-তিন দিন একটু বেশী রক্তক্ষরণ হয়, তাই দুই ঘন্টা পরপর প্যাড পরীক্ষা করে দেখা উচিত। যদি প্যাড শুকনো না থাকে অর্থাৎ উপরের অংশে রক্ত ভেসে আসতে দেখা যায় তবে সাথে সাথে তা চেঞ্জ করা উচিত এবং কোনভাবেই চার ঘণ্টার বেশি একটি প্যাড পরা উচিত নয়।
কিন্তু চতুর্থ বা পঞ্চম দিন থেকে রক্তস্রাবের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। এসময় অনেকেই আছেন যারা একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কম ব্লিডিং হয়েছে ভেবে দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহার করেন। এতে করে সেই রক্ত দ্রুত শুকিয়ে সেখানে জীবানুর আক্রমণ হয় যা যোনিপথের সংস্পর্শে এসে চুলকানি, ফোঁড়া, যৌনাঙ্গের নানান রকম অসুখ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশন ইত্যাদি সৃষ্টি করে। লোভনীয় বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে মেয়েরা চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরে থাকে। কিন্তু এ ধরনের প্যাড দীর্ঘসময় শুকনো রাখার জন্য ‘সেলুলোজ জেল’ নামক উপাদান ব্যবহার করা হয় যা জরায়ুমুখের ক্যান্সার-এর জন্য দায়ী। তাই এ বিষয়ে নিজ দায়িত্বে সচেতন হতে হবে।
পিরিয়ড–কালীন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা
পিরিয়ড-এর সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা খুবই জরুরী। প্রত্যেকবার স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলের সময় নিজেকে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। স্কুল, কলেজ বা অফিসে সম্ভব না হলেও বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে হালকা গরম পানির সাথে জীবাণুনাশক সাবান বা বডি ওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে নিজেকে পরিষ্কার করুন। স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তনের সময় পরনের প্যান্টি-ও বদলে ফেলবেন। এটা জরুরী। নাহলে এত কষ্ট করে পরিষ্কার হবার কোন মানে নেই। ব্যবহৃত প্যান্টি ধোয়ার সময় স্যাভলন বা জীবাণুনাশক লিকুইড দিয়ে ধুয়ে নেয়া ভালো।
সামাজিক কিছু ভুল ধারণা
শারিরীক অস্বস্তির পাশাপাশি নানান রকম কুসংস্কারের কারনে প্রাচীনকাল থেকেই পিরিয়ড মেয়েদের জন্য গোপন ও লজ্জাজনক। মাসিক হলে ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না, শরীরে পানি লাগানো যাবে না, চুল ধোয়া যাবে না, বিছানায় শোয়া যাবে না… এছাড়াও আরো কত কী!! কিন্তু এ সবই ভুল ধারণা। এই সময় ঘরের কোনায় না থেকে বাইরের আলো বাতাসের সংস্পর্শে থাকা উচিত। নিয়মিত গোসল করা ও পরিষ্কার কাপড় পরা উচিত। এছাড়াও পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে মেয়েরা রান্নাঘরে ঢুকতে পারবে না, আচারে হাত দিতে পারবে না এরকম কিছু ভ্রান্ত ধারণাও প্রচলিত আছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
পিরিয়ড নিয়ে কিছু টিপস
- থাকুন হাসিখুশি। পছন্দের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন, চাপমুক্ত থাকুন।
- পিরিয়ড-এর সময় চুপচাপ শুয়ে বসে না থেকে হালকা কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। রক্ত প্রবাহ নিয়মিত করতে ও ব্যথা কমাতে এটি খুবি উপকারী।
এ সময় তলপেটে হালকা ব্যথা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে শুরুতেই পেইনকিলার খাওয়া উচিত নয়। হট ওয়াটার ব্যাগ-এ গরম পানি নিয়ে - তলপেটে হালকা সেঁক দিলে ব্যথা অনেকটাই কমে যায়।
- ভারী কাজ বা ব্যায়াম থেকে বিরত থাকতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে পানি, ফলের জুস ও শরবত জাতীয় খাবার-এ সময় শরীরকে ফ্রেশ রাখতে সাহায্য করে।
- শরীরে আয়রন-এর ঘাটতি পূরণ করতে এ সময় খাদ্যতালিকায় বাড়তি সবুজ শাকসবজি, মাছ, মাংস, কলিজা ইত্যাদি রাখতে হবে।
বিভিন্ন রকম ফলমূল যেমন: কলা, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, জলপাই, পেপে, আনারস ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি সরবরাহ করে, যা আয়রন-এর শোষণ ও কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
প্রতি মাসে নিয়ম করে এই নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন প্রতিটি মেয়ের জীবনেই পার করতে হয়। প্রকৃতির নিয়ম মেনেই এই চক্র চলে। এটি নারীর শরীরবৃত্তীয় অধিকার, সুস্থতার একটি অংশ। তাই পিরিয়ড নিয়ে এখন আর কোন অজ্ঞতা, লজ্জা বা দ্বিধা মনে পুষে রাখা চলবে না। বয়ঃসন্ধির আগেই পরিবারের মেয়ে শিশুটির পাশাপাশি ছেলে শিশুটিকেও পিরিয়ড সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। এভাবেই আস্তে আস্তে সমাজ থেকে পিরিয়ড নিয়ে সকল ভুল ধারণা ও ট্যাবু দূর করা সম্ভব।
ডাঃ মারুফা আক্তার