মাসুদের কাশ্মীর নামা পর্ব – ০২
জম্মু অভিমুখে
বৃষ্টি থেকে গরম, জার্নি হবে চরম
বর্ডার এর সকল কার্যক্রম শেষে আমরা ভারতে প্রবেশ করলাম। ঘোজাডাঙ্গা মানে ভারত সাইডের বর্ডার থেকে দুই জন মিলে একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম। উদ্দেশ্য বসিরহাট। বসিরহাট বোট ঘাট নেমে আবার একটা টোটো নিলাম বসিরহাট রেলওয়ে স্টেশন যাওয়ার জন্য। বসিরহাট রেলওয়ে স্টেশন পৌঁছানোর কিছুক্ষন পরেই চলে আসলো আমার রাজু ভাইয়া। রাজু ভাইয়ের কথা কি বলবো ? থাকে না কিছু মানুষ যারা আত্মীয় না কিন্তু আত্মীয়ের থেকেও বেশি কিছু। আত্মীয় মানে যদি হয় আত্মার সম্পর্ক তবে রাজু ভাইদের সাথে আমার সম্পর্ক তার থেকে কোনো অংশে কম না।
রাজু ভাইয়ের সাথে মোলাকাত শেষে আমরা রওনা দিলাম হাসনাবাদ শিয়ালদাহ লোকালে করে শিয়ালদহের উদ্দেশ্যে। যদিও আমাদের ঊনত্রিশ রমজানের ইফতার করার কথা ছিল রাজু ভাইয়ার বাড়িতে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আর আমাদের হলো না। সময় কম থাকতে আমরা সরাসরি চলে গেলাম শিয়ালদাহ। পথিমধ্যে ট্রেনের ভিতরেই আমরা আমাদের এই রমজানের শেষ ইফতার সেরে নিলাম। যদিও একটু দেরি করেই ইফতার করলাম দুই দেশের টাইম এ একটু গরমিল হওয়ার কারণে।
ট্রেন যথারীতি পৌঁছে গেলো শিয়ালদাহ। শিয়ালদাহ থেকে একটা এম্বাসেডর নিয়ে হাওড়ার পানে ছুটে চললাম। এম্বাসেডর মানেই কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি। এম্বাসেডর কে ভারতের গর্ব বলা চলে। কারণ এম্বাসেডর হলো ভারতে প্রোডাকশন হওয়া দ্বিতীয় গাড়ি। এটা খুব গর্বের সাথে ১৯৬০-১৯৮০ পর্যন্ত ভারতে রাজত্ব করেছে। এখনো অনেক সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে সরকারি ভাবি এই এম্বাসেডর গাড়ি দিয়ে হয়। অনেক লাল বাতি ওয়ালা এম্বাসেডর গাড়ি এখনো ভারতে বিদ্যমান। এম্বাসেডর ঐতিহ্যবাহী হাওড়া ব্রিজ ক্রস করে পৌঁছে গেলো হাওড়া স্টেশন এ। ড্রাইভার এর প্রশ্ন আমরা ওল্ড হাওড়া স্টেশন নাকি নিউ হাওড়া স্টেশন এ নামবো ? আমরা উত্তর দিলাম জম্মু যাওয়ার ট্রেন যে স্টেশন এ আমরা সেই স্টেশন এ নামবো। বেচারা ড্রাইভার মহাশয় ও চটজলদি এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদেরকে ভাড়া মিটিয়ে মাঝ রাস্তায় নেমে যেতে বললো। আমরাও বাধ্য বালকের ন্যায় বাধা না দিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম। তারপর রোড ডিভাইডার এর চিপা চাপা দিয়ে বেরিয়ে (রোড এ জ্যাম ছিল) প্রবেশ করলাম – কোথায় প্রবেশ করলাম ?বুজতেই পারছেন বিখ্যাত “হাওড়া স্টেশন”।
হাওড়া স্টেশন এ প্রবেশ করে প্রথেমই ঢুকলাম জন আহার এ। লাইন এ দাঁড়িয়ে আহার সংগ্রহ করে মোটামুটি একটা ছোটোখাটো যুদ্ধ করে টেবিল নিয়ে ভোজন লীলা সাঙ্গ করলাম। তারপর প্রায় দুই ঘন্টার মতো অপেক্ষার পালা। হটাৎ মাথার উপর আবিষ্কার করলাম হেলিকপ্টার। ভাবছেন হাওড়া স্টেশন এ হেলিকপ্টার কোথা থেকে আসলো ? আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। তারপর দেখলাম আরে এত শুধু পাখা। হ্যা। বিশাল বিশাল বোরো সিলিং ফ্যান। একটা দুইটা না বেশ বেশ কয়েকটা ফ্যান। ফ্যান গুলা ঘুরছে খুব আস্তে আস্তে কিন্তু বেশ ভালোই বাতাস লাগছে। বাতাসটা একটু পর পর গায়ে লাগছে কিন্তু বাতাসের সেই কোমল ছোয়া গরমের ভিতর পুরা শরীর জুড়ে এক পরম শান্তির অনুভূতি দিচ্ছে। বেশ ভালো লাগছিলো।
দেখলাম পুরা স্টেশন জুড়ে কত মানুষজন শুয়ে বসে আছে। কেউ কেউ পরম শান্তিতে কি সুন্দর তৃপ্তির সাথে ঘুমের রাজ্যে পরিভ্রমণ করছে। সামনের ওয়েটিং চেয়ারে অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে। অনেকে চলে যাচ্ছে আবার অনেকে এসে অপেক্ষা করছে নির্ধারিত ট্রেন এর জন্য। এসব দেখছি আর অপেক্ষা করছি কখন আমাদের সেই চরম আরাধ্য “হিমগিরি এক্সপ্রেস” আসবে। মাঝে মাঝে স্টেশনের ডিসপ্লের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি “হিমগিরি এক্সপ্রেস” এর নাম সহ প্লাটফর্ম এর নাম দেখাচ্ছে কি না। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে একটা সময় ডিসপ্লেতে ভেসে উঠলো “হিমগিরি এক্সপ্রেস” এর নাম। ৮ নং প্লাটফর্ম এ আসছে আমাদের কাঙ্খিত “হিমগিরি এক্সপ্রেস”। এবার ধীরে ধীরে রওনা হলাম প্লাটফর্ম এর দিকে। প্লাটফর্ম এ পৌঁছানোর কিছু সময় পর চলে আসলো ট্রেন। আমাদেরকে বরণ করে নিজের বুকের ভিতর সযত্নে বসিয়ে জম্মু নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরাও নির্ধারিত বগি খুঁজে বসে পড়লাম ট্রেন এর বুকের ভিতর আমাদের জন্য নির্ধারিত সিটে।
আমাদের সিট পড়েছে বাম দিকের যে উপরে একটা সিট্ থাকে এবং নিচে একটা সিট্ থাকে তার নিচের সিটটা। সিটের নাম্বার এবং নাম দেখে বুজলাম কপালে দুঃখ আছে। মানে দুই জনের ভাগ্যে মিলেছে একটা সিট্। তারপর মোবাইল থেকে সিটের স্ট্যাটাস দেখে বুজলাম আজ রাতের জন্য হলেও উপরের সিটটা আমরাই পাচ্ছি। তাই আর দেরি না করে দুই জনই চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। তারপর সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষন পরে কলকাতার এক ভদ্র লোক নাস্তা নিয়ে আসলো। উনি আমাদের সাথে বেশ কিছুক্ষন গল্প করলেন। যদিও কাজের জন্য বেশিক্ষন সময় পেলেন না। তারপর সকাল গড়িয়ে যত দুপুর হতে লাগলো তত গরমের তীব্রতাও বাড়তে লাগলো। এরভিতরে আমাদের উপরের মহাশয় চলে আসলেন। উনি এসে যথারিতি আমাদের দুই জনের মধ্যে বসে পড়লেন উনার মালপত্র রেখে। এক অদ্ভুত হিন্দি ভাষায় বেশ কিছুক্ষন হালকা পাতলা সৌজন্য বিনিময় হলো। বুজলাম উনি লুধিয়ানা স্টেশন পর্যন্ত যাবেন। মনে মনে শান্তি পেলাম লুধিয়ানার পরে আবারও সিটটা আমাদের হবে। গরমের উষ্ণ হওয়া বেশ কষ্ট দিচ্ছিলো আমাদের। যেন আমরা গরমের কাছে কোনো অপরাধ করেছি আর গরম তার শাস্তি দিচ্ছে।
ট্রেনের ভিতরেই আমরা মনে মনে আমাদের এবারের ঈদুল ফিতর এর নামাজ পড়ে নিলাম। দিন গড়িয়ে রাত আসলো। গরমের তীব্রতা একটু কমলো। আমি ভেবেছিলাম ওয়েস্ট বেঙ্গল বা আরো দুই একটা রাজ্য পার হলে হয়তো একটু ঠান্ডা চলে আসবে কিন্তু না। শ্রীনগর যাওয়ার আগে কোনো রকম ঠান্ডা পেলাম না। আজ রাতে যেহেতু উপরের সিটে লোক আছে তাই সিদ্বান্ত হলো একজন একজন করে পালাক্রমে ঘুমাবো। আমি প্রথমে ঘুমাবো রাত দুইটা পর্যন্ত। তারপর ইলিয়াছ ঘুমাবে। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। আমি ঘুমাতে চলে গেলাম। যদিও ঘুম ঠিক মতো হয় নাই কাশ্মীর যাওয়ার উত্তেজনায়। এভাবেই সকাল হয়ে গেলো। সকালে যখন আমি বন্ধু ইমরান এর কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছিলাম শ্রীনগর কিভাবে যাবো , কোথায় থাকবো তখন পরিচয় হলো পারভেজ ভাই , হেলাল ভাইদের সাথে। তারা সবাই কাশ্মীর এর বাসিন্দা। কলকাতায় তাদের ব্যবসা আছে। কথা বলতে বলতে তারা অনেক তথ্য দিলেন এবং আমাদেরকে বললো তাদের বাড়ি যেতে। তারা আমাদের গাড়ি পর্যন্ত ঠিক করে দিলো। অসাধারণ একটা গাড়ি ছিল। তাদের গাড়িতে যদি জায়গা থাকতো তাইলে তাদের গাড়িতেই নাকি আমাদের নিয়ে যেত। তারা আমাদেরকে অনেক আতিথেয়তা দেখালো। বেশ ভালোই লাগলো। তবে কেন এত আতিথেয়তা দেখালো জানি না তবে বেশ ভালো লাগলো।
ট্রেন যখন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে প্রবেশ করলো অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে গেলো সমস্ত শরীর মন জুড়ে। ভাবতে পারেন কিভাবে বুজলাম ট্রেন জম্মু প্রবেশ করেছে ? পারভেজ ভাই হেলাল ভাইদের থেকে। তারা বললো একটু পরেই আর আমাদের নেটওয়ার্ক কাজ করবে না। মানে ইন্ডিয়ার অন্য রাজ্যের প্রিপেইড সিম নাকি কাশ্মীর রাজ্যে কাজ করে না। তখনই কল দিলাম বাড়িতে। বলে দিলাম চারদিন নেটওয়ার্ক এর বাইরে থাকবো। বাড়িতে বলতে আবার ভাববেন না বৌয়ের কাছে। আমি এখনো আনম্যারিড। কোন গার্লফ্রেন্ড ও নাই। গার্লফ্রেন্ড বলেন আর ভালোবাসা বলেন আপাতত এই ঘোরাঘুরিটাই সবকিছু। একটু পর যখন সত্যিই নেটওয়ার্ক চলে গেলো তখন এক অন্যরকম অনুভূতি মানে এক অসাধারণ শিহরণ কাজ করলো। জীবনে অনেকবার বলেছি নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলে যাবো। আর আজ যখন সত্যিই নেটওয়ার্ক এর বাইরে আসলাম এক কোথায় তার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করে মত না। আমার মনে হয় জীবনে সবারই একবার হলেও নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলা যাওয়া উচিত। কারণ নেটওয়ার্কের বাইরের জীবনটা একান্ত আপনারই। যেখানে জীবনটাকে আপনি আপনার মত করে উপভোগ করতে পারবেন। সেখানে থাকবেনা কোন বাধ্যবাধকতা। আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। আপনি একান্তই আপনারই। এসব চিন্তা করতে করতে পৌঁছে গেলাম জম্মু রেলওয়ে স্টেশন। সমাপ্তি ঘটলো আমাদের দীর্ঘ প্রায় সাঁইত্রিশ ঘন্টার আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সফর।
চলবে….
**** মাসুদ হাসান ****
মাসুদের কাশ্মীর নামা পর্ব – ০২
( আপনিও আপনার ভ্রমণ কাহিনী আমাদের লিখে পাঠাতে পারেন , [email protected] এ )